বন্ধু রাষ্ট্রের গালগল্পের ভীড়ে সীমান্ত হত্যা যেন স্বাভাবিক মৃত্যু হয়ে দাঁড়িয়েছে সীমান্তবর্তী মানুষদের জন্যে। বাংলাদেশ-ভারত দুই দেশের মধ্যে বেশ কয়েকবার সীমান্ত হত্যা বন্ধ আলোচনা এবং চুক্তি হয়েছে। দুই দেশের সীমান্তরক্ষী বাহিনীর শীর্ষ পর্যায় থেকে শুরু করে মন্ত্রী পর্যায়ের আলোচনাতেও কোনও সমাধান আসেনি, যার ফলে সীমান্ত হত্যা চলছেই।
এদিকে বাংলাদেশ ও ভারত সীমান্তে হত্যাকাণ্ড নিয়ে দুই দেশের সরকারের বর্তমান অবস্থান ও দৃষ্টিভঙ্গির প্রতিবাদ জানিয়েছে পশ্চিমবঙ্গ ভিত্তিক সংগঠন বাংলার মানবাধিকার সুরক্ষা মঞ্চ। একই সঙ্গে সীমান্ত হত্যায় জড়িত রক্ষীদের বিচারের আওতায় এনে কঠোর শাস্তি নিশ্চিত করার জন্য দাবি জানিয়েছে সংগঠনটি।
সীমান্তে প্রাণঘাতী অস্ত্রের ব্যবহার বন্ধে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির মধ্যে কোনো আলোচনা না হওয়াকে হতাশাজনক বলে বর্ণনা করেছে সুরক্ষা মঞ্চ (মাসুম)। শুক্রবার সংগঠনটি এক বিবৃতিতে এ কথা জানিয়েছে।
সংগঠনের সম্পাদক কিরীটী রায় শুক্রবার দেয়া বিবৃতিতে বলেন, সীমান্ত হত্যা কমেছে বলে গত বুধবার দুই সরকার যে বক্তব্য দিয়েছে, তাতে তথ্য গোপন করা হয়েছে এবং সীমান্তের মানুষের ভোগান্তিকে বিবেচনায় নেওয়া হয়নি।
গত ৫ থেকে ৮ সেপ্টেম্বর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ভারতে রাষ্ট্রীয় সফরের সময় অনুষ্ঠিত শীর্ষ বৈঠক ও অন্যান্য কর্মসূচির বিভিন্ন দিক তুলে ধরে গত বুধবার যৌথ বিবৃতি দেয় দুই দেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়।
তবে এই বিবৃতি জারি করার কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই পশ্চিমবঙ্গে দক্ষিণ দিনাজপুর জেলায় বিএসএফ’র গুলিতে মিনারুল ইসলাম নামে এক বাংলাদেশি স্কুলছাত্র নিহত হয়েছে উলেখ করে মানবাধিকার সুরক্ষা মঞ্চ বলেছে, গত এক দশকে পূর্ববর্তী দশকের তুলনায় সীমান্ত হত্যা বেড়েছে। বর্তমান দশকে বছরে গড়ে ২০০ লোক সীমান্তে খুন হয়েছে। আগের দশকে বছরে গড়ে ১৫০ জন খুন হতো।
বিবৃতিতে সংগঠনটি জানায়, বাংলাদেশ-ভারত সীমান্তে হত্যাকাণ্ড বাড়ার কারণ, কংগ্রেস সরকারের আমলে ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনী (বিএসএফ) প্রাণঘাতী নয়, এমন অস্ত্র (নন-লেথাল উইপন) ব্যবহার করত। ২০১৪ সালের পর (মোদির সরকার) বিএসএফ আবার প্রাণঘাতী অস্ত্র (লেথাল উইপন) ব্যবহার শুরু করে।
মঞ্চ বলছে সীমান্ত হত্যা প্রসঙ্গে ভারত সরকারের অবস্থানের মৌলিক পরিবর্তন ঘটেছে। মনমোহন সিংয়ের নেতৃত্বাধীন কংগ্রেস সরকারের সময় দুই দেশ সীমান্তে প্রাণঘাতী অস্ত্রের ব্যবহার সীমিত করে সীমান্ত রক্ষা বাহিনীর দ্বারা নিরস্ত্র ব্যক্তির হত্যাকাণ্ড শূন্যে নামিয়ে আনতে একমত হয়েছিল। কিন্তু ২০১৪ সালে নরেন্দ্র মোদির সরকার ক্ষমতা গ্রহণের পর প্রাণঘাতী অস্ত্রের ব্যবহার সীমিত করার অবস্থান বদলে গেছে। এর পরিণতিতে সীমান্তে খুন বেড়েছে।
সীমান্ত হত্যার বিষয়ে প্রকৃত তথ্য তুলে ধরার দাবি জানিয়ে মঞ্চ বলেছে, সীমান্ত হত্যায় জড়িত খুনে-মানসিকতা সম্পন্ন রক্ষীদের বিচারের আওতায় আনতে হবে। সীমান্ত হত্যার ঘটনায় বিচারহীনতার সংস্কৃতির চর্চা থেকে সরে আসতে হবে। তাদের কঠোর শাস্তির আওতায় আনতে হবে।
সংগঠনটি বলেছে, ‘সীমান্তে হত্যা হঠাৎ বেড়েছে বলে আমাদের পরিসংখ্যান বলছে। যদিও দুই প্রধানমন্ত্রী সীমান্তে হত্যা কমে যাওয়া নিয়ে সন্তুষ্টি প্রকাশ করেছেন।’
সীমান্তে মানব পাচার, পশু চোরাচালান ও মাদক চালানের মতো অবৈধ কর্মকাণ্ড দুই দেশের সীমান্তরক্ষী বাহিনীর মদদ ছাড়া সম্ভব নয় বলেও মাসুমের বিবৃতিতে দাবি করা হয়।
কিন্তু দুই দেশের প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্য বা বিবৃতিতে এ প্রসঙ্গে আলোকপাত না করার বিষয়টিকে হতাশাজনক উলেখ করে সীমান্তে প্রতিবছর কত মানুষকে হত্যা করা হচ্ছে, তার বিস্তারিত পরিসংখ্যান দাবি করেছে সংগঠনটি।
মনমোহন সিংয়ের নেতৃত্বাধীন কংগ্রেস সরকারের সময় দুই দেশ সীমান্তে প্রাণঘাতী অস্ত্রের ব্যবহার সীমিত করে সীমান্ত রক্ষা বাহিনীর দ্বারা নিরস্ত্র ব্যক্তির হত্যাকাণ্ড শূন্যে নামিয়ে আনতে একমত হয়েছিল। কিন্তু ২০১৪ সালে নরেন্দ্র মোদির সরকার ক্ষমতা গ্রহণের পর প্রাণঘাতী অস্ত্রের ব্যবহার সীমিত করার অবস্থান বদলে গেছে। এর পরিণতিতে সীমান্তে খুন বেড়েছে।
নানা সময়ে বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি) ও ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনী বিএসএফের শীর্ষ পর্যায়ের সম্মেলনে সীমান্তে নন-লিথ্যাল উইপন (প্রাণঘাতী নয়) অস্ত্র ব্যবহারের সিদ্ধান্ত হয়। সীমান্ত হত্যা শূন্যের কোঠায় নামিয়ে আনার ব্যাপারে সদিচ্ছার কথাও বলেন নীতিনির্ধারকরা। এমনকি উভয় দেশের মধ্যে রাজনৈতিক পর্যায়ের আলোচনায়ও সীমান্ত হত্যা শূন্যে নামিয়ে আনতে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল ভারত; কিন্তু বাস্তবে তার প্রতিফলন খুব কমই চোখে পড়ছে। সম্প্রতি বাংলাদেশ-ভারত সীমান্তে হত্যার ঘটনা উদ্বেগ বাড়িয়ে তুলেছে।
সীমান্তে নিরস্ত্র বাংলাদেশি নাগরিকদের বেআইনিভাবে হত্যায় বাংলাদেশের উদ্বেগের বিষয়টি নয়াদিল্লিতে খুবই কম গুরুত্ব পেয়েছে। এখনও পর্যন্ত কোনো বাংলাদেশিকে হত্যার অভিযোগে অভিযুক্ত বিএসএফ সদস্যের বিবরণ বাংলাদেশকে দেয়নি ভারত। ভারত সরকারের কোনো সুনির্দিষ্ট অনুমোদন না থাকলে অন্যান্য নিরাপত্তা বাহিনীর পাশাপাশি বিএসএফকেও ফৌজদারি কার্যবিধির বাইরে রাখা হয়। বিএসএফ সদস্যদের এমন জবাবদিহিতার বাইরে থাকাই সীমান্ত হত্যার ঘটনাগুলোকে বাড়িয়ে দিচ্ছে।
ভারত সরকারের সবুজ সংকেত ছাড়া এভাবে সীমান্তে হত্যাকাণ্ড বেড়ে যাওয়ার কথা নয় বলে মনে করছেন আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশ্লেষকরা। ভারত সরকার যেহেতু বাংলাদেশকে কৌশলগত বন্ধু হিসেবে তুলে ধরে, সেক্ষেত্রে সীমান্তে হত্যার নির্দেশ কে দিচ্ছে, কিংবা সেই হত্যা বন্ধে কার্যকর পদক্ষেপ নিতে কে ভারত সরকারকে বাধা দিচ্ছে বাংলাদেশকে এটা খুঁজে বের করতে হবে বলে মনে করছেন তারা।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, কেবল রাজনৈতিক ইচ্ছাশক্তিই সীমান্তে হত্যার সংখ্যা হ্রাস করতে পারে। গোটা দেশের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশ্লেষকরা এ প্রশ্নে একমত যে, কেবল ভারতের রাজনৈতিক নেতৃত্বকে বাংলাদেশের সরকার বাধ্য করতে পারলেই সীমান্ত হত্যা বন্ধ করা সম্ভব হতে পারে।
সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, সীমান্ত হত্যার পেছনেও ঐতিহাসিক রাজনৈতিক সন্দেহ রয়েছে। ভারত ছোট দেশকে সব সময় ছোট করেই রাখতে চায়। তাই সীমান্ত হত্যাসহ বিভিন্ন সমস্যা সমাধান হচ্ছে না। বাংলাদেশ ও ভারতের সম্পর্ক শুধু কাগজে কলমে। তাই ভারতের ক্ষমতাসীনদের মধ্যে বাংলাদেশকে দাবিয়ে রাখার প্রবণতা লক্ষ্য করা যায়।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৮১৪
আপনার মতামত জানানঃ