ইরানে পুলিশি হেফাজতে কুর্দি তরুণী মাসা আমিনির মৃত্যুকে কেন্দ্র করে চলমান বিক্ষোভের মধ্যে গতকাল রোববার স্কুল থেকে শিক্ষার্থীদের নিরাপত্তা বাহিনী গ্রেপ্তার করেছে বলে অভিযোগ উঠেছে। বাহিনী যেসব ভ্যান নিয়ে স্কুলে ঢুকেছিল, সেগুলো ছিল লাইসেন্স প্লেটবিহীন।
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়া খবরে এসব তথ্য জানা গেছে। এদিকে গতকাল ইরানের কুর্দিস্তানে সব স্কুল ও উচ্চ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ করে দিয়েছে কর্তৃপক্ষ।
বেশ কিছু ফুটেজে দেখা গেছে, দেশটির অনেকগুলো শহরে বিক্ষোভ হচ্ছিল। মানবাধিকার গ্রুপগুলো বলেছে, নিরাপত্তা বাহিনীর ছোড়া কাঁদানে গ্যাসের শেল, ক্লাব এমনকি অনেক ক্ষেত্রে তাজা গোলাবারুদের মুখেও স্কুলের মেয়েরা ও বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা বিক্ষোভ চালিয়ে গেছে। তবে তেহরান তাজা গোলাবারুদ নিক্ষেপের বিষয়টি অস্বীকার করেছে।
স্কুল প্রাঙ্গণে ভ্যান প্রবেশের ছবি থাকা সত্ত্বেও দেশটির শিক্ষামন্ত্রী মোহাম্মদ মাহাদি কাজেম বলেন, স্কুল থেকে এসব শিক্ষার্থীকে বহিষ্কার করা হবে না। তবে তাদের অভিভাবকদের ডেকে বিষয়টি জানানো হবে।
গার্ডিয়ান দেশটির কয়েকজন শিক্ষার্থীদের পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগ করে উদ্বেগের বিষয়টি নিশ্চিত হয়েছে। রাসত শহরের ২৯ বছর বয়সী এক শিক্ষার্থী মাতিন বলেন, তার ১৬ বছরের বোন নাজনীনকে নিয়ে পরিবার খুবই উদ্বেগের মধ্যে আছে।
তিনি বলেন, ‘আজ সকাল মামা আমাদের ফোন করে নাজনীনকে স্কুল থেকে নিয়ে আসতে তাড়া দেন। এর পরপরই বাবা-মা ভয়ে স্কুল থেকে বোনকে গিয়ে নিয়ে আসেন। মামা বলেছিলেন পুলিশ স্কুলে হামলা চালাতে পারে।’
এ ছাড়া মাতিন বলেন, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে থাকা তাঁর বন্ধুরা তাঁকে সতর্ক করে বলেছিল বন্দর আব্বাস শহরে স্কুলশিক্ষার্থীদের গ্রেপ্তার করা হচ্ছে। শহরটি ইরানের দক্ষিণাঞ্চলীয় উপকূলে হোরমোজগান প্রদেশের বন্দর নগরী ও রাজধানী।
অনেক পরিবার তাদের সন্তানদের বিক্ষোভের ছবি ও ভিডিও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে বিশেষ করে টুইটারে শেয়ার না করতে আহ্বান জানিয়েছে।
তারা বলেন, ‘টুইটার ইরানের শাসকগোষ্ঠীর মূল কাঁপিয়ে দিয়েছে। তারা আর নিয়ন্ত্রণ করতে পারবে না। আমরা নাজনীন এবং তার বন্ধুদের ছবিতে থাকা তাদের মুখ ঝাপসা করে দিতে সতর্ক করে দিয়েছি। একজন কিশোর-কিশোরীকে এতটুকুই বলা যায়।’
এরই মধ্যে ইরানের প্রেসিডেন্ট ইব্রাহিম রাইসি বিক্ষোভ দমনকে কীভাবে আরও কার্যকর করা যায়, তা নিয়ে আলোচনা করতে নিরাপত্তা কর্মকর্তাদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেছেন।
এরপর ইরানের নিরাপত্তাবিষয়ক উপস্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সাইয়েদ মিরাহমাদি বলেছেন, ‘গতকাল, তেহরান এবং সানন্দাজ বাদ দিয়ে, দেশটি সম্পূর্ণ শান্তিপূর্ণ ছিল…এখন থেকে, যারা দাঙ্গায় গ্রেপ্তার হয়েছে, তারা বিচার না হওয়া পর্যন্ত কারাগারে থাকবে। তাদের দ্রুত বিচার করা হবে।’
ব্যবসায়িক গোষ্ঠীরা বলেছে, ইনস্টাগ্রামের মতো প্ল্যাটফর্মগুলোতে সরকার কর্তৃক বারবার ইন্টারনেট ব্ল্যাকআউট ব্যবসাকে মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করছে। এরই মধ্যে বিশেষ করে ছোট থেকে মাঝারি আকারের উদ্যোক্তাদের বিক্রি ৪০ থেকে ৭০ শতাংশ কমে গেছে।
অসলোভিত্তিক কুর্দিস মানবাধিকার সংগঠন হেনগাও দাবি করেছে, শনিবার নিরাপত্তা বাহিনী সানন্দাজ এবং সাক্কেজে বিক্ষোভকারীদের ওপর গুলি করেছে। এতে দুই বিক্ষোভকারী নিহত হয়েছে।
সংগঠনটি জানায়, বিক্ষোভের ঘটনায় এখন পর্যন্ত ১৯টি শিশু হত্যার শিকার হয়েছে।বসংগঠনটি জানায়, কেরমানশাহ, বুকান এবং ফারদিসের পাশাপাশি সানন্দাজ এবং সাক্কেজে রাত পর্যন্ত সংঘর্ষ অব্যাহত ছিল।
তাভসির১৫০০ নামের টুইটার অ্যাকাউন্ট, যা বিক্ষোভের ভিডিও পাঠায় এবং যার ব্যাপক ফলোয়ার রয়েছে, সেই অ্যাকাউন্ট থেকে জানানো হয় সানন্দাজ এবং সাক্কেজে বিক্ষোভকারীদের ওপর গুলি চালানো হয়।
হেনগাওয়ের শেয়ার করা ভিডিওতে দেখা গেছে, মাসার জন্মস্থান কুর্দিস্তানের সাক্কেজে চলমান বিক্ষোভে নারী ও মেয়েরা ‘নারী, জীবন, স্বাধীনতা’ বলে স্লোগান দিচ্ছিল।
নরওয়েভিত্তিক ইরান হিউম্যান রাইটস গ্রুপ জানায়, এই বিক্ষোভে এখন পর্যন্ত ১৯ শিশুসহ অন্তত ১৮৫ জন নিহত হয়েছে। তবে ইরানের সরকারি কর্মকর্তারা দাবি করেছেন যে পশ্চিমা-সমর্থিত মিডিয়াগুলো বিক্ষিপ্ত সমাবেশগুলোর মিথ্যা চিত্র তুলে ধরছে।
ইরান সরকারের পক্ষ থেকে এই বিক্ষোভের পেছনে তাদের চিরশত্রু যুক্তরাষ্ট্র এবং ইসরায়েলের হাত রয়েছে বলে অভিযোগ করা হয়েছে। বিক্ষোভে নিরাপত্তা বাহিনীর অন্তত ২০ সদস্য নিহত হয়েছেন বলেও তারা জানিয়েছে।
সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়া ছবি ও ভিডিওতে দেখা যায়, রোববার সকালেও ইরানের কয়েক ডজন নগরীতে বিক্ষোভ হয়েছে। যে বিক্ষোভে শত শত স্কুলছাত্রী এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা অংশ নিচ্ছেন।
বিক্ষোভকারীদের বিরুদ্ধে পুলিশ টিয়ার গ্যাসের শেল, লাঠি পেটা এমনকি কোথাও কোথাও সরাসরি গুলি চালানো হয়েছে বলে দাবি করেছে কয়েকটি মানবাধিকার সংস্থা।
সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়া শনিবারের একটি ভিডিওতে দেখা যায়, রাফসানজান নগরীতে এক ব্যক্তি দাঙ্গা পুলিশের সামনে তার স্ত্রীকে রক্ষা করার চেষ্টা করছেন আর চিৎকার করে বলছেন, ‘‘আমার স্ত্রীকে আঘাত করবেন না, সে অন্তঃসত্ত্বা।”
এসডব্লিউ/এসএস/২০৩২
আপনার মতামত জানানঃ