অর্থনৈতিক মন্দার দিকে অগ্রসর হচ্ছে বিশ্ব। বছরের শুরুতে এমন গুঞ্জন শোনা গেলেও যত দিন যাচ্ছে ততোই জোরালো হচ্ছে এই আশঙ্কা।
সম্প্রতি ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরাম (ডব্লিউইএফ) বিশ্বের বিভিন্ন সরকারি–বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের প্রধান অর্থনীতিবিদের নিয়ে মতামত জরিপ করেছে।
সেখানে ৭৩ শতাংশ অর্থনীতিবিদ মত দিয়েছেন, ২০২৩ সালে মন্দা হতে পারে। তাদের মধ্যে ৬৪ শতাংশ মন্দার আশঙ্কা করেছেন। বাকি ৯ শতাংশ শক্তিশালী মন্দার আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন।
আবার প্রবৃদ্ধি কমার পাশাপাশি উচ্চ মূল্যস্ফীতিও বৈশ্বিক সংকটে রূপ নিচ্ছে। এ ছাড়া মজুরি হ্রাস, দারিদ্র্য বৃদ্ধি ও সামাজিক অস্থিরতার আশঙ্কা করেছেন জরিপে অংশ নেওয়া অর্থনীতিবিদেরা।
সম্প্রতি ডব্লিউইএফের ওয়েবসাইটে ‘ইকোনমিস্টস আউটলুক’ নামে এই প্রতিবেদন প্রকাশ করা হয়েছে। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, উত্তরদাতা অর্থনীতিবিদদের প্রতি ১০ জনের ৯ জনই বলেছেন, ইউরোপের মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) প্রবৃদ্ধি দুর্বল বা খুব দুর্বল হবে। আর ৬৭ শতাংশ উত্তরদাতা জানিয়েছেন, চীনের প্রবৃদ্ধিও দুর্বল বা খুব দুর্বল হবে।
অর্থনীতিবিদেরা বলছেন, মূলত তিনটি কারণে বিভিন্ন দেশের প্রবৃদ্ধি কমে যাবে। প্রথমত, ইউক্রেন যুদ্ধ; দ্বিতীয়ত, বিশ্বের দেশে দেশে উচ্চ মূল্যস্ফীতি এবং তৃতীয়ত, বিশ্বব্যাপী হুমকির মুখে পড়া জ্বালানি সরবরাহ।
ওই প্রতিবেদনে বিশ্বের অন্য অঞ্চলের তুলনায় দক্ষিণ এশিয়ার জন্য কিছুটা স্বস্তির খবর দেওয়া হয়েছে। জরিপে অংশ নেওয়া ৬৫ শতাংশ অর্থনীতিবিদ জানিয়েছেন, ২০২৩ সালে দক্ষিণ এশিয়ায় মোটামুটি মানের প্রবৃদ্ধি হবে।
৭৩ শতাংশ অর্থনীতিবিদ মত দিয়েছেন, ২০২৩ সালে মন্দা হতে পারে। তাদের মধ্যে ৬৪ শতাংশ মন্দার আশঙ্কা করেছেন। বাকি ৯ শতাংশ শক্তিশালী মন্দার আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন।
অবশ্য আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) মতো সংস্থাও ২০২২ ও ২০২৩ সালে বিশ্বপ্রবৃদ্ধি কমার পূর্বাভাস দিয়েছে। আইএমএফ বলছে, ২০২২ সালে ৩ দশমিক ২ শতাংশ এবং ২০২৩ সালে ২ দশমিক ৯ শতাংশ প্রবৃদ্ধি হতে পারে।
প্রবৃদ্ধি কমে গেলে কর্মসংস্থানের ওপর প্রভাব পড়ে। নতুন কর্মসংস্থান কম হয়। মন্দা দেখা দিলে বা প্রবৃদ্ধি কমে গেলে যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপে কর্মসংস্থান কমে যাবে বলে মনে করছে ডব্লিউইএফ।
সমীক্ষার উদ্ধৃতি দিয়ে সংস্থাটি বলছে, ৬৫ শতাংশ অর্থনীতিবিদ মনে করেন, মন্দার কারণে যুক্তরাষ্ট্রে ‘দুর্বল’ কর্মসংস্থান হবে। সাম্প্রতিক মাসগুলোয় যুক্তরাষ্ট্রের শ্রমবাজার বেশ উত্তপ্ত ছিল।
জরিপে অংশ নেওয়া অর্থনীতিবিদের কেউই যুক্তরাষ্ট্রে ভালো প্রবৃদ্ধির আশা করেন না। মাত্র ২০ শতাংশ অর্থনীতিবিদ ভালো কর্মসংস্থানের আশা প্রকাশ করেছেন। অন্যদিকে মন্দার কারণে ইউরোপের দেশগুলোতে দুর্বল বা দুর্বলতর কর্মসংস্থানের কথা বলেছেন ৪৫ শতাংশ অর্থনীতিবিদ। তবে দক্ষিণ এশিয়ায় কর্মসংস্থানে মোটামুটি মানের গতি থাকবে বলে মনে করেন এসব অর্থনীতিবিদ।
প্রবৃদ্ধিকে দুর্বল করার অন্যতম একটি বড় কারণ হলো বিশ্বব্যাপী উচ্চ মূল্যস্ফীতি। ডব্লিউইএফ বলছে, ২০২২ সালজুড়ে উচ্চ মূল্যস্ফীতি থাকবে। ২০২৩ সালে তা কিছুটা কমে যাবে। এটা মতামত জরিপে অংশগ্রহণকারীরা জানিয়েছেন। ৯৩ শতাংশ অর্থনীতিবিদ জানিয়েছেন, ২০২২ সালে উচ্চ মূল্যস্ফীতি বিরাজমান থাকবে।
আর ৪৩ শতাংশ অর্থনীতিবিদ জানিয়েছেন, ২০২৩ সালেও উচ্চ মূল্যস্ফীতির ঝুঁকি থাকবে। একইভাবে ৯৩ শতাংশ অর্থনীতিবিদ জানিয়েছেন, ২০২২ সালে ইউরোপে উচ্চ মূল্যস্ফীতি থাকবে। ৪৫ শতাংশ অর্থনীতিবিদ জানিয়েছেন, ২০২৩ সালেও উচ্চ মূল্যস্ফীতি অব্যাহত থাকবে। মূলত জ্বালানি ও খাদ্য আমদানির খরচ বেড়ে যাওয়ার পাশাপাশি দেশগুলোর ঋণ পরিশোধ, ডলারের মূল্যবৃদ্ধির কারণে মূল্যস্ফীতি বাড়তে পারে বলে মনে করছেন অর্থনীতিবিদেরা।
কী করবে বাংলাদেশ
সম্প্রতি আমাদের দেশে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড বৃদ্ধির প্রেক্ষাপটে আমদানি ব্যয় বেড়েছে। এদিকে মূল্যস্ফীতির কারণে সার্বিকভাবে দেশের অর্থনীতিতে চাপ বেড়েছে। সাম্প্রতিক সময়ে রেমিট্যান্স প্রবাহ কম থাকায় তা দিয়ে আমদানি ও অন্যান্য ব্যয় মেটানো সম্ভব হচ্ছে না। ফলে কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে বাজারে ডলারের জোগান দিতে হচ্ছে।
বিশ্লেষকরা বলছেন, আগামী বছর বিশ্বে মন্দা পরিস্থিতি তৈরি হলে তৈরি পোশাক খাতে রপ্তানি কমে যেতে পারে এবং রেমিট্যান্স প্রবাহ আরও কমে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। কাজেই রেমিট্যান্স প্রবাহ বাড়ানোর লক্ষ্যে শ্রমনির্ভর পেশার পরিবর্তে মেধানির্ভর পেশাকে গুরুত্ব দিতে হবে।
প্রবাসী বংলাদেশিদের অবৈধভাবে অর্থ প্রেরণের পরিবর্তে ব্যাংকের মাধ্যমে দেশে অর্থ প্রেরণে উদ্বুদ্ধ করতে হবে। করোনায় অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড বাধাগ্রস্ত হওয়ায় অনেকদিন ধরেই দেশে বিনিয়োগে মন্দাভাব পরিলক্ষিত হচ্ছে। এ কারণে চাকরির বাজার সংকুচিত হয়েছে। ফলে অনেকেই চাকরিচ্যুত হয়েছে। অনেকের বেতনভাতা কমেছে। এদিকে দেশে বেকারের সংখ্যা বাড়ছে। এ পরিস্থিতি মোকাবিলায় সব ধরনের শিল্প খাতকে চাঙা করে কর্মসংস্থান বাড়ানোর পদক্ষেপ নিতে হবে। একই সঙ্গে রপ্তানিপণ্য বহুমুখীকরণে জোর দিতে হবে। এদিকে ডলারের বাজারের অস্থিরতা কমছে না। এ পরিস্থিতিতে আমদানিনির্ভরতা কমাতে যথাযথ পদক্ষেপ নিতে হবে।
তারা বলছেন, জানা গেছে, বৈশ্বিক মন্দার প্রভাব মোকাবিলায় আমদানি কমানোর লক্ষ্যে বিভিন্ন পদক্ষেপ নিয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এর অংশ হিসাবে কৃষি খাতে স্বল্পসুদে ঋণপ্রবাহ বাড়ানোর উদ্যোগটি ইতিবাচক। দেশের প্রান্তিক কৃষকের পুঁজি হলো গতানুগতিক প্রযুক্তি ও অভিজ্ঞতা। এ পুঁজি দিয়ে তাদের পক্ষে বর্তমান পরিস্থিতি মোকাবিলা করা সম্ভব নয়। বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধির প্রভাব মোকাবিলার কৌশলসহ কৃষকদের আধুনিক পদ্ধতির চাষাবাদ শেখানোর উদ্যোগ নিতে হবে। তা না হলে স্বল্পসুদে ঋণ বিতরণের সুফল মিলবে না।
শুধু তাই নয়, স্বল্পসুদের ঋণ যাতে কৃষকের গলার কাঁটায় পরিণত না হয়, সেজন্যও পদক্ষেপ নিতে হবে। আমদানিনির্ভরতা কমাতে দেশীয় শিল্পবিকাশেও যথাযথ উদ্যোগ নিতে হবে। বিদ্যুৎ ও গ্যাস সংকট দূর করা না হলে বিদ্যমান শিল্প খাতও সংকুচিত হয়ে যেতে পারে। দেশীয় শিল্পের বিকাশে অবকাঠমোগত সমস্যা দূর করার পাশাপাশি সুশাসনও নিশ্চিত করতে হবে।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৯৪১
আপনার মতামত জানানঃ