মানবাধিকার সংগঠনগুলো গত কয়েক বছর ধরে গুম-খুন সহ নানা অভিযোগ তুলে ধরছিলো র্যাবের বিরুদ্ধে। মানবাধিকার লঙ্ঘনের সঙ্গে যুক্ত থাকার পরেও নিরাপত্তা বাহিনীর কমান্ডারদের পদোন্নতিসহ নানাভাবে পুরস্কৃত করছে বাংলাদেশ সরকার।
বুধবার(০৫ আগস্ট) মানবাধিকার সংস্থা হিউম্যান রাইটস ওয়াচের নিজস্ব ওয়েবসাইটে প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে এ কথা বলা হয়।
এতে সংস্থাটির দক্ষিণ এশিয়া পরিচালক মীনাক্ষী গাঙ্গুলি লিখেছেন, জোরপূর্বক গুম, বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড এবং নির্যাতনসহ নানাভাবে মানবাধিকার লঙ্ঘনের সঙ্গে যুক্ত এসব কর্মকর্তারা। কিন্তু তাদের অপরাধের জন্য জবাবদিহিতা নিশ্চিত না করে উল্টো তাদের পুরস্কৃত করা হচ্ছে।
হিউম্যান রাইটস ওয়াচ বলেছে, গত ৩০শে সেপ্টেম্বর পুলিশের মহাপরিদর্শক হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করেছেন চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুন। এর আগে তিনি র্যাবের মহাপরিচালকের দায়িত্বে ছিলেন। সেসময় র্যাবের বিরুদ্ধে মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগ তুলে তার উপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছিল যুক্তরাষ্ট্র। সে ঘটনার এক বছরেরও কম সময়ের মধ্যে তাকে পুলিশের মহাপরিদর্শক হিসেবে নিয়োগ দেয়া হয়েছে।
এদিকে, এতদিন এ দায়িত্বে থাকা ড. বেনজীর আহমেদের বিরুদ্ধেও একই অভিযোগে নিষেধাজ্ঞা দেয় যুক্তরাষ্ট্র। হিউম্যান রাইটস ওয়াচের রিপোর্টে জানানো হয়েছে, তিনি র্যাবের মহাপরিচালক থাকা অবস্থায় তার অধীনে থাকা কর্মকর্তারা মোট ১৩৬ বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড এবং ১০টি গুমের সঙ্গে যুক্ত ছিল বলে অভিযোগ রয়েছে। এ জন্য বেনজীর আহমেদের বিরুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্র সফরেও নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়েছিল। কিন্তু এই নিষেধাজ্ঞা এড়িয়ে বাংলাদেশ সরকার নিউ ইয়র্কে জাতিসংঘের একটি সম্মেলনে পাঠানো প্রতিনিধি দলের সদস্য করে তাকে।
র্যাবের ‘গুরুতর মানবাধিকার লঙ্ঘনের’ ঘটনায় এ বাহিনীর সাবেক প্রধান, বর্তমান পুলিশ মহাপরিদর্শক বেনজীর আহমেদসহ সাত কর্মকর্তার ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে যুক্তরাষ্ট্র সরকার। র্যাব ছাড়াও চীন, মায়ানমার ও উত্তর কোরিয়ার গুরত্বপূর্ণ ব্যক্তিবর্গ এবং কিছু সংস্থার ওপর মানবাধিকার লঙ্ঘন সম্পর্কিত নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র।
ইউএস ডিপার্টমেন্ট অফ ট্রেজারি থেকে জারি করা এক প্রেস বিবৃতিতে ‘মানবাধিকারের চরম লঙ্ঘনে’ জড়িত থাকার অভিযোগে র্যাবের সাবেক মহাপরিচালক ও বাংলাদেশ পুলিশের বর্তমান মহাপরিদর্শক (আইজিপি) বেনজীর আহমেদের ওপর ভিসা নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়।
এদিকে যুক্তরাষ্ট্র ও জাতিসংঘের তরফ থেকে সম্প্রতি র্যাবকে সংস্কারের আহ্বান জানানো হয়েছে।
এ বিষয়ে আবদুল্লাহ আল-মামুনের কাছে প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেছিলেন, আমরা এমন কিছু করছি না যে জন্য আমাদের র্যাবকে সংস্কার করতে হবে। তাই সংস্কারের কোনো প্রশ্নই নেই।
এ বছরের প্রথমে আবদুল্লাহ আল-মামুনসহ নিষেধাজ্ঞার অধীনে থাকা র্যাবের আরেক কর্মকর্তা এডিজি কর্নেল খান মোহাম্মদ আজাদকে তাদের সাহসিকতা ও সেবার জন্য পুরস্কৃত করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
এমন পদক্ষেপ বাংলাদেশের নিরাপত্তা বাহিনীগুলোর কাছে এই বার্তা দেয় যে, সরকার শুধু তাদের বিরুদ্ধে থাকা অপব্যবহারের অভিযোগগুলো উপেক্ষাই করবে না, বরং তাদেরকে আরও পুরস্কৃত করবে।
হিউম্যান রাইটস ওয়াচ তাদের বিবৃতিতে বলেছে, এমন পদক্ষেপ বাংলাদেশের নিরাপত্তা বাহিনীগুলোর কাছে এই বার্তা দেয় যে, সরকার শুধু তাদের বিরুদ্ধে থাকা অপব্যবহারের অভিযোগগুলো উপেক্ষাই করবে না, বরং তাদেরকে আরও পুরস্কৃত করবে।
এর আগে মানবাধিকার সংস্থা হিউম্যান রাইটস ওয়াচের ওয়েবসাইটে প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে বলা হয়, বাংলাদেশের বিশেষায়িত আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়নের (র্যাব) ওপর মার্কিন অর্থ দপ্তরের নিষেধাজ্ঞার প্রতিক্রিয়ায় বাহিনীটি ভুক্তভোগীদের স্বজন, মানবাধিকারকর্মী, তাদের পরিবার ও মানবাধিকার সংস্থার বিরুদ্ধে প্রতিশোধমূলক আচরণ করছে বলে অভিযোগ করেছে আন্তর্জাতিক ১২টি সংস্থা।
নির্ভরযোগ্য সূত্রের বরাত দিয়ে হিউম্যান রাইটস ওয়াচ জানিয়েছে, মার্কিন নিষেধাজ্ঞার পর থেকে র্যাব এবং ন্যাশনাল সিকিউরিটি ইন্টেলিজেন্স (এনএসআই) ভুক্তভোগী এবং মানবাধিকারকর্মীদের হুমকিমূলক ফোন কল করছে, তাদের স্থানীয় অফিসে ডেকে পাঠাচ্ছে এবং মধ্যরাতে তাদের কর্মস্থল ও বাড়িতে হানা দিচ্ছে।
বাংলাদেশের মানবাধিকার সংগঠনগুলো গত কয়েক বছর ধরে গুম-খুন সহ নানা অভিযোগ তুলে ধরছিলো র্যাবের বিরুদ্ধে। কক্সবাজারে কাউন্সিলর একরাম হত্যাকাণ্ডের মতো ঘটনা ফাঁস হওয়ার পর তা নিয়ে আলোচনার ঝড় উঠেছিল আন্তর্জাতিক মহলে। তারও আগে নারায়ণগঞ্জে সাতজনকে অপহরণের পর হত্যার ঘটনায় র্যাবের ১৬ জনের মৃত্যুদণ্ডের আদেশ দেয় আদালত যা এখনো উচ্চ আদালতে বিচারাধীন আছে।
বিশেষজ্ঞরা বলেন, বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড হচ্ছে বিচারিক প্রক্রিয়াকে পাশ কাটিয়ে সংঘটিত হত্যাকাণ্ড। সংবিধান অনুযায়ী প্রত্যেক অপরাধীর আত্মপক্ষ সমর্থনের অধিকার আছে। অর্থাৎ, একজন ব্যক্তি কোনো অপরাধ করলে সে তার পক্ষে আইনজীবী নিয়োগ করতে পারবে, সাক্ষ্য উপস্থাপন করতে পারবে। এটি তার মানবাধিকারের অন্তর্ভুক্ত। কিন্তু বাংলাদেশে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের যে সংস্কৃতি গড়ে উঠেছে, সেখানে বিচারের আগেই আইনের তোয়াক্কা না করে অভিযুক্তকে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হাতে প্রাণ দিতে হচ্ছে।
তারা বলেন, বিগত এক দশকে দেশ এমন অবস্থার সাক্ষী যেখান থেকে গণতন্ত্র ক্রমেই সরে গেছে। এমন এক শাসনব্যবস্থার সাক্ষী হয়েছে, যা গণতন্ত্রের যেকোনো রূপ থেকেই অনেক দূরে। ক্ষমতাসীনরা বলপ্রয়োগের ওপরেই আরও নির্ভরশীল হয়ে উঠেছে। দেশ শাসনে এখন বলপ্রয়োগের বাহিনীগুলোই প্রাধান্য পাচ্ছে। বিগত দুই নির্বাচনের মাধ্যমে শাসনব্যবস্থায় জবাবদিহির বিষয়টি অনেক দূরে চলে গেছে। যদিও এগুলোকে ‘নির্বাচন’ বলা যায় কি না, তাও একটি প্রশ্ন।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৯৩৫
আপনার মতামত জানানঃ