দেশব্যাপী আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সাঁড়াশি অভিযান ও ইয়াবা ব্যবসায়ীদের আত্মসমর্পণের পরও থামছে না ইয়াবা পাচার। বরং নতুন নতুন কৌশল বের করছে ইয়াবা ব্যবসায়ীরা। বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়া রোহিঙ্গাদের ইয়াবার ‘বাহক’ হিসেবে কাজে লাগাচ্ছে তারা। ‘নিরাপদ এলাকা’ হিসেবে রোহিঙ্গা শিবিরে চলছে এ মাদকের ব্যবসা।
রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশকে কেন্দ্র করে বাংলাদেশে ইয়াবার পাচার, মাদকসংক্রান্ত সহিংসতা, তথাকথিত বন্দুকযুদ্ধ ও অবৈধ অস্ত্রের প্রাপ্যতা বেড়েছে। বাংলাদেশে এখন প্রতিদিন ৭০ লাখ ইয়াবা বিক্রি হয়, যার আর্থিক মূল্য ২১০ কোটি টাকার মতো। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সেন্টার ফর জেনোসাইড স্টাডিজের প্রকাশিত ‘পিস রিপোর্টে’ এসব কথা বলা হয়।
তবে ইয়াবা ও ক্রিস্টাল মেথ আইস বিক্রির টাকা ব্যাংক কিংবা লকারে রাখার সুযোগ নেই রোহিঙ্গাদের। তাই তারা সোনা কিনে রাখাকেই নিরাপদ মনে করেন। অন্যদিকে বাংলাদেশের চেয়ে পার্শ্ববর্তী দেশ মিয়ানমারে সোনার দাম ভরিতে পাঁচ-সাত হাজার টাকা কম। সে কারণে লাভের আশায় মিয়ানমার থেকে চোরাইপথে সোনা আনছেন রোহিঙ্গারা। এসব সোনা ছড়িয়ে পড়ছে কক্সবাজার, চট্টগ্রামসহ দেশের বিভিন্ন বাজারে।
প্রথম আলো থেকে জানা যায়, সর্বশেষ গত ২৫ আগস্ট কক্সবাজারের উখিয়া উপজেলার পালংখালী ইউনিয়নের কাস্টমস মোড় এলাকায় তল্লাশি চালিয়ে ৩ কেজি ৩২২ গ্রাম ওজনের ২০টি সোনার বারসহ এক ব্যক্তিকে গ্রেপ্তার করে বিজিবি। কবির আহমদ (৩০) নামের ওই ব্যক্তির বাড়ি বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলার ঘুমধুম ইউনিয়নের তুমব্রু এলাকায়।
জানা গেছে, সর্বশেষ সোনা উদ্ধারের ঘটনার আগে গত ৮ মাসে কেবলমাত্র নাইক্ষ্যংছড়ির ঘুমধুম, উখিয়ার রহমতের বিল, পালংখালী সীমান্তে অভিযান চালিয়ে ১৭১ কোটি টাকা মূল্যের ৫৬ লাখ ৮১ হাজার ইয়াবা, ৭০ কোটি ১০ লাখ টাকা মূল্যের ১৪ কেজি ২০ গ্রাম আইস এবং ২ কোটি ৭২ লাখ টাকা মূল্যের ৩ কেজি ৩২৩ গ্রাম ওজনের ২৪টি সোনার বার উদ্ধার করেছে বিজিবি। এ সময় গ্রেপ্তার করা হয় ৭৫ জন চোরাকারবারিকে।
টেকনাফ ২ বিজিবি গত এক বছরে উদ্ধার করেছে ৪৬৩ কোটি টাকার মাদকদ্রব্য। এ সময় গ্রেপ্তার করা হয় ৩৩৩ জন মাদক কারবারিকে। উদ্ধার করা মাদকের মধ্যে ইয়াবা ৪০ লাখ ৩২ হাজার পিস ও আইস ৫৪ কেজি ৫৭০ গ্রাম। এ ছাড়াও এ সময়ে সোনা উদ্ধার করা হয়েছে ২১ কেজি ৮০৭ গ্রাম।
গত ১৪ জুন উখিয়ার বালুখালী আশ্রয়শিবিরের (ক্যাম্প-৮ ইস্ট) বি-ব্লকের সিদ্দিক আহমদের বসতঘরে তল্লাশি চালায় ৮ আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়ন (এপিবিএন)। এ সময় ঘরের মেঝেতে লুকিয়ে রাখা ৩ লাখ ২৩ হাজার পিস ইয়াবা এবং ১৮ ভরি স্বর্ণালংকার, ২ লাখ ৫৮ হাজার ৫২০ টাকা ও ১ হাজার ২৩৫ মিয়ানমারের মুদ্রা (কিয়াট) উদ্ধার করে বিজিবি। অভিযানে সিদ্দিক আহমেদের স্ত্রী আনোয়ারা বেগমসহ (২৯) তিনজনকে গ্রেপ্তার করা হয়।
মিয়ানমারে সোনার দাম ভরিতে পাঁচ-সাত হাজার টাকা কম। সে কারণে লাভের আশায় মিয়ানমার থেকে চোরাইপথে সোনা আনছেন রোহিঙ্গারা। এসব সোনা ছড়িয়ে পড়ছে কক্সবাজার, চট্টগ্রামসহ দেশের বিভিন্ন বাজারে।
এর আগে ১৯ জুন ১৪ এপিবিএন কুতুপালং আশ্রয়শিবিরের এ–ব্লকের বাসিন্দা মোহাম্মদ আইয়ুব আলীর ঝুপড়িঘরে তল্লাশি চালিয়ে উদ্ধার করে ৩টি সোনার বারসহ ৭০ ভরি ওজনের স্বর্ণালংকার, ২৬ লাখ ৩ হাজার টাকা ও ৩১ লাখ ৭৪ হাজার ৮০০ কিয়াট। এ সময় আইয়ুব আলী (৩৮) ও তার স্ত্রী নুরুনেসাকে (৩২) গ্রেপ্তার করা হয়।
কক্সবাজারে এ পর্যন্ত সোনার সবচেয়ে বড় চালানটি ধরা পড়েছে গত বছরের ৯ আগস্ট। ওই দিন উখিয়ার টিভি টাওয়ারের সামনে থেকে ২ কোটি ৯১ লাখ ৪০ হাজার টাকা মূল্যের ৪৭০ ভরি ওজনের ৩৩টি সোনার বারসহ মো. জয়নুল আবেদিন (৬৫) নামের এক ব্যক্তিকে গ্রেপ্তার করে কক্সবাজার ৩৪ বিজিবি। তিনি নাইক্ষ্যংছড়ি শূন্যরেখায় গড়ে ওঠা আশ্রয়শিবিরের বাসিন্দা। বিজিবি জানায়, মিয়ানমার থেকে সোনার চালান নিয়ে জয়নুল উখিয়ার আশ্রয়শিবিরে যাচ্ছিলেন। জয়নুল আবেদিন তখন পুলিশের জিজ্ঞাসাবাদে বলেছিলেন, সোনা ও মাদক বিক্রির টাকা হুন্ডির মাধ্যমে মিয়ানমারে পৌঁছানো হয়।
রোহিঙ্গা নেতারা বলেন, মাদকের টাকা ছাড়াও বিদেশ থেকে হুন্ডির মাধ্যমে রোহিঙ্গাদের কাছে বিপুল টাকা আসে। আশ্রয়শিবিরগুলোর ভেতরে গড়ে ওঠা ৩৭ হাজারের বেশি দোকানপাটে দৈনিক ৫ থেকে ৭ কোটি টাকা লেনদেন হয়। এই টাকা ও স্থানীয় শ্রমবাজার থেকে আয়ের টাকা জমা রাখার ব্যবস্থা নেই। তাই রোহিঙ্গাদের কাছে মিয়ানমারের সোনার কদর বেশি। রাখাইন রাজ্যে থাকতেও রোহিঙ্গারা টাকার পরিবর্তে সোনার মজুত গড়তেন।
১৪ এপিবিএনের অধিনায়ক (সদ্য খাগড়াছড়িতে বদলি) ও পুলিশ সুপার মো. নাইমুল হক প্রথম আলোকে বলেন, মাদক বিক্রির টাকায় রোহিঙ্গারা সোনার বার কিংবা স্বর্ণালংকার কিনে রাখছে। শুরুর দিকে আশ্রয়শিবিরে স্বর্ণালংকার বেচাবিক্রির বেশ কিছু দোকান ছিল। এপিবিএন আশ্রয়শিবিরের দায়িত্ব নেওয়ার পর (২০২০ সালের ১ জুন) দোকানগুলো সরিয়ে নেওয়া হয়। এখন আশ্রয়শিবিরের বাইরে টেকনাফ-কক্সবাজার সড়কের কাছে বেশ কিছু জুয়েলারি দোকান রয়েছে। বাংলাদেশিরা এসব পরিচালনা করে।
মাদক নিয়ন্ত্রণ কর্মকর্তারা বলছেন, রোহিঙ্গাদের অনুপ্রবেশের পর থেকে ইয়াবার পাচার বেড়ে গেছে। যে কারণে ২০১৬ সালের তুলনায় ২০১৭ ও ২০১৮ সালে অনেক বেশি ইয়াবার চালান ও পাচারকারী ধরা পড়েছে। আবার রোহিঙ্গা শিবিরকে নিরাপদ মনে করে অনেক ইয়াবা কারবারি সেখানে আশ্রয় নিয়েছে। এই সময়ে উখিয়া ও টেকনাফ থানায় রোহিঙ্গা শরণার্থীদের বিরুদ্ধে দায়ের হওয়া মাদক মামলার সংখ্যাও শতাধিক।
বিশ্লেষকরা বলছেন, বাংলাদেশের সামনে ‘রোহিঙ্গা’ বিষয় একটি বড় ধরনের জটিল চ্যালেঞ্জ হতে যাচ্ছে, যা দ্বিপক্ষীয় আলোচনায় সমাধান সম্ভব নয়। কূটনৈতিক আলোচনার পাশাপাশি রোহিঙ্গা নেতৃত্বের বিকাশ ঘটিয়ে বিকল্প পথের সরকারের সব আন্তরিক প্রচেষ্টা সহজে কার্যকর হচ্ছে না। রোহিঙ্গা সমস্যা বাংলাদেশেরই নয়, সমগ্র বিশ্বের উদার গণতান্ত্রিক এবং মানবাধিকার রক্ষাকারী চ্যাম্পিয়নদের সামনে বড় চ্যালেঞ্জ।
সংশ্লিষ্ট বিশ্লেষকরা বলেন, রোহিঙ্গাদের মিয়ানমারে ফিরিয়ে নিতে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় যত দেরি করবে, খুনসহ নানা রকম সমস্যা তত বাড়বে। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের উচিত হবে মিয়ানমার সরকারের ওপর বড় ধরনের চাপ তৈরি করে এ সমস্যার সমাধান করা।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৩৪৫
আপনার মতামত জানানঃ