গত ২৩ আগস্ট কোচিংয়ে যাওয়ার কথা বলে বাসা থেকে বের হয়ে যান কুমিল্লার সাত শিক্ষার্থী। যাওয়ার সময় তেমন টাকা-পয়সা, মোবাইল ফোন কিংবা বাড়তি পোশাকও নেননি তারা। একাধিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের হলেও নিখোঁজ প্রত্যেকেই ছিলেন পরস্পরের পরিচিত। তাদের বয়স ১৭ থেকে ২৫ বছরের মধ্যে।
কোচিংয়ে যাওয়ার কথা বলে গত ২৩ আগস্ট বাসা থেকে বের হন তারা, অথচ ২৬ দিন পার হলেও খোঁজ মেলেনি তাদের।
গোয়েন্দা সূত্রমতে, এই সাত তরুণ কথিত হিজরতের নামে ঘর ছাড়েন। তারা সবাই নিষিদ্ধঘোষিত জঙ্গি সংগঠন আনসার আল ইসলামের সদস্য।
আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী সূত্রে জানা গেছে, নিখোঁজ সাত তরুণকে জঙ্গিবাদে জড়ানোর মূল কারিগরকে শনাক্ত করা হয়েছে। তার নাম শাহ মোহাম্মদ হাবিবুল্লাহ। তিনি কুমিল্লা শহরের একটি মসজিদের ইমাম। তিনি গত এক সপ্তাহ ধরে নিখোঁজ।
র্যাব জানায়, গ্রেপ্তার এড়াতে হাবিবুল্লাহ গা ঢাকা দিয়েছেন। তাকে গ্রেপ্তারে চেষ্টা চলছে।
এদিকে সাত তরুণের কথিত হিজরতের ঘটনায় সংশ্লিষ্ট হিসেবে বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউটের (বারি) এক কর্মীকেও খুঁজছে র্যাব। তার নাম মো. নেছার উদ্দিন (৩৪)।
নেছারের স্ত্রীর বরাত দিয়ে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী সূত্র জানায়, নেছার চার-পাঁচ দিন ধরে নিখোঁজ। তিনি ভোলায় থাকতেন। পরিবার থাকেন গ্রামের বাড়ি পটুয়াখালীতে। প্রতি শুক্র-শনিবার নেছার বাড়ি আসতেন। বিভিন্ন স্থানে খোঁজ করেও স্বামীর বিষয়ে কিছু জানতে পারেননি তার স্ত্রী।
পুলিশের পাশাপাশি এই সাত তরুণের বিষয়ে র্যাবও অনুসন্ধান চালাচ্ছে।
সংশ্লিষ্ট সূত্র বলছে, এই তরুণেরা নিষিদ্ধঘোষিত জঙ্গি সংগঠন আনসার আল ইসলামের সদস্য। তাদের উগ্র মতাদর্শে উদ্বুদ্ধ করার মূল কারিগর কুমিল্লা মসজিদে কোবার ইমাম (কেবল ওয়াক্ত নামাজ পড়াতেন) শাহ মোহাম্মদ হাবিবুল্লাহ।
সূত্র জানায়, নিখোঁজ তরুণরা কোবা মসজিদে নামাজ পড়তেন, সেই সূত্রে তারা ইমাম হাবিবুল্লাহর কাছে ধর্মীয় বিভিন্ন নিয়ম-কানুন জানতে চাইতেন। একপর্যায়ে তাদের জঙ্গিবাদে উদ্বুদ্ধ করেন। পরে সন্দেহ এড়াতে তারা কখনো নুর মসজিদে, কখনো ধর্মসাগরের পাড়ে পার্কে মিলিত হতেন বলে তথ্য পাওয়া গেছে।
নিখোঁজ তরুণরা কোবা মসজিদে নামাজ পড়তেন, সেই সূত্রে তারা ইমাম হাবিবুল্লাহর কাছে ধর্মীয় বিভিন্ন নিয়ম-কানুন জানতে চাইতেন। একপর্যায়ে তাদের জঙ্গিবাদে উদ্বুদ্ধ করেন।
এ বিষয়ে র্যাবের লিগ্যাল অ্যান্ড মিডিয়া উইংয়ের পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মঈন সংবাদমাধ্যমকে বলেন, আমাদের কাছে গোয়েন্দা তথ্য আসে, কুমিল্লার নিখোঁজ ৭ তরুণকে আনসার আল ইসলামের মতাদর্শে উদ্বুদ্ধ করেন শাহ মোহাম্মদ হাবিবুল্লাহ। যার পরিপ্রেক্ষিতে ওই মসজিদকে ঘিরে আশপাশে র্যাবের গোয়েন্দা নজরদারি চলতে থাকে। ৭ তরুণ নিখোঁজের পর হাবিবুল্লাহ অসুস্থতার কথা বলে ছুটি নেন এবং এখন পর্যন্ত তিনি তার পরিবারের কাছে যাননি। এমনকি কোনো প্রকার যোগাযোগও করেননি। গোয়েন্দা তথ্যের ভিত্তিতে প্রাথমিকভাবে জানা গেছে তিনিও নিখোঁজ।
কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউটের কর্মী নেছার উদ্দিন সম্পর্কে জানতে চাইলে কমান্ডার খন্দকার আল মঈন বলেন, কথিত হিজরতের কথা বলে কুমিল্লার নিখোঁজ ৭ তরুণকে নেছার শারীরিক ও তাত্ত্বিক প্রশিক্ষণ দিতেন। নেছার উদ্দিনও আনসার আল ইসলামের সদস্য।
বাংলাদেশে সক্রিয় জঙ্গি সংগঠনগুলোর মধ্যে বেশিরভাগই কোণঠাসা অবস্থায় থাকলেও শঙ্কা এখনও আনসার আল ইসলামকে নিয়ে। আন্তর্জাতিক নিষিদ্ধ জঙ্গি সংগঠন আল-কায়েদার অনুসারী আনসার আল ইসলামকে ভারতীয় উপমহাদেশের আল-কায়েদার শাখা একিউআইএস (আল-কায়েদা ইন ইন্ডিয়ান সাব-কন্টিনেন্ট) হিসেবেও বলা হয়। বিগত কয়েক বছর ধরে এই সংগঠনের সহিংস কর্মকাণ্ড না থাকলেও আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর কর্মকর্তারা বলছেন, আনসার আল ইসলাম ভেতরে ভেতরে সুসংগঠিত হওয়ার কাজ করছে। তারা যদি আবারও সহিংস কর্মকাণ্ডে ফিরে আসে তবে বাংলাদেশের জন্য তা বড় শঙ্কার কারণ হয়ে দাঁড়াতে পারে।
বিশ্লেষকরা বলছেন, বাংলাদেশে সক্রিয় জঙ্গি সংগঠনগুলোর মধ্যে আনসার আল ইসলামের সদস্যরা অন্যান্য সংগঠনের তুলনায় অনেক বেশি সংগঠিত। এই দলের সদস্যরা অন্যদের তুলনায় শিক্ষিত ও প্রযুক্তি সম্পর্কে অধিক জ্ঞানসম্পন্ন। এই দলের শীর্ষ নেতা পলাতক সেনাবাহিনী থেকে বহিষ্কৃত মেজর জিয়াও অনেক বেশি প্রযুক্তিবিষয়ক জ্ঞানসম্পন্ন। ফলে সংগঠনের সদস্যদেরও সে সেভাবেই তৈরি করেছে। একসময় সেনাবাহিনীর চৌকস কমান্ডো অফিসার হিসেবে কর্মরত থাকা জিয়া নিজের দক্ষতা ও কৌশল প্রয়োগ করে তার সদস্যদেরও অনেক বেশি দক্ষ করার চেষ্টা করছে।
তারা মনে করেন, আফগানিস্তানে তালিবানরা ক্ষমতায় আসার পর এ দেশের উগ্র মতাদর্শী তরুণদের মধ্যে একধরনের মানসিক অস্থিরতা তৈরি হয়। আল–কায়েদার শীর্ষ নেতা আয়মান আল-জাওয়াহিরি মারা যাওয়ার পর আল–কায়েদা নতুন করে সংগঠিত হওয়ার যে চেষ্টা করছে, তাতে উগ্রবাদী এই তরুণেরা উদ্বুদ্ধ হয়েছেন বলে মনে হয়। এই অস্থিরতার কারণে তরুণদের মধ্যে নতুন করে হিজরতের প্রবণতা তৈরি হয়ে থাকতে পারে।
কূটনৈতিক বিশ্লেষকরা বলেন, তালিবান পুনরুত্থানের জায়গাতে আমরা দেখছি যে আমাদের দেশের জঙ্গিদের একটি অংশ আফগানিস্তানে যাওয়ার চেষ্টা করছে। সেখান থেকে সহযোগিতা বা পৃষ্টপোষকতা নিয়ে বাংলাদেশের জঙ্গিবাদকে আবার উজ্জীবিত করা যায় কিনা। তো এখানে যেমন অভ্যন্তরীণ রাজনীতিকে প্রভাবিত করার চেষ্টা করা হবে, তেমনি আমাদের আঞ্চলিক যে ভূ-রাজনীতি আছে, সেটাকেও প্রভাবিত করার জন্য এ শক্তিকে ব্যবহার করার চেষ্টা করা হবে। সেটি বাংলাদেশের জন্য একটি শঙ্কার কারণ।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৯৫৭
আপনার মতামত জানানঃ