ইলিশ রপ্তানিতে সরাসরি জড়িত ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের নেতারা। দেশের বাজারে ঘাটতি এবং ভারতের বাজারে তুলনামূলক কম দামের প্রমাণ মিলেছে। বিশ্লেষকরা বলছেন, ‘ইলিশ রাজনীতি’ হাসিনা সরকারের নতুন কৌশল। ভারতে শেখ হাসিনার গ্রহণযোগ্যতা বৃদ্ধির উদ্দেশ্যে সামাজিক প্রোপাগান্ডার হাতিয়ার হিসেবে ইলিশকে ব্যবহার করা হচ্ছে।
বাংলাদেশের শহর ও গ্রামাঞ্চলে ভরা মৌসুমেও ইলিশের দাম চড়া। বিক্রেতারা বলছেন, চাহিদার তুলনায় বাজারে মাছের সরবরাহ কম বিধায় দাম কমছে না। অথচ বছরের এই সময় ইলিশের দাম কিছুটা পড়তির দিকে থাকে। কিন্তু এবার ভারতে বিপুল পরিমাণ ইলিশ রপ্তানি হচ্ছে বিধায়, বাজারে চাহিদা অনুযায়ী জোগান মিলছে না। যে কারণে বেশি দাম গুণতে হচ্ছে দেশের মানুষকে। আবার অনেকে এত দামের মাছ ছুঁয়েও দেখতে পারছেন না।
কিন্তু দেশের বাজারে চাহিদা পূরণ না করে কেন পাশের দেশ ভারতে বিপুল পরিমাণ ইলিশ রপ্তানি হচ্ছে, কেন দেশের মানুষকে বঞ্চিত করা হচ্ছে, এমন প্রশ্ন এখন সর্বত্র। ভারতের পশ্চিমবঙ্গে বাংলাদেশের চেয়ে ইলিশ মাছের দাম কম, এমন কথাও শোনা যাচ্ছে। সাধারণ মানুষ এতে ক্ষিপ্ত। কিন্তু কেন ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ সরকার নিজ দেশের মানুষের চাহিদা ও ক্ষোভকে আমলে না নিয়ে ভারতের চাহিদা মেটাতে উন্মুখ, সে প্রশ্নের জবাবে রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করছেন, শেখ হাসিনার সরকার এই মুহূর্তে বাংলাদেশের মানুষের চাহিদার চেয়ে ভারত সরকারের মনোরঞ্জনকে অধিক গুরুত্ব দিচ্ছে। ইলিশের বাজারেও তারই প্রতিফলন দেখা যাচ্ছে।
কত ইলিশ বাজারে আসছে, ভারতে যাচ্ছে কত?
ইলিশ মাছের পাইকারি বাজার ঘাট ঘুরে দেখা গেছে, ইলিশ কিনতে ঘাটে ছিল ক্রেতাদের উপচে পড়া ভিড়। কিন্তু, সাধারণ ক্রেতারা ইলিশের দাম দেখে খালি হাতে চলে যাচ্ছেন। চাঁদপুর মৎস্য বণিক সমবায় সমিতির সাধারণ সম্পাদক শবে বরাত বলেন, ‘গত বছর এ সময় যে ইলিশের দাম ৭০০ থেকে ৮০০ টাকা ছিল। এবার এসব ইলিশের দাম প্রায় দিগুণ। কারণ মাছের চাহিদার তুলনায় মাছ আসছে কম।’ ব্যবসায়ীরা বলছেন, গত বছরের তুলনায় এ সময় চাহিদার এত ফারাকের কারণ হচ্ছে, বিপুল পরিমাণ মাছ ভারতে চলে যাচ্ছে।
কী পরিমাণ মাছ দেশের বাজারে আসছে, আর কী পরিমাণ ভারতে যাচ্ছে, সেই চিত্র মিলছে বরিশাল নগরের পোর্ট রোড মাছের বাজারের একটি বৃহত্তম আড়ত থেকে। ৭ সেপ্টেম্বর এই আড়তটিতে প্রায় ৬০০ মণ ইলিশের আমদানি ঘটে। এর মধ্যে অন্তত ৪০০ মণ ইলিশ রপ্তানির উদ্দেশ্যে প্রক্রিয়াজাত করা হয়। অর্থাৎ অর্ধেকের বেশি মাছ ভারতে চলে যাচ্ছে। বরিশাল থেকে মাত্র তিনজন ব্যবসায়ী মাছ রপ্তানির অনুমতি পেয়েছেন। এর মধ্যে পোর্ট রোড থেকে শুধু মাছ ব্যবসায়ী নীরব হোসেন টুটুল ইলিশ মাছ রপ্তানি করবেন। তিনি মহানগর আওয়ামী লীগের শিল্প ও বাণিজ্য বিষয়ক সম্পাদক এবং বরিশাল মৎস্য আড়তদার সমিতির সাধারণ সম্পাদক। ৭ সেপ্টেম্বরের মধ্যে ১৭ টন ইলিশ তিনি রপ্তানি করেছেন।
বাণিজ্য মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, দুর্গোৎসব উপলক্ষে ৪৯ প্রতিষ্ঠানকে ভারতে ইলিশ রপ্তানির অনুমতি দিয়েছে। ৪ সেপ্টেম্বর থেকে শুরু হয়েছে এই রপ্তানি। প্রতিটি প্রতিষ্ঠান ৫০ মেট্রিক টন করে ইলিশ রপ্তানি করতে পারবে। সর্বমোট রপ্তানি হবে দুই হাজার ৪৫০ মেট্রিক টন ইলিশ। ৩০ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত চলবে এই রপ্তানি।
ইলিশের দাম কি পশ্চিমবঙ্গে কম?
ভারতের হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের সবচেয়ে বড় ধর্মোৎসব দুর্গাপুজা সামনেই। দুর্গাপুজায় উৎসব আয়োজনে ইলিশ এক অনন্য উপাদান। এই পুজাকে সামনে রেখেই সরকার ইলিশ রপ্তানির অনুমতি দিয়েছে বলে জানিয়েছেন সরকারের মৎস্য সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা। ৪ সেপ্টেম্বর বাণিজ্য মন্ত্রণালয় অনুমতি প্রদানের পরদিনই বরিশাল থেকে ট্রাকে করে ইলিশের দুটি চালান ভারতের উদ্দেশ্যে রওনা দেয়। এরপর থেকে প্রতিদিনই বিপুল পরিমাণ ইলিশ মাছ ভারতে যাচ্ছে।
বাংলাদেশে আলাপ উঠেছে, ভারতের তুলনায় দেশের বাজারে মাছের দাম বেশি। ব্যবসায়ীরা বলছেন, এটা সত্য হতে পারে। কারণ ভারতে মাছ যেতে শুরু করেছে ৪ সেপ্টেম্বর থেকে। ৮ তারিখ থেকে বাজারে চাহিদার চাপ দেখা দেয়ায় দাম খানিক বেড়ে গেছে। ফলে ভারতে যাওয়া আগের চালানগুলোর দাম বাংলাদেশের বাজারের তুলনায় কম হতে পারে।
এছাড়া বাংলাদেশে ইলিশের মৌসুম শেষের দিকে বিধায়ও চাহিদা ও দাম বেড়েছে। চাঁদপুর মৎস্য সমবায় সমিতির সভাপতি আব্দুল বারি জমাদার মানিক বলেন, ‘৪ অক্টোবর থেকে ২২ দিনের মা ইলিশ রক্ষা অভিযান শুরু হবে। তাই ঘাটে ক্রেতাদের ভিড় বেড়েছে। এজন্য ইলিশের দাম তুলনামূলক বেশি।’ ভারতে এরকম কোনো ব্যাপার নেই।
পূজাকে সামনে রেখে ভারতীয় জনগণ ও সরকারের মধ্যে শেখ হাসিনা নিজের গ্রহণযোগ্যতা বাড়িয়ে নিতে চাইছেন। দেশের মানুষের বিরোধিতা ও ক্ষোভ সত্ত্বেও ভারতে ইলিশ রপ্তানি করায় তিনি ভারতীয় শাসকদের কাছে প্রশংসিত হবেন। দিল্লির সাউথ ব্লকের কাছে শেখ হাসিনাই প্রকৃত মিত্র- এই ধারণা জোরালো হতে ভূমিকা রাখবে এই ইলিশ রাজনীতি।
বরিশাল নগরের সবচেয়ে বড় মাছের বাজার পোর্ট রোড মৎস্য আড়তে গিয়ে দেখা গেছে, ৪০০ থেকে ৫০০ গ্রাম ওজনের ছোট ইলিশের পাইকারি দাম কেজিপ্রতি ৭০০ থেকে ৭৫০ টাকা। খাবার হোটেলগুলো এ ধরনের মাছ কিনে থাকে। রপ্তানিযোগ্য ৬৫০ গ্রাম থেকে এক কেজির কম ওজনের ইলিশ কেজিপ্রতি দাম এক হাজার ১০০ টাকা। এক কেজির বেশি ওজনের বড় ইলিশের দাম এক হাজার ৩০০ থেকে এক হাজার ৪০০ টাকা। দেড় কেজি ওজনের ইলিশের দাম কেজিপ্রতি এক হাজার ৭০০ টাকা। খুচরা বাজারে দাম আরো বেশি।
বাংলাদেশের বাজারে এখন বড় মাপের ইলিশ খুচরা বাজারে তেমন নেই বললেই চলে। পোর্ট রোডের মাছ ব্যবসায়ীরা বলছেন, সরকার থেকে অলিখিত নির্দেশনা রয়েছে যে, রপ্তানির মাছে বড় ও ছোট মাছের মধ্যে সমন্বয় থাকতে হবে। যে কারণে দেশের বাজারে বড় মাছ এখন কমই দেখা যাচ্ছে। মাছ রপ্তানির সঙ্গে সরাসরি আওয়ামী লীগ নেতারা জড়িত বিধায় সরকারি নির্দেশনা পালন হচ্ছে কড়াভাবে।
হাসিনা সরকার কী বার্তা দিচ্ছে
রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করছেন, পূজাকে সামনে রেখে ভারতীয় জনগণ ও সরকারের মধ্যে শেখ হাসিনা নিজের গ্রহণযোগ্যতা বাড়িয়ে নিতে চাইছেন। দেশের মানুষের বিরোধিতা ও ক্ষোভ সত্ত্বেও ভারতে ইলিশ রপ্তানি করায় তিনি ভারতীয় শাসকদের কাছে প্রশংসিত হবেন। দিল্লির সাউথ ব্লকের কাছে শেখ হাসিনাই প্রকৃত মিত্র- এই ধারণা জোরালো হতে ভূমিকা রাখবে এই ইলিশ রাজনীতি। পশ্চিমবঙ্গের সামাজিক পরিসরে সাধারণ বাঙালিদের মধ্যেও এটা ইতিবাচক প্রভাব রাখবে আওয়ামী লীগ সম্বন্ধে।
উল্লেখ্য, বাংলাদেশের বর্তমান আওয়ামী লীগ সরকারের ভারত নির্ভরতা গোপন কিছু নয়। সেপ্টেম্বরের ৫ তারিখ ভারত যাত্রার ঠিক আগের দিনই ইলিশ রপ্তানির অনুমতি দেয়া হয় এবং ৫ সেপ্টেম্বর শেখ হাসিনা ভারতে পৌঁছানোর পরপরই ইলিশের চালানও ভারতে পৌঁছায়। শেখ হাসিনার এই সফরকে আগামী বছর অনুষ্ঠেয় জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে ভারতের সঙ্গে সমঝোতার উপলক্ষ হিসেবে দেখেছেন অনেকেই। শেখ হাসিনার এই সফরের কিছুদিন আগেই পররাষ্ট্রমন্ত্রী আবদুল মোনেম এক প্রকাশ্য সভায় মন্তব্য করেছিলেন যে, ‘শেখ হাসিনার সরকারকে ক্ষমতায় টিকিয়ে রাখতে যা যা করা দরকার, ভারত সরকারকে তা করার অনুরোধ করেছি।’ ফলে আওয়ামী লীগের ভারত নির্ভরতা এখন আর কোনো গোপন আলোচনার বিষয় নেই। ইলিশের বাজারেও তাই ভারতের আধিপত্য চোখে পড়ছে। হাসিনা সরকার ইলিশের মাধ্যমে ভারতকে তার আনুগত্যের বার্তাই দিতে চাইছে।
আপনার মতামত জানানঃ