পাকিস্তানের বেলুচিস্তান প্রদেশের স্বাধীনতার দাবি তুলে আলোচিত হন নারী অধিকারকর্মী করিমা বেলুচ। গত রোববার(২০ ডিসেম্বর) নিখোঁজের পর বিকেলে কানাডার টরন্টোতে তার রহস্যজনক মৃত্যু হয়। আর অভিযোগের আঙ্গুল তোলা হয়েছে পাকিস্তানের দিকে। বিশ্বের বিভিন্ন অঞ্চলের মানবাধিকার কর্মীরা জীবন বাঁচাতে নিজের দেশ ছেড়ে উন্নত সামাজিক নিরাপত্তা আছে এমন দেশগুলোতে রাজনৈতিক আশ্রয় নেওয়ার পরও জীবন হারাতে হচ্ছে। আশ্রয় দেওয়া পশ্চিমা দেশগুলোর সামাজিক ও রাষ্ট্রিয় নিরাপত্তা নিয়ে প্রশ্ন উঠছে। কানাডাতে করিমা বেলুচ এর মৃত্যুর পর ইউরোপসহ পশ্চিমা দেশগুলোতে আশ্রয় নেওয়া লেখক, সাংবাদিক, ব্লগার ও মানবাধিকার কর্মীদের মধ্যে আতঙ্ক তৈরি হয়েছে। সবার মনে একই প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছে – তবে কি পৃথিবীর কোথাও মানবাধিকার এক্টিভিস্টদের জীবন নিরাপদ নয়?
পাকিস্তানের অশান্ত অঞ্চল বেলুচিস্তানের বাসিন্দা কারিমা বেলুচ। সে অঞ্চলের স্বায়ত্তশাসনের দাবিতে লড়াই করা ছাত্র সংগঠন বেলুচ স্টুডেন্টস অর্গেনাইজেশনের (বিএইচও) নেতৃত্বে ছিলেন তিনি। এরই মধ্যে ২০১৩ সালের ১৫ মার্চ এই ছাত্র সংগঠনকে জঙ্গি সংগঠন আখ্যা দিয়ে নিষিদ্ধ করে ইসলামাবাদ। এরপর প্রাণ নিয়ে সংশয় বোধ করায় অধিকারকর্মীদের সহায়তায় ২০১৬ সালে পালিয়ে কানাডায় আশ্রয় নেন তিনি। এরপর ২০১৯ সালের মে মাসে ইমরান খান সরকারের বিরুদ্ধে চাঞ্চল্যকর অভিযোগ আনেন করিমা। পাকিস্তান সেনাবাহিনী ও রাষ্ট্রব্যবস্থার কঠোর সমালোচক এই অধিকারকর্মী গত রবিবার নিখোঁজ হওয়ার পর তার সন্ধান চেয়ে আবেদন জানায় পুলিশ। পরে তার বন্ধুরা মৃতদেহ পাওয়ার কথা জানায়।
পাকিস্তানের গোয়েন্দা সংস্থা ইন্টার সার্ভিসেস ইনটেলিজেন্সকে (আইএসআই) ব্যবহার করে পরিকল্পিতভাবে করিমা বেলুচকে হত্যা করা হয়েছে বলে দাবি করেছে বেলুচিস্তানের স্বাধীনতাকামী কয়েকটি সংগঠন। তারা এই ঘটনার তদন্ত দাবি করেছে।
করিমার বন্ধু ও সহযোদ্ধা লতিফ জোহার বেলুচ জানান, নির্বাসিত অবস্থায়ও বেলুচিস্তানের মানুষের অধিকারের জন্য সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে সরব ছিলেন তিনি। এ কারণে বিভিন্ন সময় হুমকিও দেয়া হচ্ছিল তাকে। সবশেষ অজ্ঞাত কেউ তাকে ‘শিক্ষা দিতে’ চেয়ে ‘বড়দিনের উপহার’ পাঠাবে জানিয়ে হুমকি দিয়েছিল।
করিমার স্বামী হাম্মাল হায়দারও টরেন্টোতে নির্বাসিত পাকিস্তানি মানবাধিকারকর্মী। হাম্মাল জানান, বেলুচিস্তানে সেনা অভিযান ও সেখানকার মানবাধিকার লঙ্ঘনের বিষয়ে লেখালেখির কারণে কিছুদিন আগে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বেশ কিছু হুমকিমূলক বার্তা আসছিল। আমাকে বলা হয়েছিল আমার ভাই ও স্ত্রী (করিমা) তাদের লক্ষ্যবস্তু। আমি এগুলো গুরুত্ব দিইনি। মানবাধিকার লঙ্ঘন নিয়ে কথা বললেই এ ধরনের হুমকি আসত।
বেলুচিস্তানের বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলনকারীদের অভিযোগ সাম্প্রতিক বছরগুলোতে সেখানকার হাজার হাজার রাজনৈতিক কর্মী গুমের শিকার হয়েছেন। পাকিস্তানের সামরিক বাহিনীর বিরুদ্ধে বালুচিস্তানে ব্যাপক মানবাধিকার লংঘনের অভিযোগ আছে। করিমা বেলুচের পরিবারের কয়েকজন সদস্য বহু বছর ধরে বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলনের সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিলেন, এবং তার একজন চাচা ও একজন মামা এর আগে নিখোঁজ হন, যাদের মৃতদেহ পরে পাওয়া যায়।
এই বছর করিমার মৃত্যু ছিল পাকিস্তান সরকারের রোষানলে পড়া দ্বিতীয় মৃত্যু। এর আগে গত মে মাসে, সাজিদ হুসাইন নামের আরেক পাকিস্তানি মানবাধিকারকর্মীর মরদেহ পাওয়া যায় সুইডেনে। বেলুচিস্তানের মানবাধিকার নিয়ে কাজ করায় হুমকির মুখে সুইডেনে আশ্রয় নিয়েছিলেন তিনি।
বিভিন্ন দেশে আশ্রয়ে থাকা পাকিস্তান মানবাধিকারকর্মীরা জানায়, কতগুলো হুমকি ধামকি পাওয়ার পর এসমস্ত রহস্যজনক মৃত্যু ঘটছে। এটা বিগত এক বছর ধরে দেখে আসছে বলে তারা জানায়।
তাহা সিদ্দিক, যিনি পাকিস্তানের একজন প্রখ্যাত সাংবাদিক, পাকিস্তান সরকারের তীব্র সমালোচনা করায় তাকেও দেশ ছাড়তে হয়।আশ্রয় নিতে হয় ফ্রান্সে। তিনি জানান, পাকিস্তানে আমরা দেখছি যে ক্রমবর্ধমান নিপীড়ন ও নির্যাতন এবং স্বতন্ত্র কণ্ঠস্বর দমন করা হয়ে আসছে। এখন তারা ঘরে বসে কাজটি করছে, দেখে মনে হচ্ছে তারা সেই মডেলটির প্রতিলিপি তৈরি করছে এবং বিশ্বব্যাপী এই মডেলটি প্রসারিত করছে।
পশ্চিমা দেশগুলোতে রাজনৈতিক আশ্রয় নেওয়া মানবাধিকার কর্মী, সাংবাদিক ও ভিন্নমতালম্বীদের জীবনের নিরাপত্তা দেওয়া সংশ্লিষ্ট রাষ্ট্রের বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞমহল। এসব দেশেও যদি জীবনের নিরাপত্তা না পাওয়া যায় তাহলে রাজনৈতিক আশ্রয় দেওয়ার উদ্দেশ্য প্রশ্নবোধক হয়ে দাঁড়ায় বলে মনে করেন আশ্রয় পাওয়া মানবাধিকার কর্মী ও সাংবাদিকরা।
এসডব্লিউ/কেএইচ/নসদ/ ২০১০
আপনার মতামত জানানঃ