ফিলিস্তিন ইস্যুতে ইসরায়েলের সাথে মুসলিম বিশ্বের প্রায় সমস্ত দেশই সম্পর্ক বিচ্ছিন্ন করে চলছে। এবার দেখা যাচ্ছে, মুসলিম বিশ্বের দেশগুলোতে সম্পর্ক গড়তে এক রকম পরিকল্পনা নিয়ে মাঠে নেমেছে ইসরায়েল। আর এই সম্পর্ক গড়ে দেওয়ার মধ্যস্থতাকারী হিসেবে বরাবরই উপস্থিত থাকে আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্র। জানা যায়, যুক্তরাষ্ট্রের মাধ্যমে আর্থিক সুবিধা থেকে শুরু করে বিভিন্ন সুযোগ সুবিধা প্রদানের মাধ্যমে এসব সম্পর্ক গড়া হয়। ইতোমধ্যে মুসলিম বিশ্বের অনেক দেশই ইসরায়েলের সাথে স্বাভাবিক সম্পর্কে ফিরেছে। ইসরায়েলের নজর এবার বাংলাদেশে। যদিও বাংলাদেশ সরকার ইসরায়েলের সাথে সম্পর্ক গড়ায় আগ্রহী নয় বলে জানিয়ে দিয়েছে।
বাংলাদেশ পৃথিবীর একমাত্র রাষ্ট্র যেটি ইসরায়েলের সাথে সকল প্রকার প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ বাণিজ্যের উপর নিষেধাজ্ঞা জারি করেছে। বাংলাদেশ ইসরায়েলকে নৈতিক রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকার করে না এবং বাংলাদেশী নাগরিকদের ইসরায়েলে ভ্রমনে সরকারী নিষেধাজ্ঞা রয়েছে। বাংলাদেশের পাসপোর্ট ইসরায়েল ব্যতিত বিশ্বের সকল দেশ ভ্রমনের জন্য বৈধ।
১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর শুরুর দিকে যে কয়েকটি দেশ বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেয়ার প্রস্তাব করেছিল, তারমধ্যে ছিল ইসরায়েল। ১৯৭২ সালের ৪ঠা ফেব্রুয়ারি ইসরায়েল বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেয়ার প্রস্তাব করেছিল। তখন স্বাধীন বাংলাদেশের শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বাধীন সরকার লিখিতভাবে ইসরায়েলের স্বীকৃতি প্রত্যাখ্যান করেছিল। সেই অবস্থানের পিছনে মূল বিষয় ছিল ফিলিস্তিনিদের স্বাধীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশের সমর্থন। ৫০ বছর পরেও ইসরায়েল প্রশ্নে বাংলাদেশের সেই অবস্থানে কোন পরিবর্তন আসেনি।
মুসলিম বিশ্বের অধিকাংশ দেশ দশকের পর দশক ধরে ইসরায়েলকে বয়কট করে আসছে। এ ব্যাপারে তাদের অবস্থান হলো ফিলিস্তিন রাষ্ট্র গঠন ছাড়া ইসরায়েলের সঙ্গে কোনো সম্পর্ক নয়। কিন্তু কিছু আরব দেশ সেই নীতি থেকে হঠাৎ করে সরে এল। তারা চিরশত্রু দেশটির সঙ্গে সম্পর্ক গড়ে তুলছে।
সম্প্রতি পাকিস্তানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী শাহ মাহমুদ কোরেশির আরব আমিরাত সফরের পর থেকেই গুঞ্জন ছিল, ইসলামাবাদ গোপনে ইসরায়েলকে কোনও বার্তা পাঠিয়েছে। তবে পাকিস্তানি পররাষ্ট্রমন্ত্রী এক ভিডিওবার্তায় তা অস্বীকার করেন। তবে বিষেষজ্ঞরা মনে করছেন, ইসরায়েলের সাথে সম্পর্ক গড়ার বিষয়ে পাকিস্তান নমনীয় অবস্থানে আছে। ভারত-পাকিস্তান দ্বন্দ্বের এই চরমে যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যস্থতায় ইসরায়েলের সঙ্গে সম্পর্ক স্বাভাবিক করার পাকিস্তানের এই উদ্যোগ পাকিস্তানের রাজনৈতিক কৌশল।
এর আগে চলতি বছরের আগস্টে ইসরায়েল ও সংযুক্ত আরব আমিরাতের মধ্য ঐতিহাসিক চুক্তি হয়। এই চুক্তির ঘোষণার পর পরই ইসরায়েল–আমিরাতের মধ্যে টেলিফোন যোগাযোগ চালু হয়। চুক্তি অনুযায়ী ইসরায়েল দখলকৃত পশ্চিম তীরের ফিলিস্তিন ভূখণ্ডে আর ইহুদি বসতি সম্প্রসারণ করবে না। বিনিময়ে আরব আমিরাত ইসরায়েলের সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপন করবে। ইসরায়েলের সঙ্গে যেসব আরব দেশের অতীতে যুদ্ধ হয়েছিল, তাদের প্রায় সবাই এই চুক্তিকে স্বাগত জানিয়েছে। আবার অনেক মুসলিম দেশ চুক্তির বিরোধিতা করে এটাকে ফিলিস্তিনের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা বলে আখ্যা দিয়েছে।
এই বছরেই মুসলিম বিশ্বের আরেকটি দেশ মরক্কো ইসরায়েলের সাথে সম্পর্ক স্বাভাবিক করার ঘোষণা দেয়। চুক্তির বিনিময়ে বিতর্কিত পশ্চিম সাহারা নিয়ে নিজেদের দাবির স্বীকৃতি পাচ্ছে মরক্কো। এক দশক ধরে ওই অঞ্চলে আলজেরিয়া সমর্থিত পোলিসারিও ফ্রন্টের সঙ্গে লড়াই করে আসছে দেশটি।
আরব দেশগুলোর সংগঠন আরব লীগের সদস্য রাষ্ট্রগুলোর মধ্যে সুদান তৃতীয় দেশ, যে ইসরায়েলের সঙ্গে স্বাভাবিক সম্পর্ক স্থাপন করেছে। এর ফলে সুদানে মার্কিন সাহায্য এবং বিনিয়োগের পথ খুলে যায়। চতুর্থ আরব দেশ হিসেবে বাহরাইনও আনুষ্ঠানিকভাবে ইসরায়েলের সাথে কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপন করে।
ইসরায়েলের সঙ্গে মিশর ১৯৮৯ সালে, জর্ডান ১৯৯৪ সালে শান্তিচুক্তি স্বাক্ষর করেছে। আফ্রিকার আরব লিগ সদস্য মৌরিতানিয়া ২০০৯ সালে ইসরায়েলকে স্বীকৃতি দিলেও ১০ বছর পর তা বাতিল করে। আরব দেশগুলোর পক্ষ থেকে ইসরায়েলের সঙ্গে সম্পর্ক স্বাভাবিকীকরণের নিন্দা জানিয়ে আসছে ফিলিস্তিন।
যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যস্থতায় ইসরায়েলের সঙ্গে সম্পর্ক গড়ার আলোচনায় নাম এসেছে ইন্দোনেশিয়ারও। ইসরায়েলিদের সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপনের জন্য তাদের শত কোটি ডলারের লোভও দেখাচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র। তবে গত সপ্তাহে বিশ্বের বৃহত্তম মুসলিম জনগোষ্ঠীর দেশটি জানিয়েছে, ফিলিস্তিনিদের দাবি পূরণ না হওয়া পর্যন্ত তারা ইসরায়েলকে স্বীকৃতি দেবে না। একই নীতি অনুসরণের ইঙ্গিত দিয়েছে এশিয়ার আরেক মুসলিম দেশ মালয়েশিয়া। ওমান যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যস্থতায় কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপনের প্রশংসা করলেও ইসরায়েলি বন্ধনের বিষয়ে এখনও সরাসরি কোনও মন্তব্য করেনি।
বিভিন্ন গণমাধ্যমে খবর প্রকাশ হয়েছে যে, তিউনিশিয়া সরকার ইসরাইলের সঙ্গে সম্পর্ক প্রতিষ্ঠার জন্য আগ্রহী হয়ে উঠেছে। এসব খবর নাকচ করে তিউনিশিয়ার পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে বলা হয়েছে, তিউনিস যে নীতি অনুসরণ করে এসব ভিত্তিহীন খবর তার সাথে সাংঘর্ষিক। তিউনিস সরকার মনে করে- ফিলিস্তিনিদের আত্মনিয়ন্ত্রণ ও স্বাধীন রাষ্ট্র গঠনের অধিকার রয়েছে। ফিলিস্তিন ইস্যুতে তার অবস্থান আগের মতোই আছে এবং ইহুদিবাদী ইসরাইলকে স্বীকৃতি দেবে না তিউনিস। তারা মরক্কোর পথ অনুসরণ করবে না। বিবৃতিতে পরিষ্কার করে বলা হয়েছে, আন্তর্জাতিক অঙ্গনে যে সমস্ত পরিবর্তন হচ্ছে তার কারণে ফিলিস্তিনিদের ন্যায্য অধিকারের ব্যাপারে তিউনিশিয়ার অনুসৃত নীতিতে কোনো পরিবর্তন আসবে না।
জানা যায়, আগামী জানুয়ারিতে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ক্ষমতা ছাড়ার আগে আরও দু’টি মুসলিম দেশের সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপন হবে বলে দাবি করেছেন এক ইসরায়েলি মন্ত্রী। ইসরায়েলি মন্ত্রী বাংলাদেশের সাথে সম্পর্ক স্বাভাবিক করার ইঙ্গিত দিয়েছেন। বাংলাদেশের সাথে কূটনৈতিক-অর্থনৈতিকসহ সকল ধরণের সম্পর্ক গড়ার জন্য ইসরায়েল সবধরণের চেষ্টাই করে যাচ্ছে। তবে ইসরায়েলের সঙ্গে বাংলাদেশ এধরনের সম্পর্ক গড়তে মোটেও আগ্রহী নয় ।
এসডব্লিউ/কেএইচ/২২৩০
আপনার মতামত জানানঃ