অনেকেরই ধারণা, গাঁজা সৃজনশীলতা বাড়ায়। আর এ কারণে সৃজনশীল কাজে উৎসাহী কিছু মানুষ গাঁজা গ্রহণ করেন। আসলেই কি গাঁজা কী সৃজনশীলতা বাড়ায়?
জানা যায়, কর্মক্ষেত্রে কর্মীর কাজের দক্ষতা, আচরণ ইত্যাদি নিয়ে এখন পর্যন্ত বিজ্ঞানীরা নানা গবেষণা করেছেন। কিন্তু কর্মক্ষেত্রে গাঁজার প্রভাব নিয়ে বৈজ্ঞানিক গবেষণার সংখ্যা বেশ সীমিত। আর তাই কোনো অফিসের কর্মীদের কাজের ওপর গাঁজা কী প্রভাব ফেলে তা জানতে গবেষণা করেছেন কয়েকজন বিজ্ঞানী।
যুক্তরাষ্ট্রের ওয়াশিংটন স্টেটে গাঁজার ব্যবহার বৈধ। এখানকার ৩০০ জন গাঁজা সেবনকারীর ওপর দুইটি গবেষণা পরিচালনা করা হয়। ওই সেবনকারীরা সপ্তাহে নিয়মতি গাঁজা গ্রহণ করেন। গাঁজার প্রভাব থাকা অবস্থায় তাদেরকে তাদের স্বাভাবিক পরিবেশে বিভিন্ন সৃজনশীল কাজ করতে দেন বিজ্ঞানীরা।
সৃজনশীলতা পরীক্ষার গবেষণায় অংশগ্রহণকারীদেরকে একটি ইট দিয়ে সে ইটের যতগুলো সম্ভব সৃজনশীল ব্যবহারের তালিকা তৈরি করতে বলা হয়। এ ধরনের গবেষণায় এটি একটি প্রমিত পদ্ধতি। প্রথম গবেষণাটির ক্ষেত্রে এ বিজ্ঞানীরাও ওয়াশিংটনের গাঁজাসেবীদের একই কাজ করতে বলেন।
দ্বিতীয় গবেষণায় অংশগ্রহণকারীদের একটি কল্পিত পরিস্থিতির মুখোমুখি দাঁড় করানো হয়। তাদেরকে বলা হয়, তারা মনে করুক তারা একটি পরামর্শদাতা প্রতিষ্ঠানের হয়ে কাজ করছেন এবং একটি মিউজিক সংস্থা আরও বেশি আয় বাড়ানোর জন্য তাদের প্রতিষ্ঠানকে নিযুক্ত করেছে। এক্ষেত্রে অংশগ্রহণকারীদের আবারও সম্ভাব্য সবধরনের সৃজনশীল উপায়ের কথা ভাবতে বলেন বিজ্ঞানীরা।
এরপর বিজ্ঞানীরা গবেষণায় অংশগ্রহণকারী ব্যক্তিদের এবং একইসঙ্গে এক্সটার্নাল বিচারক, গবেষণা সহযোগী, ও বিষয়ভিত্তিক বিশেষজ্ঞদের ওই সৃজনশীল আইডিয়াগুলোর বিচার করার ভার দেন।
দেখা গেছে, যেসব ব্যক্তি গাঁজা সেবন করে কাজ করেছেন, গড়পড়তা তারা বেশি সুখী, উৎফুল্ল, ও এক কথায় বলতে গেলে ভালো মেজাজে ছিলেন। এর ফলে দেখা গেছে, গাঁজা সেবন না করা অংশগ্রহণকারীদের তুলনায় তারা নিজেদের ও অন্যদের আইডিয়াকে বেশি সৃজনশীল হিসেবে মূল্যায়ন করেছেন।
তবে যেসব স্বতন্ত্র বিচারক ওই আইডিয়াগুলো মূল্যায়ন করেছেন, তাদের চোখে গাঁজা সেবনকারী ও যারা সেবন করেন না, দুই দলের আইডিয়াগুলোর কোনোটিই সৃজনশীল ছিল না।
প্রফুল্লতা মানুষের সৃজনশীলতা বৃদ্ধি করে। কারণ মন প্রফুল্ল থাকলে মানুষ আরও নমনীয় ও খোলা মনের হয়ে থাকেন।
অর্থাৎ, এ দুই গবেষণার পর গবেষকেরা সিদ্ধান্তে পৌঁছেছেন, গাঁজা কোনোভাবে মানুষের সৃজনশীলতার ওপর প্রভাব ফেলে না। তবে এটি মানুষের প্রফুল্লতা বাড়ায়। আর এ কারণেই আইডিয়ার সৃজনশীলতা নিয়ে ইতিবাচক ধারণা পোষণ করেছিলেন নিত্য গাঁজাসেবীরা।
এর আগের ভিন্ন প্রসঙ্গে করা গবেষণায় দেখা গেছে, প্রফুল্লতা মানুষের সৃজনশীলতা বৃদ্ধি করে। কারণ মন প্রফুল্ল থাকলে মানুষ আরও নমনীয় ও খোলা মনের হয়ে থাকেন। কিন্তু বর্তমান গবেষকদের দাবি, গাঁজা থেকে সৃষ্ট মানসিক প্রফুল্লতা সৃজনশীলতার ধারণা কেমন হতে পারে তা বাড়াতে সহায়তা করে, আদতে কাউকে সৃজনশীল করে না।
তবে বিজ্ঞানীরা একবাক্যে স্বীকার করেছেন, এ গবেষণায় গাঁজাকে কোনোভাবে দোষারোপ করা হয়নি। তাদের গবেষণা একইসঙ্গে এটাও প্রমাণ করেছে যে গাঁজা খেলে কারও যেমন সৃজনশীলতা বাড়ে না তেমনিভাবে এর প্রভাবে ব্যক্তির সৃজনশীল ক্ষমতায়ও কোনো নেতিবাচক পরিবর্তন হয় না। আর তাই, সৃজনশীল কাজ করতে হয় এমন কর্মীদের মাঝেমধ্যে গাঁজা খেলে তা-তে বিশেষ কোনো ক্ষতি হয় না।
আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে আলোকপাত করেছেন এ বিজ্ঞানীরা। যেহেতু গাঁজার প্রভাবে কম সৃজনশীল আইডিয়াকেও মানুষ সৃজনশীল হিসেবে মেনে নেয়, সেজন্য একটি অফিসে যেসব ম্যানেজারের দায়িত্ব নিজের বা কর্মীদের কাজের সৃজনশীলতা মাপা, তাদের গাঁজা সেবন না করে কাজ করার পরামর্শ দিয়েছেন তারা।
কর্মক্ষেত্রে যাদের কাজ সৃজনশীল আইডিয়া তৈরি করা, তাদের জন্য গাঁজা বাধ্যতামূলকভাবে নিষিদ্ধ না করারই পরামর্শ দেওয়া হয়েছে বর্তমান গবেষণায়। আবার যেসব কাজে মাথা পরিষ্কার রেখে সৃজনশীলতা বিচার করতে হয়, সেসব ক্ষেত্রে কর্মীর ব্যক্তিগত স্বাধীনতাকে সম্মান জানিয়ে তাদেরকে ‘সোবার’ অবস্থায় থাকার জন্য উৎসাহিত করতে বলা হয়েছে প্রতিষ্ঠানকে।
অনেকের কাছে গাঁজা বা মারিজুয়ানা এক ধরনের ওষুধ। চিকিৎসার কাজেও গাঁজার ব্যবহার হয়ে থাকে। গাঁজা গাছ একটা উদ্ভিদ যা বিশেষ ধরনের মৃগীরোগের চিকিৎসায় ওষুধের কাজ করে। কিন্তু অনেকের কাছে গাঁজা নেশার উপকরণ। গাঁজা খেলে মন-মস্তিষ্কে অনেক কিছু ঘটে। অন্যান্য নেশা দ্রব্য ব্যবহার থেকে বাঁচতে বা মানসিক রোগের চিকিৎসাতেও গাঁজার ব্যবহারের প্রচলন রয়েছে। বিশেষজ্ঞরা জানিয়েছেন, গাঁজা আসলে মন ও মস্তিষ্কে কী ঘটায়?
গাঁজা সেবনে মানুষের হ্রদস্পন্দন বেড়ে যায়, যা প্রতি মিনিটে ২০-৫০টি বাড়তে পারে। এ অবস্থা ৩০ মিনিট থেকে ৩ ঘণ্টা পর্যন্ত স্থায়ী থাকে। গাঁজায় আছে টেট্রাহাইড্রোক্যানাবিনোল (টিএইচসি)। এটা মস্তিষ্কে এমন এক অংশে কাজ করে যে অংশটি সুখকর অনুভূতির সৃষ্টি করে।
গবেষণায় দেখা গেছে, বেশ কিছু অস্বাস্থ্যকর বিষয় থেকে মুক্তি দেয় গাঁজা। দেহের প্রদাহ বিনাশ করে। রিউমাটয়েড আর্থ্রাইটিসের মতো যন্ত্রণাদায়ক রোগ উপশমে কার্যকর ভূমিকা রাখে। গাঁজায় আরো আছে ক্যানাবিডিওল (সিবিডি)। এটি থেরাপির কাজ করে। বিশেষ ধরনের ব্যথানাশক হিসাবে দারুণ কাজের এটি।
এর আগে গাঁজাকে কঠিন মাদকের তালিকা থেকে সরিয়ে ফেলার সিদ্ধান্ত নিয়েছে জাতিসংঘ। চিকিৎসা বিজ্ঞানের গবেষণায় গাঁজার প্রয়োজনীয়তার কথা মাথায় রেখেই নেয়া হয় এই সিদ্ধান্ত।
কানাডাসহ আরো কয়েকটি দেশ আগেই চিকিৎসা খাতে ব্যবহারের জন্য গাঁজা উৎপাদনের বৈধতা দিয়েছে। সেই তালিকায় পাকিস্তানও আছে।
অনেক দেশেই গাঁজার বৈধতা পাওয়ার বিষয়টি শুরু হয়েছে গাঁজার ব্যবহার সম্পর্কে সাধারণ মানুষের মনোভাব পরিবর্তনের সাথে সাথে।
যুক্তরাষ্ট্র ও কানাডায় চিকিৎসা কাজে গাঁজার ব্যবহারের বিষয়ে মানুষের মনোভাব পরিবর্তন হতে থাকে মূলত, জটিল শারীরিক সমস্যায় ভুগতে থাকা শিশুদের শারীরিক যন্ত্রণার বিষয়ে সচেতনতা তৈরি হওয়ার পর।
একই ধরণের ধারা লক্ষ্য করা গেছে যুক্তরাজ্যের ক্ষেত্রেও। যুক্তরাজ্যে ‘চিকিৎসা কাজে’ গাঁজার ব্যবহার বৈধতা পেলেও ব্রিটিশ স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের বক্তব্য অনুযায়ী ‘বিনোদনমূলক ব্যবহার’ অবৈধই থাকবে।
বিশ্লেষকরা বলেন, গাঁজার বিষয়ে বিশ্বের বেশ কয়েকটি দেশের মানুষ ও সরকারের মনোভাব পরিবর্তনের ধারা বিশ্লেষণ করে অনুমান করা যেতে পারে যে গাঁজার ব্যবহারের জনপ্রিয়তা বিবেচনা করে অন্যান্য দেশও এর উৎপাদন ও ব্যবসার প্রসারে বিনিয়োগ করতে আগ্রহী হবে।
তারা বলেন, পৃথিবীর অনেক দেশেই চিকিৎসার কাজে গাঁজা ব্যবহৃত হচ্ছে, নিকট ভবিষ্যতে আরো অনেক দেশে ব্যবহার শুরু হবে বলেও ধারণা করা হচ্ছে। সম্ভাবনাময় এই খাত থেকে মুনাফা অর্জনের লক্ষ্যেই বিভিন্ন দেশের সরকার গাঁজা চাষকে গুরুত্ব দেয়।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৪৫৩
আপনার মতামত জানানঃ