সোমবার উত্তরায় বিআরটি প্রকল্পের বক্স গার্ডার পড়ে একটি প্রাইভেট কারের ৫ জন নিহত হয়েছেন৷ এটাই প্রথম কোন দুর্ঘটনা না৷ এর আগেও শুধু বিআরটি প্রকল্পে নানা দুর্ঘটনা ঘটেছে৷ ১০ বছর আগে চট্টগ্রামের বহদ্দারহাটে ঘটেছিল প্রথম গার্ডার দুর্ঘটনা৷
২০১২ সালে দু’দফায় চট্টগ্রামের বহদ্দারহাটের ফ্লাইওভারের গার্ডার ভেঙে পড়েছিল৷ প্রথমবার ওই বছরের ২৯ জুন সেখানে ১৩০ ফুট দীর্ঘ কংক্রিটের গার্ডার ভেঙে পড়ে একজন রিকশাচালক আহত হয়েছিলেন৷
এরপর ওই বছরের ২৪ নভেম্বর ওই ফ্লাইওভারেরই তিনটি গার্ডার ভেঙে পড়ে ২৯ জন নিহত হয়েছিলেন৷ ওই ঘটনায় আহত হয়েছিলেন আরও অনেকে৷
ওই সময় চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের নির্বাহী প্রকৌশলী, নির্মাণকাজে জড়িত মীর আক্তার অ্যান্ড পারিশা ট্রেড সিস্টেমসের (যৌথ মালিকানা) কর্মকর্তাসহ মোট ২৫ জনের বিরুদ্ধে মামলা করে পুলিশ৷ তবে সেই মামলা এখনও চলছে৷
সরকারি কোনো প্রকল্পের নির্মাণকাজে নিরাপত্তার বিষয়টি একেবারেই গুরুত্ব দেওয়া হয় না৷ কেন এই অবহেলা? এ প্রসঙ্গে বুয়েটের দুর্ঘটনা গবেষণা ইনস্টিটিউটের পরিচালক অধ্যাপক মো. হাদিউজ্জামান বলেন, ‘‘কারণ কারও জবাবদিহি নেই৷ আমরা কি কাউকে এই অবহেলার দায়ে শাস্তি দিতে পেরেছি? পারিনি৷ তাহলে এগুলো বন্ধ হবে কীভাবে? শাস্তি নিশ্চিত করলে এই অবহেলা কমে আসবে৷ আমি তো মনে করি, উত্তরায় যেটা হয়েছে সেটা কোনভাবেই দুর্ঘটনা নয়, এটা অবহেলাজনিত হত্যাকাণ্ড৷’’
উল্লেখ্য, উত্তরার ঘটনায় সোমবার রাতেই সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগের অতিরিক্ত সচিব নীলিমা আক্তারকে প্রধান করে একটি তদন্ত কমিটি করা হয়৷ ওই কমিটিকে মঙ্গলবার সকালের মধ্যেই প্রাথমিক রিপোর্ট দিতে বলা হয়েছিল৷ সেই রিপোর্ট পাওয়ার পর মঙ্গলবার বিকেলে প্রেস ব্রিফিং করেছেন সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগের সচিব এ বি এম আমিন উল্লাহ নুরী৷
তিনি রিপোর্টের প্রসঙ্গ উল্লেখ করে বলেছেন, “এখানে চারটি কারণ তারা উল্লেখ করেছে৷ ঠিকাদারের গাফিলতি তো ছিলই৷ তার সঙ্গে ছুটির দিন কাউকে কিছু না জানিয়ে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান কেন কাজ করতে গেল সেই প্রশ্নের উত্তরও মেলেনি৷ কারণ ছুটির দিন তাদের কাজ করার কথা না৷ ন্যূনতম পুলিশের ট্রাফিক বিভাগকে তাদের জানানো উচিৎ ছিল৷ মূল তদন্ত রিপোর্ট পাওয়ার পর ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে সর্বোচ্চ ব্যবস্থা নেওয়া হবে৷”
তদন্ত কমিটির প্রধান অতিরিক্ত সচিব নীলিমা আক্তার বলেন, “আমরা প্রাথমিক রিপোর্ট দিয়েছি৷ সেটার প্রেক্ষিতে সচিব মহোদয় ব্রিফ করেছেন৷ আমাদের পুরো অবজারবেশনই তিনি বলেছেন৷”
এদিকে, ঢাকার উত্তরায় বাস র্যাপিড ট্রানজিট (বিআরটি) প্রকল্পের গার্ডার পড়ে হতাহতের এই ঘটনায় ‘অবহেলাজনিত মৃত্যুর’ অভিযোগে মামলা হয়েছে ঠিকাদার কোম্পানি, ক্রেন চালক এবং প্রকল্পের নিরাপত্তার দায়িত্বপ্রাপ্তদের বিরুদ্ধে৷ নিহত ফাহিমা আক্তার ও ঝরনা আক্তারের ভাই মো. আফরান মণ্ডল বাবু সোমবার রাতে উত্তরা পশ্চিম থানায় এ মামলা করেন৷
উত্তরা পশ্চিম থানার ওসি মোহাম্মদ মোহসীন বলেন, “মামলায় অবহেলার কারণে প্রাণহানির অভিযোগ করা হয়েছে৷ ক্রেইন চালকের পাশাপাশি প্রকল্পের অন্যতম ঠিকাদার কোম্পানি চায়না গ্যাঝুবা গ্রুপ করপোরেশনের (সিজিজিসি) সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি এবং নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণে দায়িত্বপ্রাপ্ত অজ্ঞাত ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে এই মামলা করা হয়েছে৷ দুর্ঘটনার সময় যিনি ক্রেন চালাচ্ছিলেন, তাকে গ্রেপ্তারে পুলিশ কাজ করছে৷
মঙ্গলবার ঘটনাস্থল পরিদর্শন করে বিআরটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক সফিকুল ইসলাম বলেন, “আমরাও চাই পর্যাপ্ত নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে৷ আমাদের যে যে জায়গায় উন্নতি করতে হবে, সেগুলো ঠিক করতে হবে৷ কীভাবে নিরাপত্তা এনশিওর করব, সেগুলো নিয়ে বৃহস্পতিবার মেয়রের সঙ্গে বৈঠক করব৷” তবে তিনি বক্স গার্ডার দুর্ঘটনায় পাঁচজনের মৃত্যুর দায় নিতে রাজি হননি৷
ঘটনাস্থলে তিনি সাংবাদিকদের জানিয়েছেন, এই প্রকল্পের কাজ আপাতত বন্ধ থাকবে৷ জনসাধারণের নিরাপত্তার বিষয়টি নিশ্চিত করার পর এ কাজ আবার শুরু হবে৷ তিনি বলেন, নিরাপত্তা বেষ্টনি তৈরি না করে ভারী যন্ত্র সরানোর সময় সেটি প্রাইভেট কারের ওপর পড়ে যাওয়ার ঘটনায় স্পষ্টতই অবহেলা ছিল কর্মীদের৷ তদন্ত কমিটিই ঠিক করবে দায় কার৷
প্রসঙ্গত, আগেও একই ধরনের দূর্ঘটনা ঘটেছে। গত বছরের ১৪ মার্চ ঢাকার শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর এলাকায় বিআরটি প্রকল্পের একটি গার্ডার লঞ্চার ভেঙে তিন চীনা কর্মীসহ ৬ জন আহত হন৷
এরপর দুই মাসের বেশি সময় পড়ে থাকার কারণে দুর্ভোগ পোহাতে হয় ওই পথে চলাচলকারীদের৷ ওই বছরের ১৮ জুন ক্রেনটি মেরামত করে সচল করা হয়৷ গত ১৫ জুলাই গাজীপুরে বিআরটি প্রকল্পের নির্মাণাধীন ফাইওভারের ‘লঞ্চিং গার্ডার’ চাপায় প্রকল্পটির এক নিরাপত্তারক্ষী নিহত হন৷ ওই ঘটনায় আরও আরেক শ্রমিক ও একজন পথচারী আহত হন৷
২০১৭ সালের ১২ মার্চ রাতে ঢাকার মালিবাগ রেলগেইট এলাকায় নির্মাণাধীন মগবাজার-মৌচাক ফাইওভারের ৩৬ মিটার দীর্ঘ গার্ডার ভেঙে পড়ে৷ রেললাইনের উপরের ওই ঘটনায় একজন শ্রমিকের মৃত্যু হয়৷ একটি করে পা হারান আরও ২ জন৷
বারবার একইভাবে দুর্ঘটনা ঘটছে৷ কিন্তু কেন ব্যবস্থা নেওয়া যায় না? জানতে চাইলে সড়ক ও জনপথ বিভাগের সাবেক প্রধান প্রকৌশলী আব্দুস সবুর বলেন, “এখানে স্পষ্টই অবহেলা থাকে৷ তা না হলে দুর্ঘটনা ঘটে না৷ একটি প্রতিষ্ঠান যখন কাজ করে তখন নিরাপত্তার বিষয়ে বেশ কিছু নির্দেশনা থাকে৷ সেটা তারা মানে না বলেই দুর্ঘটনা ঘটে৷ যারা সুপারভিশনের দায়িত্বে থাকেন বিষয়টি নিশ্চিত করার দায়িত্ব তাদের৷”
অধ্যাপক হাদিউজ্জামান নিরাপত্তা-বেষ্টনি ছাড়া আরও তিনটি প্রশ্ন তুলেছেন এই নির্মাণকাজ নিয়ে৷ তিনি বলেন, ক্রেন ঠিক আছে কি না৷ তার আগে দেখতে হবে ক্রেন যে অপারেট করছিল, তার লাইসেন্স আছে কি না৷ সে অভিজ্ঞ কি না, এটাও তদন্তের মাধ্যমে দেখতে হবে৷ আমার গার্ডারের যে ওজন এবং ক্রেনের যে সমতা, সেটা ঠিক আছে কি না৷ এই জিনিসটাও গুরুত্বপূর্ণ৷ এখানে প্রশাসনিক অবহেলা আছে বলেও মনে করেন এই বিশেষজ্ঞ৷
তবে সড়ক বিভাগের নতুন সচিব এবিএম আমিন উল্লাহ নুরী বলেছেন, যে ক্রেনটি দিয়ে গার্ডার তোলা হচ্ছিল সেটার ধারণ ক্ষমতা ৮০ টন৷ আর গার্ডারটি ওজন ছিল ৭০ টন৷ রাস্তায় কাজ চলার কারণে উঁচু-নিচু ছিল৷ ক্রেনের একদিক উঁচুতে ছিল, আরেকদিক নিচুতে ছিল৷ ফলে এটা উল্টে যায়৷ ওই ক্রেনটাই কিন্তু পরে গার্ডার সরিয়েছে৷
এসডব্লিউ/এসএস/০৭৩৯
আপনার মতামত জানানঃ