জাভেরিয়া আফজাল
যদি কেউ পাকিস্তানের বন্যা, তাপপ্রবাহ এবং খরার চক্রের বাস্তবতা সম্পর্কে জানেন, তবে তারা হলেন ‘বয়স্ক’ প্রজন্ম। তারা কয়েক দশক ধরে জলবায়ুর ওঠানামা এবং পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে বসবাস করছেন। তবে এ বছর ব্যাপারগুলো সম্পূর্ণ ভিন্নস্তরে নিয়ে গেছে।
এপ্রিলে পাকিস্তানের কিছু অংশে রেকর্ড তাপমাত্রা ছিল ৪৯ সেলসিয়াসের কাছাকাছি। যার দরূণ দেশের ৩০ শতাংশ লোক প্রচণ্ড গরমে হিমশিম খেয়েছে, ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।
এটি বিশেষত বয়স্ক ব্যক্তিদের জন্য চ্যালেঞ্জিং, যারা শরীরের তাপমাত্রা সহজে নিয়ন্ত্রণ করতে পারেন না। বিশেষ করে যদি তারা ওষুধ সেবন করেন। বয়স হওয়া সত্ত্বেও যারা দিনের বেশিরভাগ সময় বাইরে শ্রমিক, দিনমজুর এবং রাস্তার বিক্রেতা হিসাবে কাজ করেন, তাদের জন্য আরও খারাপ অবস্থা।
বর্ষায় ক্রমবর্ধমান তাপ থেকে স্বল্পকালীন স্বস্তি ছিল। কারণ বৃষ্টির তীব্রতা এবং মাত্রা শীঘ্রই বিপর্যয়কর হয়ে ওঠে। সিন্ধু এবং বেলুচিস্তান, যেখানে হেল্পএজ বয়স্ক ব্যক্তিদের এবং তাদের সম্প্রদায়কে সমর্থন করার জন্য সাড়া দিচ্ছে, শুধুমাত্র জুলাই মাসের প্রথম দুই সপ্তাহে গড়ের চেয়ে পাঁচগুণ বেশি বৃষ্টিপাত হয়েছে। পরিবারগুলো আতঙ্কে পালিয়ে গেছে। অনেক বয়স্ক লোক তাদের সাথে থাকার জন্য সংগ্রাম করছে।
সিন্ধুর শহীদ বেনজিরাবাদ জেলার ৭৫ বছর বয়সী মোহাম্মদ সালিহ তার পরিবারের সাথে বন্যার আগ্রাসন থেকে পালিয়ে যান। কিন্তু বার্ধ্যক্যের কারণে তিনি ভালোভাবে নড়াচড়া করতে পারেন না। তারা যখন আশ্রয়কেন্দ্র হিসাবে মনোনীত এক স্কুলে পৌঁছেছিল, তখন তা কানায় কানায় পূর্ণ ছিল। পরিবারটি এখন খোলা আকাশের নিচে বসবাস করছে।
সালিহর মতো অনেক বয়স্ক মানুষ মনে করেন যে তারা তাদের পরিবারের বোঝা। এমন হাজার হাজারজন রেখেই পরিবারগুলো চলে গিয়েছিল। আমার সহকর্মী আমাকে সম্প্রতি রেলওয়ে স্টেশনে একজন ব্যক্তির সাথে একটি দুঃখজনক সাক্ষাতের কথা বলেছিলেন। লোকটি হারিয়ে গেছে। বলেছিল যে, সে তার পরিবারকে পালাতে সাহায্য করেছিল কিন্তু এখন তাদের খুঁজে পাচ্ছে না। তিনি তার সমস্ত অর্থ, বাড়ি, ফসল, পশু এবং খাদ্য হারিয়েছেন।
পাবলিক সেক্টরের কর্মজীবীদের বাইরে, পাকিস্তানে মাত্র ২.৩ শতাংশ বয়স্ক ব্যক্তি পেনশন পান। তাই তারা যদি কাজ করতে না পারেন, তাহলে তারা বেঁচে থাকার জন্য সম্পূর্ণভাবে সাহায্যের ওপর বা তাদের পরিবারের ওপর নির্ভরশীল।
বেলুচিস্তানের ঝাল মাগসি জেলার এক গ্রামে বন্যা আসার সময় ৭০ বছর বয়সী মালুকা খাতুন তার স্বামীর সাথে গ্রাম ছাড়েন। তারা তাদের সমস্ত গবাদিপশু এবং ফসল হারিয়েছেন। এখন ছাদ বা দেয়াল ছাড়াই তাদের বাড়ির খোলের বাইরে একটি তাঁবুতে বসবাস করতে ফিরে এসেছেন।
তিনি বলেন, “বন্যার আগে আমরা কৃষিকাজ করতাম এবং ভালোভাবেই জীবিকা নির্বাহ করতাম। কিন্তু এখন আমরা আমাদের জীবন ছাড়া সবকিছু হারিয়েছি। আমরা হতাশাগ্রস্ত এবং আমাদের ক্ষতি সম্পর্কে সত্যিই চিন্তিত।”
মালুকা দূষিত পানির কারণে হেপাটাইটিস রোগে সংক্রামিত এবং তার প্রয়োজনীয় ওষুধও নেই। তার একাই যে এরকম তা নয়। এমন হাজার হাজার বয়স্ক লোক দীর্ঘস্থায়ী রোগের সাথে বসবাস করছেন। যেমন হৃদরোগ, ডায়াবেটিস, শ্বাসকষ্টের সমস্যা এবং একইভাবে তাদের ওষুধ পানিতে ভেসে যাওয়ার পরে বেঁচে থাকার জন্য লড়াই করছেন। তারা নতুন করেও ওষুধ সংগ্রহ করতে পারছেন না, কারণ হাসপাতাল এবং স্বাস্থ্য কেন্দ্রগুলোতেও সবকিছু ভেসে গেছে।
বন্যার আগে আমরা কৃষিকাজ করতাম এবং ভালোভাবেই জীবিকা নির্বাহ করতাম। কিন্তু এখন আমরা আমাদের জীবন ছাড়া সবকিছু হারিয়েছি। আমরা হতাশাগ্রস্ত এবং আমাদের ক্ষতি সম্পর্কে সত্যিই চিন্তিত।
এদিকে, অনেক বয়স্ক লোক যারা দীর্ঘ সময় ধরে পানিতে দাঁড়িয়ে থাকতে বাধ্য হয়েছিলেন, তাদের এখন হাঁপানিসহ শ্বাসকষ্টের সমস্যা হচ্ছে। যদিও তারা আগে এই পরিস্থিতিতে ভোগেননি।
বন্যায় বয়স্করা কেন ভুগছে?
বেশির ভাগ মানবিক সংস্থা বয়সকে সাহায্যের কারণ হিসাবে নেয় না। তারা মূল্যায়ন করে কার বেশি প্রয়োজন। এটি সাহায্য প্রদানকারীদের বয়স্ক লোকদের চাহিদা সম্পর্কে বোঝার অভাব।
জরুরী পরিস্থিতিতে প্রদান করা সাহায্য প্রায়ই অনুপযুক্ত বা ভুল উপায়ে বিতরণ করা হয়। বয়স্ক মানুষের জন্য হজম করা কঠিন এমন খাবারও মাঝে মাঝে বিতরণ করা হয়। খাবার বিতরণের পয়েন্টে পৌঁছানোর জন্য মানুষকে প্রায়ই যাতায়াত করতে হয়। কিছু ক্ষেত্রে এমনকি প্লেন থেকেও খাবার ছুঁড়ে মারা হয়। যা বয়স্ক ব্যক্তিদের জন্য খুবই কঠিন ব্যাপার। বিশেষ করে যারা শারীরিকভাবে অক্ষম।
মানবিক ত্রাণ সংস্থাগুলোর একই পদ্ধতি অবলম্বন করা উচিত নয়। তাদের ক্ষতিগ্রস্ত গ্রামগুলোতে যাওয়া উচিত, প্রয়োজনে লোকদের খুঁজে বের করা, তাদের নিবন্ধন করা এবং তারপরে সাহায্য সরবরাহ করা উচিত। এতে বয়স্ক লোকদের সাহায্য নিশ্চিত হয়, একইসাথে সম্মানও দেখানো হয়।
এছাড়াও, সুরাহা করার আরও অন্যান্য সমস্যাও আছে। আশ্রয়কেন্দ্রগুলো প্রায়শই বিদ্যুৎবিহীন থাকে। যার মানে যাদের দেখতে অসুবিধা হয় তারা অন্ধকারে লড়াই করবে। HelpAge-এ, আমরা সবসময় এ ধরনের সমস্যা কাটিয়ে ওঠার জন্য বিতরণ করা সাহায্যে একটি টর্চলাইট রাখি।
তারপর ওষুধ আছে। ভ্রাম্যমাণ স্বাস্থ্য দলগুলো প্রায়ই দুর্যোগে সৃষ্ট রোগ যেমন ডায়রিয়ার জন্য ওষুধ সরবরাহ করে থাকে।তারা দীর্ঘমেয়াদী রোগের জন্য খুব কমই প্রস্তুত থাকে।
এর কাছাকাছি একটি উপায় হল নগদ অর্থ প্রদান করা। যাতে বয়স্করা তাদের প্রয়োজনীয় ওষুধ কিনে নিতে পারে। যদি পাওয়া যায় আরকি। নগদ অর্থ গুরুত্বপূর্ণ, কারণ এতে নিজস্ব পছন্দমতো প্রয়োজনীয় জিনিস কিনতে পারে। উদাহরণস্বরূপ বলা যেতে পারে, তারা তাদের প্যাডও কিনতে হতে পারে। অথবা তাদের শুধু দুধ খাওয়ার জন্য একটি ছাগলের প্রয়োজন হতে পারে।
জরুরী অবস্থার সময়, বয়স্ক ব্যক্তিরা প্রায়ই গুরুত্বপূর্ণ সহায়ক ডিভাইসগুলো হারিয়ে ফেলেন। যেমন চশমা, হাঁটার লাঠি এবং হুইলচেয়ার। এগুলো তাদের সুস্থতার জন্য অপরিহার্য। সাহায্য সংস্থাগুলোকে আশ্রয়কেন্দ্র এবং অন্যান্য সুবিধাগুলোতে তাদের প্রাপ্যতা নিশ্চিত করতে হবে।
এবং তাদের কেবলি যে শারীরিক সাহায্য প্রয়োজন তা নয়। অনেক বয়স্ক মানুষ সারা জীবন তাদের বাড়িতে বসবাস করেছেন এবং যখন চলে যেতে বাধ্য হন তখন তারা মানসিকভাবে আঘাত পান। তাদের মানসিক সহায়তাও প্রয়োজন।
জলবায়ু-জনিত আরও ভয়াবহ বিপর্যয় আসছে। বয়স্ক লোকদের, ভূগোল, বন্যার পথ, বৃষ্টির ধরণ, কৃষি এবং গবাদি পশুর রোগ সম্বন্ধে সমৃদ্ধ ঐতিহাসিক এবং স্থানীয় জ্ঞান থেকে শেখার জন্য আমাদের এখনই কাজ করা উচিত
একই সময়ে, জাতীয় দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষ এবং মানবিক এনজিওগুলোকে অবশ্যই বয়স্ক ব্যক্তিদের তথ্য সংগ্রহ করতে হবে। যাতে আসন্ন দুর্যোগেও বয়স্কদের চাহিদা মোকাবেলার জন্য বয়স-উপযুক্ত সমাধানগুলো প্রয়োগ করতে পারে।
পাকিস্তানের সিনিয়ররা গত কয়েক মাসে নরক এবং খারাপের মধ্যে দিয়ে গেছে। তারাসহ বিশ্বের প্রবীণদের, যাদের এসব ভোগান্তির মধ্য দিয়ে যেতে হচ্ছে বা হবে, অবশ্যই রক্ষা করতে হবে।
জাভেরিয়া আফজাল, বিশ্বব্যাপী জলবায়ু পরিবর্তন উপদেষ্টা, হেল্পএজ ইন্টারন্যাশনাল
(কাতারভিত্তিক সংবাদমাধ্যম ‘আল-জাজিরা’ থেকে অনূদিত)
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৬১০
আপনার মতামত জানানঃ