ইউক্রেনের থেকে মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছে ইউরোপ। যদিও বিশ্ব মিডিয়া ইউরোপকে ইউক্রেনের বিপদের বন্ধু হিসেবে চিত্রিত করছে। লিবারেল মিডিয়ায় দেখাচ্ছে, ইইউ নেতারা পুতিনের সঙ্গে সমঝোতার চেষ্টা করছেন, রাশিয়ার আক্রমণাত্মক পদক্ষেপের সমালোচনা করছেন, মার্কিন নিষেধাজ্ঞার সঙ্গে সহমত জানাচ্ছেন এবং আরও অনেক বিষয়েই কঠোর অবস্থান নিয়েছেন।
এর পাশাপাশি ইউরোপীয় ইউনিয়ন কীভাবে ইউক্রেনকে সংকটের মুহূর্তে সহায়তার চেষ্টা করছে এবং বিভিন্ন দেশের নাগরিকরা পালিয়ে আসা ইউক্রেনীয়দের সমর্থন দিয়ে যাচ্ছেন, তা ঘটা করে প্রচার করা হচ্ছে পশ্চিমা গণমাধ্যমে। এবং সবচেয়ে মজার বিষয় হলো, পশ্চিমা মিডিয়ায় বলা হচ্ছে, ইউক্রেন পশ্চিমাদের সামরিক সহায়তার ওপর ভর করে রুশ বাহিনীকে প্রতিনিয়ত দুর্বল করে চলেছে। বাস্তবতা হলো, ইউরোপের দেশগুলো এখন ইউক্রেনের ব্যাপারে প্রায় পুরোপুরোই উদাসীন হয়ে উঠেছে।
ভয়াবহ বিপদে ইইউ
গবেষণা সংস্থা রিস্ট্যাড এনার্জির একজন সিনিয়র বিশ্লেষক ফ্যাবিয়ান রনিনজেনের মতে, ইউরোপের জ্বালানি সঙ্কট ‘ভীতিকর’ আকার নিয়েছে এবং সমস্যাগুলো এটিকে আরও খারাপের দিকে নিয়ে যাচ্ছে৷
‘সঙ্কটের স্কেলে এক থেকে দশের মধ্যে আমি সম্ভবত এতে আট দেব,’ রনিনজেন ইনসাইডারকে বলেছেন, ‘আমি মনে করি এ মুহুর্তে সমস্যাটি খুবই গুরুতর।’ রাশিয়ার ইউক্রেনে অভিযানের মাধ্যমে ইউরোপের জ্বালানি সঙ্কট শুরু হয়েছে এবং পশ্চিমা নিষেধাজ্ঞার কারণে সমস্যাটি আরও গভীর হয়েছে। এই শীতে জার্মানি, ফ্রান্স এবং অন্যান্যদের সরবরাহের ঘাটতি নিয়ে উদ্বেগ রয়েছে৷
নিষেধাজ্ঞার বিরুদ্ধে স্পষ্ট প্রতিশোধ হিসেবে, রাশিয়া নর্ড স্ট্রিম ১ পাইপলাইনের মাধ্যমে ইউরোপে প্রাকৃতিক-গ্যাসের প্রবাহ কমিয়েছে মাত্র ২০ শতাংশ, তারা দামও বাড়িয়েছে। রাশিয়ার রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন জ্বালানি জায়ান্ট গ্যাজপ্রম বলেছে যে, ইউরোপীয় প্রাকৃতিক-গ্যাসের দাম এই শীতকালে আরও ৬০ শতাংশ বাড়তে পারে কারণ এই অঞ্চলে রপ্তানি আরও কমেছে।
রাশিয়ার বিরুদ্ধে ইউরোপে দেওয়া নিষেধাজ্ঞা যে খোদ ইউরোপকেই ক্ষতিগ্রস্ত করেছে তা আর উপেক্ষা করার উপায় নেই। ডলারের বিপরীতে ইউরো এক দশকের মধ্যে সর্বনিম্নে নেমে এসেছে। ইউরোপের মুদ্রাস্ফীতি পৌঁছেছে নজিরবিহীন পর্যায়ে। মস্কোর গ্যাস নিষেধাজ্ঞা ইউরোপীয়দের ফেলেছে চরম সংকটের মুখে। জ্বালানির অভাবে শিল্প কারখানার অগ্রগতি প্রায় থমকে গেছে ইউরোপে। অনেক দেশেই বেশ কয়েকটি কোম্পানি ইতোমধ্যে বন্ধ হয়ে গেছে এবং আরও অনেকগুলো একই পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে যাচ্ছে।
রাশিয়া নর্ড স্ট্রিম ১ পাইপলাইন থেকে ৮০ শতাংশ আমদানি কমিয়ে দেওয়ার পরে গ্যাসের ঘাটতিতে পড়ে ইউরোপের দেশগুলো। জ্বালানি কোম্পানিগুলো ইতোমধ্যেই ১.৩ ট্রিলিয়ন মার্কিন ডলার ঋণ নিয়ে দেউলিয়া হওয়ার পথে। ইউক্রেন সংকটের আগে যে পরিমাণ জ্বালানি আমদানি হতো ইউরোপে, যদি শীত আসার আগেই সেই মাত্রা পুনরুদ্ধার করা না যায়, তাহলে চরম বিপদের সম্মুখীন হবে এই অঞ্চলের দেশগুলো।
এসবের পরেও খেরসন অঞ্চলে এখনও রুশ বাহিনীর ওপর পাল্টা আক্রমণ চালাচ্ছে ইউক্রেন। এমনকি, ইউরোপ কিয়েভে আর কোনো অস্ত্র পাঠাবে না যেন যুদ্ধ তাড়াতাড়ি শেষ হয়, এমন গুঞ্জন শোনার পরেও ইউক্রেন তাতে কর্ণপাত করছে না।
তবে দেরিতে হলেও ইউরোপ এখন নিজের স্বার্থ সম্পর্কে সচেতন। অন্যথায়, আসন্ন বিপর্যয় থেকে কোনোভাবেই বাঁচতে পারবে না এ অঞ্চল।
অস্ত্র দিচ্ছে না ইউরোপ
কিয়েল ইনস্টিটিউট ফর ওয়ার্ল্ড ইকোনমির সাম্প্রতিক তথ্য অনুযায়ী, ইউরোপের ছয়টি বড় দেশ গেল জুলাই জুড়ে ইউক্রেনকে নতুন কোনো দ্বিপাক্ষিক সামরিক প্রতিশ্রুতি দেয়নি। ফেব্রুয়ারিতে রাশিয়ার বিশেষ সামরিক অভিযান শুরু হওয়ার পর এই প্রথম ইউরোপের দেশগুলো ইউক্রেনের জন্য সামরিক সহায়তা দেওয়া থেকে বিরত থেকেছে।
দেশগুলোর তালিকায় রয়েছে পোল্যান্ড, ফ্রান্স, জার্মানি, স্পেন, ইতালি এবং যুক্তরাজ্য। সুতরাং বোঝাই যাছে, ইউরোপীয় প্রতিরক্ষা নীতিতে ঐতিহাসিক পরিবর্তনের পরও সে অঞ্চল থেকে ইউক্রেনে সামরিক সহায়তা ক্রমেই হ্রাস পাচ্ছে। ফ্রান্স এবং জার্মানির মতো আগে থেকেই অনিচ্ছুক দেশগুলো ইউক্রেনে গোলাবারুদ পাঠাতে আরো বেশি অনাগ্রহী হয়ে উঠেছে।
ক্রিস্টোফ ত্রেবেশের নেতৃত্বে ইনস্টিটিউটের ‘ইউক্রেন সাপোর্ট ট্র্যাকার’ দলের সংগৃহীত তথ্য অনুসারে, ইউক্রেনের প্রতি ইউরোপীয় সামরিক সহায়তার প্রতিশ্রুতি এপ্রিলের শেষ থেকে উল্লেখযোগ্যভাবে হ্রাস পাচ্ছে।
ক্রিস্টোফ বলেন, “যুদ্ধটি বর্তমানে জটিল পর্যায়ে প্রবেশ করেছে, অথচ তা সত্ত্বেও নতুন করে সামরিক সহায়তার উদ্যোগ অনেকটাই কমে গেছে।”
বড় দেশগুলোর ইউক্রেনের ব্যাপারে এমন উদাসীনতা এটিই প্রমাণ করে যে, ইউরোপের কোনো দেশ এখন আর মৃত ঘোড়ার ওপর চাবুক চালাতে আগ্রহী নয়।
ইউরোপীয় দেশগুলোর এমন মুখ ফিরিয়ে নেওয়ার একটি বড় কারণ হলো, ইউক্রেনে দুর্নীতির উদ্বেগ।
দুর্নীতি
ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনালের দুর্নীতি সূচকে তৃতীয় স্থানে রয়েছে ইউক্রেন। সংস্থাটির তথ্যমতে, ইউক্রেন এখন অবৈধ অস্ত্র পাচারের কেন্দ্রে পরিণত হয়েছে।
যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য এবং অন্যান্য ন্যাটোভুক্ত দেশগুলো রাশিয়ার বিরুদ্ধে ইউক্রেনকে যেসব অস্ত্রশস্ত্র সরবরাহ করেছিল, তা অনেকাংশেই পাচার হয়েছে, চলে গেছে ডার্ক ওয়েব বা কালো বাজারে।
ইউক্রেনীয় ব্যবসায়ীরা ডার্ক ওয়েবে শুধু ছোট অস্ত্র বা বডি আর্মারই নয়, বরং জ্যাভলিন এবং এনএলএডব্লিউ অ্যান্টি-ট্যাঙ্ক সিস্টেম বা ফিনিক্স গোস্ট এবং সুইচব্লেড বিস্ফোরক ড্রোনের মতো অত্যাধুনিক অস্ত্রও পাচার করেছে বলে তথ্য প্রমাণ রয়েছে।
ইসরায়েলি সাইবার-গোয়েন্দা বিশেষজ্ঞ সংস্থা কেইএলএ’র তথ্যমতে, পশ্চিমাদের কাছ থেকে সাহায্য পাওয়া অস্ত্র পাচারের জন্য ইউক্রেনীয়রা বেশ কয়েকটি ডার্কনেট মার্কেটে পোস্ট করেছে। এমনকি, একজন বিক্রেতা যুক্তরাষ্ট্রের সরবরাহকৃত জ্যাভলিন এটিজিএম অ্যান্টি-ট্যাঙ্ক মিসাইল সিস্টেমটির দাম হাঁকিয়েছিল ৩০ হাজার মার্কিন ডলার। বিক্রেতা নিজের অবস্থা জনিয়েছিল ইউক্রেনের রাজধানী কিয়েভে।
ইন্টারপোলের সেক্রেটারি জেনারেল জার্গেন স্টক ইতোমধ্যে পরিস্থিতির গুরুত্ব সম্পর্কে সতর্ক করেছেন। স্টকের মতে, ফেব্রুয়ারিতে রাশিয়ার আগ্রাসনের সময় ইউক্রেনে পাঠানো অস্ত্রগুলো কালো বাজারে চলে যাবে এবং শেষ পর্যন্ত তা সন্ত্রাসীদের হাতে গিয়ে পড়বে।
তিনি বারবার সতর্ক করেছেন, রাশিয়া যুদ্ধ শেষ করার সঙ্গে সঙ্গেই কালো বাজার এসব অত্যাধুনিক অস্ত্র ও গোলাবারুদে ভরে যাবে। তিনি ইন্টারপোলের সদস্য দেশগুলোকে, বিশেষ করে যারা অস্ত্র সরবরাহ করে থাকে, তাদেরকে এসব অস্ত্র খুঁজে বের করতে সহযোগিতার আহ্বান জানিয়েছেন।
এসডব্লিউ/এসএস/০৭৩০
আপনার মতামত জানানঃ