বিজেপির প্রভাবশালী নেতা যোগী আদিত্যনাথকে নিয়ে একটি বিদ্রুপাত্মক ইন্সটাগ্রাম পোস্ট দ্রুত সরিয়ে নেওয়া নিয়ে প্রশ্ন ওঠার পর বিজেপির আইটি সেল প্রধান অমিত মালভিয়ার অতিরিক্ত সেন্সর প্রিভিলেজ (এক্সচেক স্ট্যাটাস) ভোগ করার উপর দ্য ওয়্যারের আলোচিত রিপোর্টকে ভুল এবং বিভ্রান্তিকর বলার পাশাপাশি মনগড়া বলেও জানায় মেটা; যে কোম্পানিটি মূলত ফেসবুক ও ইন্সটাগ্রামের মালিক।
এই দাবিটি গত ১১ অক্টোবর একটি মেইলের মাধ্যমে জানানো হয়, যার নির্দেশক ছিলেন মেটার মুখপাত্র। এর প্রায় একঘন্টা আগে মেটার দ্য ওয়াশিংটন ভিত্তিক পলিসি কমিউনিকেশন’স ডিরেক্টর এন্ডি স্টোন একইরকম দাবি জানিয়ে টুইটারে একটি পোস্ট দেন। স্টোন বলেন, মেটার সুপারইউজার মালভিয়ার ক্ষেত্রে প্ল্যাটফর্মের সাধারণ নিয়ম প্রযোজ্য নয়-এর সাথে পোস্টে রিপোর্ট করার সক্ষমতার কোনও সম্পর্ক নেই।
তিনি আরও বলেন, পোস্টটি নিয়ে প্রশ্ন তুলেছিল স্বয়ংক্রিয় সিস্টেম, কোন মানুষ নয়। আর তাই উক্ত প্রতিবেদনটি প্রকৃতপক্ষে মনগড়া।
স্টোনের টুইটের উদ্দেশ্য ছিল মূলত দ্য ওয়্যারের দাবিকে খণ্ডন করা – যে দাবির প্রমাণ হিসাবে আছে ইন্সটাগ্রামের ঘটনা পরবর্তী পুনঃমূল্যায়ন প্রতিবেদন। যার মাধ্যমে এটা নিশ্চিত হওয়া যায়, আদিত্যনাথের পোস্টটি মালভির অভিযোগের পরই দ্রুত সরিয়ে নেওয়া হয়।
যদিও স্টোনের এই পোস্ট মেটার কর্মচারীদের পাঠানো তার এক মেইলের সাথে একদমই বিপরীত। সেই মেইলে তিনি বেশ রাগান্বিতভাবেই জানতে চেয়েছেন, ‘কীভাবে এই ডকুমেন্টটা ফাঁস হলো?’
আবার এই ইমেইলটা মেটার এক সূত্রের মাধ্যমে হাতে এসেছে দ্য ওয়্যারের। এই ইমেইলে স্টোন ওই ডকুমেন্ট সংক্রান্ত গত এক মাসের রিপোর্ট চেয়েছেন। সম্ভবত তিনি কীভাবে ডকুমেন্টটি ফাঁস হলো, তা খুঁজে বের করতে চাইছেন। এবং একই সাথে তিনি ওই প্রতিবেদনের রিপোর্টার কেন মেটার ওয়াচলিস্টে নেই, তাও জানতে চেয়েছেন। তিনি বলেন ওই প্রতিবেদক ও দ্য ওয়্যারের প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক সিদ্ধার্ত ভারদারাজানকে অবশ্যই অতিদ্রুত ওয়াচলিস্টে নিতে হবে এবং মেটার কোন কর্মচারী তাদের সাথে যোগাযোগ করলে, সরাসরি যেন তাকে জানানো হয়।
উক্ত মেইলে স্টোনের নির্দেশনা অতি দ্রুতই পালন করে ভারতের কমিউনিকেশন টিম। আর এই কাজটা করেন রাজীব আগারওয়াল। তিনি একজন প্রাক্তন আইএএস কর্মকর্তা। বর্তমানে ভারতে মেটার পাব্লিক পলিসির প্রধান। তিনি স্টোনকে লেখেন যে, ভারত থেকে ওই প্রতিবেদকের সাথে কথা বলা কর্মচারীকে তিনি শনাক্ত করেছেন।
সোমবার রাত ৮ টা ৪৮ মিনিট থেকে শুরু করে দ্য ওয়্যারের প্রতিবেদক মেটা ইন্ডিয়ার কমিউনিকেশন টিমের কোন এক সদস্যের কাছ থেকে তিনটি ফোনকল এবং এরপর হোয়াটসঅ্যাপ ম্যাসেজ পান। এর পরবর্তীতে কমিউনিকেশনের সদস্য ঠিক তাই জানান, যা পরবর্তীতে স্টোন তার টুইটে জানিয়েছিলেন। তবে অতিরিক্ত এ-ও বলেছিলেন, এই কথোপকথন ‘অফ দ্য রেকর্ড’, কারণ তারা মুখপাত্র নয়। ওই সদস্য জানিয়েছিল, দ্যভোয়্যারে মেটার পক্ষ থেকে একটি বক্তব্য পাঠানো হবে। পরবর্তীতে মঙ্গলবার দ্য ওয়্যার ওই বক্তব্য পায়।
যেখানে বলা হয়, পোস্টটি নিয়ে প্রশ্ন তুলেছিল স্বয়ংক্রিয় সিস্টেম, কোন মানুষ নয়। আর তাই উক্ত প্রতিবেদনটি প্রকৃতপক্ষে মনগড়া। সর্বোপরি প্রতিবেদনটি ভুল ও বিভ্রান্তিকর।
একই সময়ে মেটার মুখপাত্র প্রতিবেদনটিকে ‘মনগড়া’ বলে অভিযোগ করেন। এদিকে স্টোনের অভ্যন্তরীণ মেইল এটা নিশ্চিত করে যে মেটা শুধু প্রতিবেদনটার সত্যতা নয়, তাদের তথ্য কীভাবে ফাঁস হলো, তা নিয়েও চিন্তিত।
এবার চলুন জেনে নেওয়া যাক, কী ঘটেছিল। ৬ অক্টোবর ২০২২, দ্য ওয়্যারের এক প্রতিবেদনে জানানো হয় যে, Superhumans of Cringetopia- এর কিছু ইন্সটাগ্রাম পোস্ট ১৯ সেপ্টেম্বর প্লাটফর্মের কমিউনিটি গাইডলাইন না মানার জন্য সরিয়ে নেওয়া হয়। ওই একাউন্ট থেকে সামাজিক ও রাজনৈতিক বিদ্রুপাত্মক করা হতো বেশ কেতাবি ভাষায়। তবে এই পোস্টগুলোর অধিকাংশই ভারতের হিন্দুত্ববাদী দলগুলো এবং নরেন্দ্র মোদির সমালোচনা করে করা হতো- যেখানে হিন্দুত্ববাদকে নাৎসিবাদের সাথে তুলনা করা হতো।
অযোধ্যার এক বাসিন্দা উত্তর প্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী আদিত্যনাথকে পূজা করছিলেন এক মন্দিরে, এই ঘটনাকে উপহাস করে বানানো এক ভিডিওকে ফোকাস করে দ্য ওয়্যার প্রতিবেদন করেছিল।
এই ভিডিও সরিয়ে নেওয়ার কারণ কী ছিল? এই ভিডিও নাকি সেক্সুয়াল একটিভিটি ও নুড্যিটির কারণে সরিয়ে নেওয়া হয়েছে? সত্যিই? নুড্যিটি? এই ভিডিওতে নুড্যিটি কোথায়?
তবে এটাই সত্য। মেটার একজন মুখপাত্র জানান, নুড্যিটিই কারণ। যদিও ভিডিওতে দুজনেই (অযোধ্যার বাসিন্দা ও আদিত্যনাথ) পুরোপুরিভাবে কাপড় পরা ছিলেন।
দ্য ওয়্যারের প্রতিবেদন অনুয়াযী, এই ইন্সটাগ্রাম পোস্টটি আপলোড করার দুই মিনিটের মধ্যেই সরিয়ে নেওয়া হয়। তাই প্রশ্ন ওঠে, এটা এলগরিদমের কাজ নাকি মানুষের।
একটি টুইটার চ্যাটে Superhumans of Cringetopia- এর সাথে জড়িত একজন জানান, ৭ মার্চ থেকে ১৯ সেপ্টেম্বরের মধ্যে ৭ টি ইন্সটাগ্রাম পোস্ট সরানো হয়। তিনি এর স্ক্রিনশটও দেন। যেখানে প্রতিটা পোস্ট ক্লোজড উল্লেখ করা হলেও আদিত্যনাথের পোস্টটা দুইবার রিভিউড উল্লেখ করা ছিল। এটা কীভাবে সম্ভব?
এ বিষয়ে জানতে দ্য ওয়্যার এন্ডি স্টোনের সাথে ১১ অক্টোবর মেইলের মাধ্যমে যোগাযোগ করেন। কিন্তু মেটা এর উত্তরে কিছু জানায়নি। বরং তাদের পাব্লিক রিলেশন এজেন্সির মাধ্যমে জানায় যে, প্রতিবেদক জানভি সেন যে এটাচমেন্ট মেইলে পাঠিয়েছে, তা মেটা পায়নি। এরপর প্রতিবেদক আবার সেই এটাচমেন্টটি পাঠান।
এদিকে, প্রতিবেদন প্রকাশের অল্প কিছু সময় পরেই মেটার প্রাইভেসি ও সিকিউরিটি টিমের একজন সাবেক সিনিয়র কর্মচারী ইমেইলের মাধ্যমে দ্য ওয়্যারের সাথে যোগাযোগ করে এবং দ্য ওয়্যারকে হুইসেলব্লোয়ার হিসেবে আখ্যা দেয়। পাশাপাশি জানায়, ২০১৯-২০ সালে মালভিয়ার মতো এমন কিছু মানুষকে এক্সচেক সুবিধা দেওয়া নিয়ে তারা বিরোধ করেছিলেন। এরপর স্টোন তার টুইটে দ্য ওয়্যারের প্রতিবেদনটিকে মনগড়া আখ্যা দিলে, ওই সিনিয়র কর্মচারী তাকে প্যাথলজিকাল লায়ার বলে মন্তব্য করেন।
এখানে প্রশ্ন উঠতে পারে সোশ্যাল মিডিয়ায় পোস্ট সরিয়ে নেওয়া কি নতুন কিছু? এটা নিয়ে আকাশপাতাল করার কী আছে? আছে কারণ এর মাধ্যমেই এক সত্য প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। কারণ দ্য ওয়্যার যখন মেটায় তাদের বিভিন্ন সোর্সের সাথে বিষয়টি নিয়ে যোগাযোগ করে, তখন তারা বুঝতে পারে, কীভাবে ভারতে ক্ষমতায় থাকা ভারতীয় জনতা পার্টি মেটা তথা সোশ্যাল মিডিয়াকে ব্যবহার করে মানুষের বাক-স্বাধীনতাকে ক্ষুণ্ণ করছে। পাশাপাশি স্বচ্ছ নির্বাচনকে করছে ব্যহত।
একইভাবে বাংলাদেশের এক্টিভিস্টদের কন্টেন্টের ক্ষেত্রেও মেটা বা ফেসবুকের বিরুদ্ধে একই আচরণ করার অভিযোগ দীর্ঘদিনের। ধারণা করা হয় বাংলাদেশের সরকার সংশ্লিষ্ট বেশ কয়েকটি আইটি সেলকে ফেসবুক কর্তৃপক্ষ এডমিন এক্সেস দিয়ে রেখেছে। যারা সরকারের সমালোচনা করা পোস্টগুলোকে ভারতের এই ঘটনার মত নিয়ন্ত্রণ করছে। সরকারের বিভিন্নস্তরের দুর্নীতি নিয়ে যারা ফেসবুকে লেখালিখি করছেন তাদের পোস্টগুলোকে ন্যুডিটি বা বিভিন্ন ধরনের কমিউনিটি স্ট্যান্ডার্ড লংঘনের অভিযোগে সরিয়ে দেওয়া হচ্ছে, সরকার বিরোধী এক্টিভিস্টদের দীর্ঘদিন ধরে ব্লকের তালিকায় অর্ন্তভুক্ত করে রেখেছে অথবা এক্টিভিস্টদের নিউজফিডকে কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণ করা হচ্ছে। শুধু বাংলাদেশ বা ভারত নয়, বিশ্বের বিভিন্ন দেশে মেটা এমন ধরনের অনৈতিকতার সাথে দীর্ঘদিন ধরে জড়িত আছে বলে অভিযোগ আছে।
ফেসবুক বিজেপি চক্রান্ত: মেটার অভিযোগের বিরুদ্ধে দ্য ওয়্যারের প্রমাণ
এসডব্লিউ/এসএস/১৮০০
আপনার মতামত জানানঃ