নারীর জন্য সবচেয়ে বিপজ্জনক দেশের তালিকায় পাকিস্তান বিশ্বে ছয় নম্বরে অবস্থান করছে৷ যৌন নির্যাতন ও পারিবারিক সহিংসতার হার বেড়েই চলেছে দেশটিতে৷ দেশটির অধিকাংশরাই মনে করেন নারীরা অনিরাপদ। এসবের মাঝেও দেশটিতে নারীদের বিবাহবিচ্ছেদ বাড়ছে।
ডিভোর্স পাকিস্তানি নারীদের জন্য একটি সামাজিক ট্যাবু। এরপরও দেশটিতে নিজেই বিবাহবিচ্ছেদ ঘটিয়েছেন এমন নারীর সংখ্যা বাড়ছে। খবর ডয়চে ভেলের।
দেশটির মানবাধিকার কর্মীরা বলছেন, পুরুষতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থায় নারীদের পক্ষ থেকে বিবাহবিচ্ছেদ করার বিষয়টি মূলত নারীদের অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী এবং দাম্পত্য জীবনে নিগ্রহের শিকার হওয়ার বাস্তবতা তুলে ধরছে।
দেশটিতে শরিয়া আইন অনুযায়ী, একজন নারী ডিভোর্স বা বিবাহবিচ্ছেদের জন্য আবেদন করতে পারেন না। তবে স্বামীর অনুমতি ছাড়া তারা বিয়ে ভেৃঙে দিতে পারেন। বিয়ে ভেঙে দেওয়ার এই রীতিটি পাকিস্তানে ‘খুলা’ নামে পরিচাত। সাধারণত পারিবারিকভাবে এটি হয়ে থাকে, অর্থাৎ, পারিবারিক আদালত বসিয়ে এ ধরনের বিষয়ের মীমাংসা করা হয়। তবে বিয়ে ভেঙে দেওয়া বা খুলার আবেদনের জন্য একজন নারীকে সুনির্দিষ্ট কারণ দেখাতে হয়।
পাকিস্তানে এ পর্যন্ত কতজন নারী এই আইনের মাধ্যমে বৈবাহিক সম্পর্ক ভেঙেছেন তা সুনির্দিষ্টভাবে জানা না গেলেও এমন নারীর সংখ্যা বাড়ছে বলে জানিয়েছেন অনেকে।
২০১৯ সালের এক জরিপ অনুযায়ী, পাকিস্তানের ৫৮ শতাংশ মানুষ মনে করেন, দেশে বিবাহবিচ্ছেদের সংখ্যা বাড়ছে। জরিপে অংশগ্রহণকারীদের প্রতি পাঁচ জনের দুইজন মনে করেন, শ্বশুরবাড়ির লোকজনের কারণেই বেশিরভাগ সময় এমন বিচ্ছেদের ঘটনা ঘটছে।
পাকিস্তান সমাজে পুরুষরা ইচ্ছাধীন তালাক দিতে পারলেও নারী কর্তৃক বিবাহবিচ্ছেদকেও ঘৃণা এমনকি ক্ষেত্রবিশেষে অপরাধের চোখে দেখা হয়। পাকিস্তানে নারী অধিকার নিয়ে কাজ করা বেসরকারি মানবাধিকার সংগঠন আওরাতের তথ্য মতে, দাম্পত্য নির্যাতনের প্রতিবাদ, তালাক বা বিয়েবিচ্ছেদের অধিকার চাওয়ায় এক বছরে আট হাজারেরও বেশি নারীকে হত্যা করা হয়েছে। পাকিস্তানে বসবাসকারী সংখ্যাগরিষ্ঠদের ধর্ম ইসলাম নারীদের তালাক বা বিবাহবিচ্ছেদের অধিকার দিলেও পাকিস্তানের রক্ষণশীল মুফতি বা ইসলামি আইনশাস্ত্রবিদরা নারী কর্তৃক তালাক বা বিবাহবিচ্ছেদকে পাপ হিসেবে বর্ণনা করে এ ব্যাপারে নিরুৎসাহিত করে।
শিক্ষিত ও অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী নারীরাই সাধারণত বিবাহবিচ্ছেদ বা ‘খুলা’র জন্য আবেদন করে থাকেন।
নারীদের অধিকার নিয়ে কাজ করা আইনজীবীরা বলছেন, পাকিস্তানে ‘খুলা’র আবেদন করা বা বিবাহবিচ্ছেদ করা নারীর সংখ্যা প্রতিনিয়তই বাড়ছে।
পাকিস্তানের মানবাধিকার সংস্থা হিউম্যান রাইটস প্রোটেকশন সেন্টারের অ্যাটর্নি আতিকা হাসান রাজা বলেন, পাকিস্তানে ধীরে ধীরে নারীরা বুঝতে পারছেন, শারীরিক নির্যাতন ছাড়া অন্য কারণেও যেমন মানসিক নির্যাতন ইত্যাদির কারণে নারীরা বিবাহবিচ্ছেদ করতে পারে।
আইনজীবী মোমিন আলি খান সংবাদমাধ্যমকে বলেন, শিক্ষিত ও অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী নারীরাই সাধারণত বিবাহবিচ্ছেদ বা ‘খুলা’র জন্য আবেদন করে থাকেন।
তার মতে, সামাজিক-অর্থনৈতিকভাবে পিছিয়ে থাকা গ্রামের নারীদের জন্য নিজের ইচ্ছায় বিবাহ বিচ্ছেদ করা অনেক কঠিন।
বিশ্লেষকরা বলেছেন, পাকিস্তানে বহু বছর ধরেই নারীরা বৈষম্যের শিকার। অর্থনৈতিক, সামাজিক, নাগরিক, রাজনৈতিক— এমন কোনও ক্ষেত্র নেই যেখানে অবহেলিত নন দেশটির নারীরা। নিজের পছন্দে বিয়ে করা বা বাইরে কাজে বের হওয়ার মতো বিষয়গুলোতে প্রতিনিয়ত বাধার মুখে পড়তে হচ্ছে তাদের।
পাকিস্তানে নারীদের বর্তমান আইনি অবস্থান রূপায়িত হয়েছিল মূলত জিয়া-উল-হকের সামরিক শাসনামলে। ১৯৭৭ থেকে ১৯৮৭ সালের সেই সময়টিতে একাধিক দমনমূলক আইন পাস হয়, যাতে সরকারি-বেসরকারি খাতে নারীদের প্রতি বৈষম্য আরও প্রকট হয়ে ওঠে।
এসব আইনের মাধ্যমে ‘ধর্মনিরপেক্ষ’ হয়ে ওঠার পূর্বপ্রতিশ্রুতি থেকে অনেকটা দূরে সরে যায় পাকিস্তান। সেখানে হুদুদ অধ্যাদেশ জারি হয়, যাতে পারিবারিক আইন এবং যৌনতা বিষয় ‘ইসলামী আইনের’ বেশ কিছু রক্ষণশীল নীতি ব্যবহার করা হয়। তবে ধর্ষণ, ‘অনার কিলিং’ (পারিবারিক সম্মান রক্ষার অজুহাতে হত্যা), অ্যাসিড নিক্ষেপ, পারিবারিক সহিংসতা, জোরপূর্বক বিয়ের মতো বিষয়গুলো উপেক্ষিতই থেকে যায়।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৪৫০
আপনার মতামত জানানঃ