সাতক্ষীরা সীমান্তে ভারতীয় সীমান্ত রক্ষী বাহিনীর (বিএসএফ) গুলিতে এক বাংলাদেশি যুবক নিহত হয়েছে।
রোববার (০৯ অক্টোবর) ভোর রাত ৪টার দিকে সাতক্ষীরা সদর উপজেলার খৈতলা সীমান্তের বিপরীতে ভারতের কৈজুরী এলাকায় এই ঘটনা ঘটে। আহত অবস্থায় খুলনা সার্জিক্যাল হাসপাতালে নেওয়ার পর চিকিৎসকরা তাকে মৃত ঘোষণা করেন।
নিহত যুবকের নাম মো. হাসানুর রহমান (২৫)। সে সাতক্ষীরা সদর উপেজলার কুশখালী গ্রামের মো. হায়দার আলীর ছেলে।
হায়দার আলী জানান, রোববার ভোর রাত ৪টার দিকে সাতক্ষীরা সদর উপজেলার খৈতলা সীমান্তের ভারতের কৈজুরী এলাকায় এ ঘটনা ঘটে।
আহত অবস্থায় হাসাজ্জামানকে খুলনা সার্জিকাল হাসপাতালে নেওয়ার পর সকাল সাড়ে ৭টার দিকে চিকিৎসকরা তাকে মৃত ঘোষণা করেন।
তিনি বলেন, পার্সপোট না থাকায় তার ছেলে কয়েকদিন আগে অবৈধভাবে সীমান্ত পার হয়ে ভারতে এক আত্মীয়ের বাড়িতে বেড়াতে গিয়েছিলো। রোববার ভোর রাত ৩টার দিকে একইভাবে কয়েকজন সঙ্গীর সঙ্গে ভারতের কৈজুরী সীমান্ত পার হয়ে দেশে ফিরছিলো।
“পথে ভোর রাত ৪টার দিকে ভারতের কৈজুরী ক্যাম্পের টহল বিএসএফ সদস্যরা তাদের লক্ষ্য করে গুলি ছুঁড়লে হাসাজ্জামানের বুকে গুলি লাগে।”
এ সময় তার সঙ্গে থাকা লোকজন তাকে উদ্ধার করে সকাল সোয়া ৬টার দিকে সাতক্ষীরা সদর হাসপাতালে ভর্তি করায়। সেখানে তার শারীরিক অবস্থার অবনতি হলে কর্তব্যরত চিকিৎসকেরা উন্নত চিকিৎসার জন্য তাকে খুলনায় পাঠানোর পরামর্শ দেয় বলে জানান হায়দার।
নিহতের শ্বশুর সাইফুল ইসলাম জানান, বিএসএফের গুলিতে আহত হাসানুজ্জামানকে ভোর ৬টা ১৫ মিনিটের দিকে সাতক্ষীরার খৈতলার বাংলাদেশ ভারত সীমান্ত এলাকায় পড়ে থাকতে দেখে এলাকার লোকজন। পরে তারা হাসানুজ্জামানকে উদ্ধার করে সাতক্ষীরা সদর হাসপাতালে নিয়ে যায়।
তিনি বলেন, “হাসানুজ্জামানের সাতমাস বয়সী একটি সন্তান আছে। আমরা হত্যার বিচার চাই।”
হাসানুজ্জামানের সাতমাস বয়সী একটি সন্তান আছে। আমরা হত্যার বিচার চাই।
এ বিষয়ে সাতক্ষীরা বিজিবি ৩৩ ব্যাটালিয়ানের অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট কর্নেল মোহাম্মদ আল-মাহমুদ বলেন, “বিএসএফ প্রাথমিকভাবে ঘটনাটি অস্বীকার করেছে। আমরা পতাকা বৈঠকের জন্য তাদের আহ্বান করেছি। পতাকা বৈঠক হলে বিস্তারিত জানা যাবে।
ব্যবসায়ীকে গুলি করে হত্যা
এদিকে চুয়াডাঙ্গার দামুড়হুদা উপজেলার পারকৃষ্ণপুর-মদনা ইউনিয়নের ছোট বলদিয়া সীমান্তে গুলিতে মুনতাজ হোসেন (৪০) নামের এক বাংলাদেশি গরু ব্যবসায়ী নিহত হয়েছেন। ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনীর (বিএসএফ) গুলিতে মুনতাজের মৃত্যু হয়েছে বলে দাবি করেছেন স্থানীয় জনপ্রতিনিধিরা।
শনিবার দিবাগত মধ্যরাতে সীমান্তের ৮২ নম্বর প্রধান খুঁটির বিপরীতে নদীয়া জেলার বিজয়পুর বিএসএফ ক্যাম্প নিয়ন্ত্রিত এলাকায় এ ঘটনা ঘটে। মুনতাজ ছোট বলদিয়া গ্রামের স্কুলপাড়ার মো. নজরুল ইসলামের ছেলে। পেশায় তিনি গরু-মহিষ ব্যবসায়ী ছিলেন।
দামুড়হুদা উপজেলার পারকৃষ্ণপুর-মদনা ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) সদস্য হজরত আলী জাতীয় এক দৈনিককে জানান, মুনতাজ হোসেন শনিবার রাতে অবৈধভাবে সীমান্ত পার হয়ে ভারতের পশ্চিমবঙ্গের নদীয়া জেলার বিজয়পুর এলাকায় যান। সেখান থেকে গরু নিয়ে ফেরার সময় বিএসএফের সদস্যরা তাকে খুব কাছ থেকে গুলি করে হত্যা করেন। সকালে তা জানাজানি হলে তার স্বজনসহ গ্রামবাসী লাশের অপেক্ষায় সীমান্তে অবস্থান করছেন।
৬ বিজিবির অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট কর্নেল শাহ মোহাম্মদ ইশতিয়াক বলেন, ‘সীমান্তের ওপারে বাংলাদেশি নাগরিক মুনতাজ হোসেন নিহত হয়েছেন, এমন খবর আমিও শুনেছি। তবে নিহত ব্যক্তির পরিবার থেকে কেউ অভিযোগ করেননি। আবার বিএসএফের পক্ষ থেকে কর্মকর্তারা পরিষ্কারভাবে কিছুই জানাননি। পুরো ঘটনা জানতে প্রয়োজনীয় উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। জানতে পারলে আপনাদের জানানো হবে।’
যুবককে নির্যাতন
এদিকে ঠাকুরগাঁওয়ের রাণীশংকৈল ধর্মগড় সীমান্তে বাংলাদেশের অভ্যন্তর থেকে এক যুবককে তুলে নিয়ে বর্বর নির্যাতনের পর ছেড়ে দিয়েছে ভারতীয় সীমান্ত রক্ষাকারী বাহিনী (বিএসএফ)। গত বৃহস্পতিবার (০৬ অক্টোবর) নির্যাতনের শিকার ওই যুবককে রাণীশংকৈল স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স হাসপাতালে ভর্তি করেন তার স্বজনরা।
জানা যায়, নির্যাতনের শিকার ওই যুবকের নাম আল আমিন । তিনি জেলার রাণীশংকৈল উপজেলার ধর্মগড় ইউনিয়নের মারাধার গ্রামের আব্দুর রহিমের ছেলে।
গণমাধ্যমকে বিষয়টি নিশ্চিত করেন ধর্মগড় ইউপির ২ নম্বর ওর্য়াড সদস্য মো. আব্দুস মোকিম ।
তিনি বলেন, সীমান্তে বিএসএফের মারপিটের ঘটনায় আল আমিন নামের একজন আহত হয়েছেন বলে জানতে পেরেছি।
রাণীশংকৈল স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স হাসপাতালের কর্মরত চিকিৎসকরা জানান , নির্যাতনের শিকার ছেলেটির পুরো শরীরে প্রচুর আঘাত করা হয়েছে। এতে তার পুরো শরীরে কালো কালো দাগ হয়ে গেছে । তার চিকিৎসা চলছে। সুস্থ হতে বেশ সময় লাগবে।
আল আমিনের বাবা আব্দুর রহিম বলেন, ‘এই ঘটনাটি ঘটিয়েছে ভারতীয় শ্রীপুর ক্যাম্পের সদস্যরা। আল আমিনকে বিএসএফ ধরে নিয়ে যাওয়ার খবর পেয়ে তাৎক্ষণিক বিজিবির ধর্মগড় বিওপির সদস্যদের অবগত করা হয়।’
তিনি আরো বলেন, ‘বেলা দেড়টার দিকে আল আমিনকে মারপিট করার পর ছেড়ে দেয় বিএসএফ। পরে নদীর ধার থেকে তাকে উদ্ধার করে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়।’
স্বজন ও স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, বৃহস্পতিবার দুপুরবেলা আল আমিনসহ কয়েকজন ধর্মগড় সীমান্তের ৩৭২/৩ নম্বর সীমান্ত পিলারের বাংলাদেশ অভ্যন্তরের পাশ দিয়ে ঘাস কাটার জন্য প্রবেশ করে। এসময় ভারতের শ্রীপুর ক্যাম্পের টহলদল আল আমিনকে শুন্য রেখা থেকে বিএসএফ সদস্যরা আটক করে ভারতের ভেতর নিয়ে যায়। সেখানে বিএসএফ সদস্যরা বুট দিয়ে শরীরের বিভিন্ন অংশে খোচায় এবং বেধড়ক মারপিট করে। পরে বিএসএফ সদস্যরা গুরুতর অবস্থায় সীমান্তের কাছে ফেলে যায়।
এ বিষয়ে ৫০ বিজিবি ব্যাটালিয়নের ধর্মগড় ক্যাম্পের কোম্পানি কমান্ডার সুবেদার জমসেদ উদ্দীন ভূঁইয়া জানান, বিএসএফ নির্যাতনের খবরটি শুনেই তারা এলাকা পরিদর্শন করেন। ঘটনাটি তদন্ত করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
বন্ধু রাষ্ট্রের গালগল্পের ভীড়ে সীমান্ত হত্যা যেন স্বাভাবিক মৃত্যু হয়ে দাঁড়িয়েছে সীমান্তবর্তী মানুষদের জন্যে। বাংলাদেশ-ভারত দুই দেশের মধ্যে বেশ কয়েকবার সীমান্ত হত্যা বন্ধ আলোচনা এবং চুক্তি হয়েছে। দুই দেশের সীমান্তরক্ষী বাহিনীর শীর্ষ পর্যায় থেকে শুরু করে মন্ত্রী পর্যায়ের আলোচনাতেও কোনও সমাধান আসেনি, যার ফলে সীমান্ত হত্যা চলছেই।
নানা সময়ে বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি) ও ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনী বিএসএফের শীর্ষ পর্যায়ের সম্মেলনে সীমান্তে নন-লিথ্যাল উইপন (প্রাণঘাতী নয়) অস্ত্র ব্যবহারের সিদ্ধান্ত হয়। সীমান্ত হত্যা শূন্যের কোঠায় নামিয়ে আনার ব্যাপারে সদিচ্ছার কথাও বলেন নীতিনির্ধারকরা। এমনকি উভয় দেশের মধ্যে রাজনৈতিক পর্যায়ের আলোচনায়ও সীমান্ত হত্যা শূন্যে নামিয়ে আনতে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল ভারত; কিন্তু বাস্তবে তার প্রতিফলন খুব কমই চোখে পড়ছে। সম্প্রতি বাংলাদেশ-ভারত সীমান্তে হত্যার ঘটনা উদ্বেগ বাড়িয়ে তুলেছে।
সীমান্তে নিরস্ত্র বাংলাদেশি নাগরিকদের বেআইনিভাবে হত্যায় বাংলাদেশের উদ্বেগের বিষয়টি নয়াদিল্লিতে খুবই কম গুরুত্ব পেয়েছে। এখনও পর্যন্ত কোনো বাংলাদেশিকে হত্যার অভিযোগে অভিযুক্ত বিএসএফ সদস্যের বিবরণ বাংলাদেশকে দেয়নি ভারত। ভারত সরকারের কোনো সুনির্দিষ্ট অনুমোদন না থাকলে অন্যান্য নিরাপত্তা বাহিনীর পাশাপাশি বিএসএফকেও ফৌজদারি কার্যবিধির বাইরে রাখা হয়। বিএসএফ সদস্যদের এমন জবাবদিহিতার বাইরে থাকাই সীমান্ত হত্যার ঘটনাগুলোকে বাড়িয়ে দিচ্ছে।
ভারত সরকারের সবুজ সংকেত ছাড়া এভাবে সীমান্তে হত্যাকাণ্ড বেড়ে যাওয়ার কথা নয় বলে মনে করছেন আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশ্লেষকরা। ভারত সরকার যেহেতু বাংলাদেশকে কৌশলগত বন্ধু হিসেবে তুলে ধরে, সেক্ষেত্রে সীমান্তে হত্যার নির্দেশ কে দিচ্ছে, কিংবা সেই হত্যা বন্ধে কার্যকর পদক্ষেপ নিতে কে ভারত সরকারকে বাধা দিচ্ছে বাংলাদেশকে এটা খুঁজে বের করতে হবে বলে মনে করছেন তারা।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, কেবল রাজনৈতিক ইচ্ছাশক্তিই সীমান্তে হত্যার সংখ্যা হ্রাস করতে পারে। গোটা দেশের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশ্লেষকরা এ প্রশ্নে একমত যে, কেবল ভারতের রাজনৈতিক নেতৃত্বকে বাংলাদেশের সরকার বাধ্য করতে পারলেই সীমান্ত হত্যা বন্ধ করা সম্ভব হতে পারে।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১২৪৪
আপনার মতামত জানানঃ