সরকার নির্ধারিত দামের চেয়ে বেশি দামে দেশের বিভিন্ন এলাকায় সার বিক্রি হচ্ছে। আবার কোথাও কোথাও চাহিদা অনুযায়ী সার পাচ্ছেন না কৃষক। ডিলাররা বলছেন, চাহিদার তুলনায় কম বরাদ্দ দেওয়ায় দেশের কোথাও কোথাও সাময়িক সময়ের জন্যে সারের সংকট দেখা যাচ্ছে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে সাব ডিলাররা সারের দাম বেশি রাখছেন। আবার ডিলারের কাছ থেকে কিনে নিয়ে কেউ কেউ বেশি দামে সার বিক্রি করছেন।
তবে সরকার বলছে, দেশের কোথাও সারের সংকট নেই। বাড়তি দামে সার বিক্রিরও কোনো সুযোগ নেই।
সারাদেশের কৃষকদের অভিযোগ, চাহিদা অনুযায়ী সার পাচ্ছেন না তারা। আর যেখানে পাচ্ছেন, সেখানে থেকে বেশি দামে কিনতে হচ্ছে। এতদিন এই সংকট শুধু ইউরিয়াতে থাকলেও এখন সেটি মিউরেট অব পটাশ বা এমওপিতেও দেখা যাচ্ছে।
রংপুর, বগুড়া, দিনাজপুর, রাজশাহী, জামালপুর, বরিশাল, বরগুনাসহ বিভিন্ন জেলার কৃষকদের সঙ্গে কথা বলে দেশের গণমাধ্যম জানায়, সরকার ইউরিয়া সারের দাম ৬ টাকা বাড়ানোর পর ৫০ কেজির বস্তার দাম হয় ১ হাজার ১০০ টাকা। কিন্তু বাজারে কৃষককে এই সার কিনতে হচ্ছে অঞ্চলভেদে ১ হাজার ৩০০ থেকে ১ হাজার ৪০০ টাকায়।
কৃষি মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, দেশে সারের কোনো ঘাটতি নেই, কিন্তু অসাধু ব্যবসায়ীরা দাম বাড়াতে কৃত্রিম সংকট তৈরি করেছে।
ডিলাররা বর্তমানে ৫০ কেজির একটি বস্তা থেকে ১০০ টাকা কমিশন পান। তবে জ্বালানির দাম বৃদ্ধিকে কেন্দ্র করে জীবনযাত্রার ব্যয় বাড়ার কারণ দেখিয়ে তারা এই কমিশন ২০০ টাকা করার দাবি জানিয়েছেন।
তেলের দাম বাড়ানোর পর ডিলারদের পরিবহন খরচ বেড়েছে মাত্র ১৫ থেকে ২০ পয়সা। অর্থাৎ, ৫০ কেজির বস্তা পরিবহনের খরচ বেড়েছে ১০ টাকা।
কৃষি মন্ত্রণালয় বলছে, চাহিদার বিপরীতে দেশে সব রকমের সারের পর্যাপ্ত মজুদ রয়েছে। বর্তমানে ইউরিয়া সারের মজুদ ৬ লাখ ৪১ হাজার মেট্রিক টন, টিএসপি ৪ লাখ ১৫ হাজার টন, ডিএপি ৯ লাখ ০৪ হাজার টন, এমওপি ২ লাখ ৪৬ হাজার টন রয়েছে।
সারের বর্তমান মজুদের বিপরীতে সেপ্টেম্বর থেকে অক্টোবর মাস পর্যন্ত সারের চাহিদা হলো- ইউরিয়া ৩ লাখ ৫০ হাজার টন, টিএসপি ৯৬ হাজার টন, ডিএপি ২ লাখ ১৯ হাজার টন, এমওপি ১ লাখ ২১ হাজার টন।
সারের দাম বৃদ্ধির পেছনে পুরোটাই ডিলারদের কারসাজি বলে মনে করছে কৃষি মন্ত্রণালয়। মন্ত্রণালয় ডিলারদের আশ্বস্ত করেছিল, তাদের জন্য কমিশনের একটি নতুন বর্ধিত হার পরবর্তীতে নির্ধারণ করা হবে; সে পর্যন্ত যেন বিদ্যমান হারেই সার বিক্রি চালিয়ে যান তারা। কিন্তু অসাধু ডিলাররা মন্ত্রণালয়ের সেই আবেদনে কর্ণপাত না করেই যথেচ্ছভাবে দাম বাড়িয়েছে।
বোঝাই যাচ্ছে কৃত্রিমভাবে সারের সংকট সৃষ্টি করা হচ্ছে। বিষয়টি অত্যন্ত উদ্বেগজনক। কারণ এখন চলছে আমনের মৌসুম। এ সময় কৃষকরা সার না পেলে উৎপাদন কমে যাওয়ার আশঙ্কা প্রবল।
এদিকে রংপুরের পীরগঞ্জে ইউরিয়া সারের দাবিতে মহাসড়ক অবরোধ করে বিক্ষোভ মিছিল করেছেন কৃষকরা। এতে প্রায় পৌনে এক ঘণ্টা রংপুর-ঢাকা মহাসড়কে যান চলাচল বিঘ্নিত হয়। পরে স্থানীয় প্রশাসনের আশ্বাসের পরিপ্রেক্ষিতে অবরোধ তুলে নেন বিক্ষুব্ধ কৃষকরা।
শনিবার (১০ সেপ্টেম্বর) সকালে উপজেলার রামনাথপুর ইউনিয়নে রংপুর-ঢাকা মহাসড়কের পীরগঞ্জ বাজারে এ বিক্ষোভ করেন তারা।
বিক্ষোভে অংশ নেওয়া কৃষক নাসির উদ্দীন, কবিরুল, এহসামুল, শরিফুল, মাহমুদসহ অনেকেই অভিযোগ করে বলেন, ১০ দিন ধরে খুচরা দোকান ও ডিলারের কাছে ধরনা দিয়েও এক কেজি ইউরিয়া সার জোগাড় করতে পারেননি তারা। দেড় হাজার টাকা দিয়েও ইউরিয়ার বস্তা পাওয়া যাচ্ছে না।
তাদের অভিযোগ, এবার অনাবৃষ্টির কারণে আমন চাষ পিছিয়ে গেছে। কষ্ট করে সেচ দিয়ে চারা রোপণ করতে পারলেও এখন সার পাওয়া যাচ্ছে না। দু’এক দিনের মধ্যে জমিতে সার দিতে না পারলে ফসল পুষ্ট হবে না। ফলনে প্রভাব পড়বে। তাই বাধ্য হয়ে সারের জন্য সড়কে নামতে বাধ্য হয়েছেন।
কৃষক ইব্রাহিম মন্ডল বলেন, হামার পীরগঞ্জোত ইউরিয়া সার এ্যলা সোনার হরিণ। সারা দিনেও একটা বস্তা সার পাওয়া যাওচে না বাহে। অথচ বস্তা প্রতি ১৪০০-১৫০০ টাকা দিলেই ফির সার মিলছে। সার নিয়্যা মারাত্মক সিস্টেম চলোছে। অথচ কৃষি বিভাগ কওছে, এত্তি নাকি সার সংকট নাই।
জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধি এবং ডিলারদের কারসাজিতে দেশের বিভিন্ন স্থানে সারের বাজার অস্থির। সরকার নির্ধারিত মূল্যের চেয়েও বেশি দামে বিক্রি হচ্ছে ইউরিয়া ও এমওপি সারসহ বিভিন্ন সার। অনেক জায়গায় চাহিদামতো সার পাচ্ছেন না কৃষক। আমনের ভরা মৌসুমে সার সংকটে উদ্বিগ্ন তারা। এছাড়া সার নিয়ে ডিলারদের লুকোচুরির অভিযোগও পাওয়া গেছে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বোঝাই যাচ্ছে কৃত্রিমভাবে সারের সংকট সৃষ্টি করা হচ্ছে। বিষয়টি অত্যন্ত উদ্বেগজনক। কারণ এখন চলছে আমনের মৌসুম। এ সময় কৃষকরা সার না পেলে উৎপাদন কমে যাওয়ার আশঙ্কা প্রবল। বর্তমান বৈশ্বিক পরিস্থিতিতে খাদ্যনিরাপত্তার বিষয়টি অন্য যে কোনো সময়ের চেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ।
আর এ সময়েই যদি কৃষকরা সার না পান, তাহলে তারা ধান উৎপাদনে নিরুৎসাহিত হবেন, এটাই স্বাভাবিক। আর এর নেতিবাচক প্রভাব পড়বে খাদ্যনিরাপত্তায়। কাজেই বিষয়টিতে জরুরি ভিত্তিতে দৃষ্টি দেওয়া প্রয়োজন বলে মনে করেন তারা।
তারা বলেন, শুধু সার নয়, দেশে নানা অপকৌশলে ভোক্তাদের ঠকানো ছাড়াও কারসাজি ও যোগসাজশের মাধ্যমে বিভিন্ন পণ্যের দাম বাড়িয়ে দেওয়ার ঘটনা ঘটছে অহরহ। এবার আমনের মৌসুমে যারা কারসাজি করে সারের বাজার অস্থির করে তুলেছে, তাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে, এটাই কাম্য।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৭৪২
আপনার মতামত জানানঃ