ইরানে বিক্ষোভরত এক তরুণীকে আটকের সময় দাঙ্গাবিরোধী পুলিশ তার উপর যৌন হামলা চালিয়েছে এমন একটি ভিডিও ঘিরে তীব্র ক্ষোভ দেখা যাচ্ছে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলোতে। অনেকেই এ ঘটনার জন্য ‘ন্যায় বিচার’ দাবি করছেন ও দেশটির পুলিশ প্রধানের পদত্যাগ দাবি করছেন।
সামাজিক মাধ্যমের অনেক টুল ব্লক করে রাখা সত্ত্বেও ইরানের নাগরিকরা অনেকেই বিক্ষোভের খুবই প্রভাবশালী ছবি ব্যাপকভাবে শেয়ার করে যাচ্ছেন। প্রসঙ্গত, দেশটিতে এবার কয়েক দশকের মধ্যে সবচেয়ে বড় আন্দোলন দেখা যাচ্ছে।
নিরাপত্তা হেফাজতে ২২ বছর বয়সী তরুণী মাহসা আমিনির মৃত্যুর পর থেকেই সেখানে বিক্ষোভ দানা বাঁধে এবং পরে সারাদেশে ছড়িয়ে পড়ে। যদিও কর্মকর্তারা দাবি করেছেন ওই তরুণী মারা গেছেন সেরিব্রাল হাইপক্সিয়া থেকে একাধিক অঙ্গ বিকল হয়ে যাবার কারণে। যদিও তার পরিবার বলছে দেশটির নৈতিকতা পুলিশের মারধরের কারণে মাহসা আমিনির মৃত্যু হয়েছে।
যা ঘটেছে
এরপর ইরানের ভেতরে ও বাইরে অনেকে ভিডিও ভাইরাল হয়েছে। সবশেষ যে ভিডিওটি ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়েছে সেটি ঘটেছে বুধবার তেহরানের আর্জেন্টিনা স্কয়ারে। এতে দেখা যাচ্ছে হেলমেটসহ সুরক্ষা সামগ্রী পরিহিত একদল পুলিশ প্রধান সড়কেই একজন নারীকে ঘিরে আছে।
এর মধ্যে একজন তার গলা চেপে ধরেন এবং তাকে অন্তত দু ডজন পুলিশের ভিড়ের মধ্যে নিয়ে যান, যাদের অনেকে মোটরসাইকেলে বসা ছিলো।
যখন ওই নারীকে একটি বাইকের দিকে জোর করে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা হচ্ছিলো তখন আরেকজন কর্মকর্তা পেছন দিক থেকে তার দিকে এগিয়ে আসেন এবং তার হাতের গোড়ায় চেপে ধরেন। ওই নারী যখন পড়ে যান মাটিতে তখন আরও কর্মকর্তারা তাকে ঘিরে ধরেন।
এ সময় একটি ক্যামেরায় তোলা ভিডিওতে একটি নারী কণ্ঠকে বলতে শোনা যায় “ওরা তার চুল ধরে টানছে”। সেখানে অন্য যানবাহনের চালকেরা তখন একযোগে হর্ন বাজাতে শুরু করেন যা এবারের বিক্ষোভে সারাদেশে প্রতিবাদের একটি ভাষা হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে।
ওই নারীর মাথায় হিজাব বা স্কার্ফ ছিলো না। এক পর্যায়ে তাকে দাঁড়াতে দেখা যায় ও পরে তিনি দৌড়ে ঘটনাস্থল থেকে পালিয়ে যান। ভিডিওতে আগের নারীর কণ্ঠেই আবার শোনা যায় , “ওর দিকে তাকাও (নিরাপত্তা কর্মকর্তা), সে হাসছে”।
বিবিসি পার্সিয়ান সার্ভিস ওই ফুটেজ পরীক্ষা করে দেখেছে। তেহরান পুলিশের মুখপাত্রকে উদ্ধৃত করে ইরানের রাষ্ট্রীয় বার্তা সংস্থা জানিয়েছে ঘটনাটি তদন্ত করে দেখা হচ্ছে।
কী বলছে পুলিশ?
পুলিশের বিবৃতিতে অবশ্য ঘটনাটি সম্পর্কে বিস্তারিত কিছু বলা হয়নি। তবে তারা বলেছে, “শত্রুরা মানসিক যুদ্ধাস্ত্র ব্যবহার করছে জনমনে উদ্বেগ তৈরি করতে ও সহিংসতাকে উস্কে দেয়ার জন্য”।
তেহেরানের দাবি, এসবের নেপথ্যে রয়েছে বিদেশি শত্রুর হাত। এই ইস্যুতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে নিশানা করেছেন ইরানের প্রেসিডেন্ট ইব্রাহিম রাইসি।
যদিও হিজাব আন্দোলনকারীদের একটা বড় অংশই ইরান সরকারের যুক্তি মানতে নারাজ। তাদের দাবি, বিক্ষোভ থামানোর নামে নির্যাতন করার জন্যেই জনগণের রোষের মুখে পড়তে হচ্ছে ইরানি গার্ডকে।
যা বলছে বিক্ষোভকারীরা
ঘটনা হলো বিষয়টি ঘটেছে প্রকাশ্যে যা মানবাধিকার কর্মীদের মধ্যে প্রশ্ন তৈরি করেছে যে তাহলে পুলিশ রুদ্ধদ্বার কক্ষে কি করে।
আতেফেহ নামে একজন সামাজিক মাধ্যমে লিখেছেন, “তোমরা কি নারীদের হয়রানি এখন কারাগার থেকে প্রকাশ্যে রাস্তায় নিয়ে এসেছো তোমাদের অশ্লীলতা, কামুকতা ও নোংরামি দিয়ে আমাদের মুখ বন্ধ করতে?”
অনেক বছর ধরেই বন্দীদের সাথে যৌন ও মানসিক হয়রানিসহ নানা অসদাচরণের অভিযোগ আছে ইরানে। অনেক ইরানি লিখেছেন তেহরানের এ ঘটনা তাদের বিক্ষোভে যেতে আরও দৃঢ় করেছে।
বিক্ষোভে ২৩ শিশুর মৃত্যু
ইরানের চলমান হিজাববিরোধী বিক্ষোভ-আন্দোলন দমনে দেশটির আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর গুলিতে অন্তত ২৩ শিশুর মৃত্যু হয়েছে বলে দাবি করেছে অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল।
একটি বিশদ বিবৃতিতে সংস্থাটি জানিয়েছে ২০ সেপ্টেম্বর থেকে ৩০ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত বিক্ষোভ চলাকালে বেআইনি বল প্রয়োগের ফলে ২৩ শিশুর মৃত্যু হয়েছে। নিহত এই শিশুদের নাম প্রকাশের পাশাপাশি কিভাবে কোন পরিস্থিতিতে তাদের মৃত্যু হয়েছে সেটিও তুলে ধরেছে অ্যামনেস্টি।
অ্যামনেস্টি বলছে নিহত শিশুদের মধ্যে ১১ থেকে ১৭ বছর বয়সী ২০ জন ছেলে ও তিনজন মেয়ে। এই শিশুদের বেশিরভাগ নিহত হয়েছে তাদের লক্ষ্য করে পুলিশের ছোড়া গুলিতে। এছাড়া চার শিশুকে পিটিয়ে হত্যা করা হয়েছে।
জাতিসংঘের রিপোর্ট
আধুনিক যুগেও ইরানে নারী ও কন্যাশিশুরা দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিক হিসেবে বিবেচিত। সম্প্রতি জাতিসংঘের একটি গবেষণা প্রতিবেদনে উঠে এসেছে এ তথ্য।
জাতিসংঘে ইরানের মানবাধিকার পরিস্থিতি বিষয়ক বিশেষ দূত ও স্বতন্ত্র বিশেষজ্ঞ জাভেদ রেহমান এই গবেষণা প্রতিবেদন তৈরি করেন। এতে বলা হয়, জীবনের প্রায় সব ক্ষেত্রেই চরম বৈষম্যের শিকার ইরানের নারীরা। উদ্বেগ জানানো হয় নারীদের ওপর পারিবারিক সহিংসতা নিয়েও।
রেহমান বলেন, পিতৃতান্ত্রিক মূল্যবোধ আর নারীবিদ্বেষী আচরণে জর্জরিত ইরানের নারীদের নিত্যদিনের জীবন। বৈষম্যমূলক আইনের কারণে দিনদিন পারিবারিক সহিংসতার ঘটনা বেড়ে চলছে দেশটিতে।
বাল্যবিবাহের ওপর আলোকপাত করে বলা হয়, গত বছরের ছয় মাসে দেশটিতে ১০ বছর থেকে ১৪ বছর বয়সী ১৬ হাজার কন্যা শিশুর বিয়ে হয়েছে।
রেহমান বলেন, ‘নারী ও মেয়ে শিশুদের অধিকার নিয়ে কথা বলতে গেলে প্রথমেই আসে বাল্যবিবাহের প্রশ্ন। ইরানে বিয়ের ন্যূনতম বয়স নিয়ে যে আইন রয়েছে, তা কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়।
আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংগঠন হিউম্যান রাইটস ওয়াচের তথ্য অনুযায়ী, ইরানে বাবার অনুমতি সাপেক্ষে কন্যাসন্তানের বিয়ের ন্যূনতম বয়স ১৩ বছর। বিচারকের বিশেষ অনুমতি নিয়ে আরো কমবয়সেও মেয়েদের বিয়ে হওয়ার নিয়ম আছে দেশটিতে।
রেহমান জানান, বিয়ে, বিচ্ছেদ, কর্মসংস্থানসহ সব ক্ষেত্রেই নারী-পুরুষের বৈষম্য প্রকটভাব দৃশ্যমান ইরানে। দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিক হিসেবে গণ্য করা হয় নারীদের।
প্রতিবেদনে আরো উঠে আসে বিরোধিতাকারীদের ওপর তেহরানের চরম মানবাধিকার লঙ্ঘনের অনেক ঘটনা।
বলা হয়, ইরান সরকারের আক্রমণ থেকে বাদ পড়ছে না নারী, শিশু, মানবাধিকার কর্মী, সংখ্যালঘু নৃগোষ্ঠী, লেখক, সাংবাদিক ও দ্বৈত নাগরিকত্ব আছে- এমন ব্যক্তিরা। নির্যাতন, নিপীড়ন, হয়রানি, বিচারবহির্ভূত আটক, জোরপূর্বক স্বীকারোক্তি আদায় করা, মৃত্যুদণ্ডসহ নানাভাবে ভোগান্তির শিকার এই বিপুলসংখ্যক মানুষ।
এসডব্লিউ/এসএস/১৪৩০
আপনার মতামত জানানঃ