জাতীয় গ্রিডে ত্রুটির কারণে রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন জেলায় বিদ্যুৎ সরবরাহ বিঘ্নিত হচ্ছে। মঙ্গলবার (৪ অক্টোবর) দুপুরের পর থেকে লোডশেডিং চলছে অনেক এলাকায়। কেউ কেউ এটাকে ব্লাক আউট হিসেবেও অভিহিত করছেন।
বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, আজ (মঙ্গলবার) দুপুর ২টা ৫ মিনিটে এ বিপর্যয় ঘটার ফলে ঢাকা, চট্টগ্রাম, সিলেট ও কুমিল্লার বড় অংশে বর্তমানে বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধ আছে। দুপুর ৩টা ১০ মিনিট পর্যন্ত সময়ে যমুনা নদীর পাড় থেকে টঙ্গী পর্যন্ত বিদ্যুৎ সরবরাহ স্বাভাবিক করা গেছে। বাকি অংশে কাজে চলছে।’
পাওয়ার গ্রিড কোম্পানি অব বাংলাদেশের (পিজিসিবি) তথ্য অনুযায়ী, জাতীয় গ্রিডের পূর্বাঞ্চলে (যমুনা নদীর এপার) বিদ্যুৎ বিপর্যয় দেখা দিয়েছে। এতে আজ বেলা ২টা ৫ মিনিটে একযোগে বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধ হয়ে গেছে। এরপর থেকে রাজধানী ঢাকা, চট্টগ্রাম, কুমিল্লা ও সিলেট অঞ্চলের বিস্তৃত এলাকায় বিদ্যুৎ নেই। কখন বিদ্যুৎ সরবরাহ শুরু হবে, তা নিশ্চিত করে বলতে পারছে না কেউ।
পাওয়ার গ্রিড কোম্পানি অব বাংলাদেশের নির্বাহী পরিচালক (অপারেশন্স অ্যান্ড মেইন্টেন্যান্স) মো. মাসুম আলম বকসী গণমাধ্যমকে বলেন, ‘আমরা এখনও জানি না কী হয়েছে। যত দ্রুত সম্ভব বিদ্যুৎ সরবরাহ স্বাভাবিক করতে চেষ্টা করছি। শুধু এটুকু বলতে পারি যে, দেশের বিভিন্ন এলাকায় এ মুহূর্তে বিদ্যুৎ নেই।’
ওদিকে, জাতীয় গ্রিডে ত্রুটির কারণে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আশুগঞ্জে বিদ্যুৎকেন্দ্রের সবকটি ইউনিটে উৎপাদন বন্ধ হয়ে গেছে। আজ দুপুর ২টা ৫ মিনিটে এ সমস্যা দেখা দেয়। এ কারণে ঢাকা, চট্টগ্রাম, কুমিল্লা, ময়মনসিংহ, সিলেট ও অন্যান্য পাওয়ার গ্রিড কোম্পানি অব বাংলাদেশের (পিজিসিবি) ট্রান্সমিশন-১ লাইন ‘ব্ল্যাক আউট’ হয়ে যায়।
আশুগঞ্জ বিদ্যুৎকেন্দ্রের ব্যবস্থাপনা পরিচালক প্রকৌশলী এম এম সাজ্জাদুর রহমান এসব তথ্য নিশ্চিত করেছেন। তিনি বলেন, ‘দুপুর ২টা ৫ মিনিটে ব্লাক আউটের কারণে ইউনিটগুলো বন্ধ হয়ে যায়। এতে আমাদের কোনো ত্রুটি ছিল না।’
সমস্যার সমাধান প্রসঙ্গে এক প্রশ্নে সাজ্জাদুর রহমান কখন বন্ধ ইউনিটগুলো চালু হবে, তা নির্দিষ্ট করে বলতে পারেননি। তবে, তাদের বিদ্যুৎকেন্দ্রের নিজস্ব প্রকৌশলীরা বন্ধ ইউনিটগুলো চালু করার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন বলে জানান তিনি।
জানা গেছে, বন্ধ হওয়া ইউনিটগুলো হলো ৪৫০ মেগাওয়াট ক্ষমতা সম্পন্ন নর্থ ইউনিট ও একই ক্ষমতা সম্পন্ন সাউথ ইউনিট, ২২৫ মেগাওয়াট ক্ষমতা সম্পন্ন কম্বাইন্ড সাইকেল পাওয়ার প্ল্যান্ট, ৫০ মেগাওয়াট ক্ষমতা সম্পন্ন গ্যাস ইঞ্জিন ইউনিট, ১৫০ মেগাওয়াট ক্ষমতা সম্পন্ন ৪নং ইউনিট এবং ১৫০ মেগাওয়াট ক্ষমতা সম্পন্ন ৫নং ইউনিট। এর ফলে জাতীয় গ্রিডে এক হাজার ৪৭৫ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ সরবরাহ হ্রাস পেয়েছে।
অপরদিকে, জাতীয় গ্রিডে বিদ্যুৎ বিপর্যয় ঘটার কারণে টেলিযোগাযোগ সেবায় বিঘ্ন ঘটার খবর পাওয়া গেছে। মুঠোফোনের ইন্টারনেট ও ক্ষুদে বার্তা পাঠাতে সমস্যা হচ্ছে বলে গ্রাহকেরা জানিয়েছেন। এ ছাড়া কল করতেও বেশি সময় লাগছে বলে জানা গেছে।
মোবাইল ফোন অপারেটরদের সংগঠন অ্যাসোসিয়েশন অব মোবাইল টেলিকম অপারেটরস অব বাংলাদেশের (এমটব) বলছে, বিদ্যুৎ বিপর্যয়ের কারণে দেশের বিভিন্ন স্থানে এমন সমস্যা হচ্ছে। সাময়িক সময়ের জন্য টেলিযোগাযোগ সেবা বিঘ্নিত হতে পারে। সাময়িক অসুবিধার জন্য গ্রাহকদের প্রতি এমটবের পক্ষ থেকে দুঃখ প্রকাশ করা হয়েছে সংগঠনটির পক্ষ থেকে।
টেলিযোগাযোগ নির্বিঘ্ন রাখতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে বেজ ট্রান্সিভার স্টেশন (বিটিএস)—যা মোবাইল টাওয়ার নামে পরিচিত। কোনো কারণে বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধ হয়ে গেলে জেনারেটর দিয়ে দুই থেকে পাঁচ ঘণ্টা বিটিএস চালু করা যায়। কিন্তু, দীর্ঘ সময় বিদ্যুৎ না থাকলে তখন জেনারেটর দিয়েও বিটিএসের কার্যক্রম স্বাভাবিক রাখা সম্ভব হয় না
পাওয়ার গ্রিড কোম্পানি অব বাংলাদেশ (পিজিসিবি) সূত্র জানিয়েছে, যথাসম্ভব দ্রুত বিদ্যুৎ সরবরাহ স্বাভাবিক করার সর্বোচ্চ চেষ্টা করা হচ্ছে ৷ পুরো পরিস্থিতি স্বাভাবিক হতে রাত পর্যন্ত সময় লাগতে পারে। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক পিজিসিবির এক কর্মকর্তা জানিয়েছেন, কাজ চলছে। তবে কতক্ষণ এমন পরিস্থিতি চলবে বলা যাচ্ছে না।
বাংলাদেশে সর্বশেষ ২০১৭ সালের ৩ মে আকস্মিক গ্রিড বিপর্যয়ের পর উত্তর ও দক্ষিণ-পশ্চিমের ৩২টি জেলা কয়েক ঘণ্টা ধরে বিদ্যুৎ বিচ্ছিন্ন ছিল।
তার আগে ২০১৪ সালের ১ নভেম্বর বড় ধরনের বিদ্যুৎ বিপর্যয়ের ঘটনা ঘটেছিল। তখন বিদ্যুত বিভাগের কর্মকর্তাদের উদ্ধৃত করে একাধিক রিপোর্টে বলা হয়, ভেড়ামারায় জাতীয় গ্রিডে বাংলাদেশ ও ভারতের বিদ্যুৎ সঞ্চালন লাইনে সংযোগস্থলে ওই ত্রুটি থেকেই বিভ্রাটের শুরু।
এদিকে জ্বালানি এবং বিদ্যুৎ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ বলেছেন, জাতীয় গ্রিডে কি কারণে এই বিপর্যয় তা জানার জন্য দু’টি তদন্ত কমিটি গঠন করা হচ্ছে।
শ্রীলঙ্কার পরিস্থিতি দেখে অনেকেই বাংলাদেশের ব্যাপারেও আশঙ্কা প্রকাশ করেছিলেন। কিন্তু সরকারের মন্ত্রীরা তার থোরাই কেয়ার করলেন। উলটো উন্নয়নের গীত গেয়ে দেশ ভাসালেন। আজ তারই ফল পেল বাংলাদেশ।
তিনি বলেন, এরমধ্যে ময়মনসিংহ অঞ্চলে এবং ঢাকার কিছু এলাকায় বিদ্যুৎ সরবরাহ চালু করা সম্ভব হয়েছে। অন্য এলাকায় সরবরাহ চালু করার জন্য চেষ্টা চলছে। তবে পুরোপুরি স্বাভাবিক হতে সময় লাগবে।
বিশ্লেষকরা বলছেন, গ্যাস উত্তোলনে যত বাধাই আসুক, দেশের উন্নয়নে সরকার যা করা দরকার তা-ই করবে বলে ঘোষণা দিয়েছিলেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। শেখ হাসিনার এই ঘোষণার পর এক যুগেরও বেশি সময় অতিক্রান্ত হয়েছে। কিন্তু তার সরকার গ্যাস উত্তোলনে কোনো অর্জন দেখাতে পারেনি। এমনকি সমুদ্রজয় নিয়ে বহু বড়াই করেছে, কিন্তু সমুদ্রের গ্যাস উত্তোলনেও নেই কোনো অগ্রগতি। উল্টো বিদেশ থেকে গ্যাস আমদানির পথে হেঁটে জ্বালানি খাতকে আমদানিনির্ভর করে তুলেছে। গ্যাস উত্তোলনে তাদের সামনে কোনো বাধাই ছিল না।
বরং বিশেষজ্ঞরা বারবার জোর দিয়ে বলেছেন, দেশীয় গ্যাস উত্তোলনের কাজ ত্বরান্বিত করতে। কিন্তু শেখ হাসিনা সরকার নিজেই গ্যাস উত্তোলনের পথে বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে। কারণ শেষ অবধি তারা মনে করেছে, গ্যাস উত্তোলন না করে জ্বালানি আমদানি করলে তা থেকে আয় রোজগারের সুবিধা বেশি। জ্বালানি খাতে শেখ হাসিনার সরকার দেশের উন্নয়ন নয় বরং নিজেদের লোকজনের পকেটের উন্নয়নকেই বরাবর অগ্রাধিকার দিয়েছেন এবং বিদ্যুৎ ও গ্যাসকে করে তুলেছেন ব্যয়বহুল।
তারা বলছেন, বিদ্যুৎ ও পানির ক্ষেত্রে আজো সংকটের কোনো সমাধান হয়নি। কৃত্রিম সংকটের অভিযোগ করে শেখ হাসিনা অন্যের কাঁধে দোষ চাপাতে চাইলেও বরং দীর্ঘ কাল পরিক্রমায় এটাই প্রমাণ হয়েছে যে, সরকারের নীতিগত অবস্থানের কারণেই বিদ্যুৎ ও পানির সংকট প্রলম্বিত হচ্ছে। ঢাকা শহরে ওয়াসার পানি পানের উপযোগী নয়, এ নিয়ে সরকারের কোনো ভ্রূক্ষেপও নেই। বিদ্যুৎ খাতকে স্বনির্ভর ও সাশ্রয়ী করার পথেও হাঁটেনি সরকার।
ফলে পানি ও বিদ্যুৎ খাতে দুর্নীতি আরো বেড়েছে। দুর্নীতিবাজদের শাস্তি দেয়ার তো কোনো নমুনাই নেই, বরং বছর বছর তাদের মেয়াদ বাড়িয়ে আরো দুর্নীতি চালানোর সুযোগ করে দিয়েছেন শেখ হাসিনা নিজেই। বিদ্যুৎ খাতের দুর্নীতি ঠেকাতে কেউ যেন আদালতে যেতে না পারে, সেজন্য প্রণয়ন করেছেন কুখ্যাত দায়মুক্তি আইন।
তারা আরও বলেন, শ্রীলঙ্কার পরিস্থিতি দেখে অনেকেই বাংলাদেশের ব্যাপারেও আশঙ্কা প্রকাশ করেছিলেন। কিন্তু সরকারের মন্ত্রীরা তার থোরাই কেয়ার করলেন। উলটো উন্নয়নের গীত গেয়ে দেশ ভাসালেন। আজ তারই ফল পেল বাংলাদেশ।
এসডব্লিউ/কেএইচ/২২০০
আপনার মতামত জানানঃ