জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে মাত্র এক ঘণ্টার অপারেশনে নৃশংসভাবে হত্যা করে ঘাতকরা। সেই অল্প সময়েই খুন করে ১৮ জনকে। সেই বর্বরোচিত হত্যাকান্ড পাষন্ড ঘাতকদের হাত থেকে রেহাই পায়নি শিশু রাসেল, শিশু বাবু, এমনকি অস্তঃসত্ত্বা বধূও। ১৯৭৫ সালের ১৪ আগস্ট সন্ধ্যা থেকে ১৫ আগস্ট ভোর ৬টা পর্যন্ত চলে এক নৃশংস রাজনৈতিক হত্যাযজ্ঞ। যার শিকার বঙ্গবন্ধু পরিবারও।
সবচেয়ে বিশাল ও ভারি যে লাশটি বাংলাদেশ নিজের বুকের কবরে বয়ে চলেছে, সেটি মুজিবের লাশ’—হুমায়ুন আজাদ এ একটি উক্তির মাধ্যমেই শেখ মুজিবের হত্যাকাণ্ডের প্রগাঢ়তা এবং ব্যাপকতা উল্লেখ করা যায়। বিশ্বের ইতিহাসে রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ড অসংখ্যবার ঘটেছে, ভবিষ্যতেও হয়তবা ঘটতে পারে কিন্তু শেখ মুজিবের হত্যাকাণ্ডের প্রভাব বাংলাদেশ কখনও কাটিয়ে উঠতে পারেনি।
বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের বিষয়ে একটি পপুলার ধারণা বিদ্যমান রয়েছে, তিনি বিশ্বাসই করতে পারেননি তাকে হত্যা করা হতে পারে। এই ধারণা বঙ্গবন্ধুকে মহিমান্বিত করার জন্য সত্য। কিন্তু একজন রাজনীতিক হিসেবে তার দূরদর্শিতাকে যে দুর্বল করা হচ্ছে সেটি বিবেচনায় রাখা হয় না। বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ড ১৫ আগস্ট ঘটলেও এর আগেই তাকে ন্যূনতম তিনবার হত্যার চেষ্টা করা হয়েছে এবং সেটি তার জানার কথা।
বঙ্গবন্ধু হত্যার পর রাজনীতিতে বেনিফিয়ারি কারা, কেনইবা তাকে খুন করা হয়েছিল, কেনইবা তার ওপর খুনিরা এত ক্ষিপ্ত হলো, এসব প্রশ্নের ভেতর দিয়ে উত্তর খোঁজা যেতে পারে। অ্যান্থনি মাসকারেনহাস—১৫ অগাস্ট যারা সরাসরি খুনে অংশ নিয়েছিল তাদের একটা ইন্টারভিউ নিয়েছিলেন। সেখানে খুনি রশিদের সাথে যেসব কথা হয়েছিল এর অংশবিশেষ হচ্ছে—
অ্যান্থনি মাসকারেনহাস: তোমরা মুজিবকে শোধরানোর জন্য চেষ্টা করেছিলে কিনা?
রশিদ: না, আমি কোনো চেষ্টা করিনি। কারণ আমি ছিলাম সেনাবাহিনীর জুনিয়র কর্মকর্তা আমার কোনো সুযোগ ছিল না তাকে সঠিক পথে পরিচালিত হওয়ার কথা বলা।
অ্যান্থনি মাসকারেনহাস: এই পরিস্থিতিতে তুমি কি তাঁকে পদত্যাগ করতে বলতে পারতে না? নাকি এটা খুব জরুরি ছিল তাঁকে হত্যা করা?
রশিদ: তিনি ছিলেন সকল কিছুর কেন্দ্রবিন্দু। তিনি একজন প্রশাসক ছিলেন না। তার ভালো ক্ষমতা ছিল জনগণকে নিয়ন্ত্রণে রাখার। তিনি জীবিত থাকলে আমাদের পক্ষে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করা খুবই কঠিন হতো। কেননা তিনি ছিলেন অনেক অভিজ্ঞ রাজনীতিক। তিনি যে কোনো সিদ্ধান্ত নিতে দ্বিধা করতেন না।
অ্যান্থনি মাসকারেনহাস: এই কারণেই কি তোমরা তাঁকে হত্যা করো?
রশিদ: হ্যাঁ, এ কারণেই তাকে হত্যা করি। আমার তাকে মারতেই হতো।
এবার দেখি বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের পর খুনি ডালিম কী বলছে। মেজর ডালিম রেডিও স্টেশন দখল করে বাংলাদেশকে একটি ইসলামিক প্রজাতন্ত্র হিসেবে ঘোষণা দিয়েছিলেন। পরদিন জুলফিকার আলী ভুট্টোও ইসলামিক রিপাবলিক অব বাংলাদেশের প্রেসিডেন্টকে স্বাগত জানান এবং এই ধারণা সৌদি আরবকেও দেওয়ার চেষ্টা করেন। ’৭২ সালের সংবিধানে ‘ধর্মনিরপেক্ষতা’কে স্থান দেওয়ায় ক্ষেপেছিলেন কট্টর ধর্মাশ্রয়ী দলগুলো। পঁচাত্তরের একুশে আগস্ট খোন্দকার মোশতাক নিজের কালো রঙের টুপিকে জাতীয় টুপি ও তার জামাকে (গলাবন্ধ ফুলহাতা আচকান বা শেরওয়ানি) সরকারি পোশাক হিসেবে ঘোষণা করেন। রেডিওতে রবীন্দ্র সঙ্গীত ও গীতা থেকে শ্লোক পাঠ বন্ধ করে দেওয়া হয়। গীতা পাঠ পরে আবার চালু করা হয়। ভাষণের শেষে জয় বাংলার বদলে বাংলাদেশ জিন্দাবাদ ব্যবহার শুরু হয়। দেশের নাম বদলে ইসলামিক রিপাবলিক অব বাংলাদেশ করার পরিকল্পনা করা হলেও পরে বাতিল করা হয়। এই কয়েকটি প্রবণতার মধ্য দিয়েই বোঝা যায়, বঙ্গবন্ধুর খুনিরা ‘বাঙালি জাতীয়তাবাদ’-এর বিকাশ চাননি এবং তারা এটির রাজনৈতিকভাবেই বিরোধী। বঙ্গবন্ধুকে হত্যার আট দিনের মধ্যে সেনাবাহিনীর প্রধান হন জিয়া!
আরেকটি বিষয় ছিল বঙ্গবন্ধুর আমলে বাকশাল গঠন। এই বাকশাল গঠনকেও অনেকে দায়ী করেন। এটা সত্য, এ হত্যাকাণ্ডে বিছিন্ন সামরিক একটি শক্তির সঙ্গে বেসামরিক শক্তিরও একটা যোগসাজশ ছিল। এই শক্তি যে বাঙালি জাতীয়তাবাদ বিরোধী সেটি না বোঝার কথা নয়। আসুন বাকশাল নিয়ে ডিটেইলে কিছু কথা জানা যাক।
স্বাধীনতা পরবর্তী বাংলাদেশের রাজনৈতিক অবস্থা অত্যন্ত অস্থিতিশীল এবং বিশৃঙ্খল ছিল। এর কারণ স্বাধীনতাবিরোধী চক্রের তৎপরতা। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর মার্কিন দূতাবাসের দায়িত্ব নেয় ইউজিন বোস্টার। দায়িত্ব নিয়ে পরদিনই খন্দকার মোশতাকের সঙ্গে দেখা করে। এদের যৌথ কর্মকান্ড শুরু হয়ে গিয়েছিল তখন থেকে। অন্যদিকে চীনাপন্থি বাম সংগঠন এবং নকশালরাও শুরু করে খুন, ধর্ষণ এবং লুট-পাট। এরা সাধারণ মানুষের হয়রানি করা শুরু করেছিল। আবার ছাত্রলীগও দুভাগে ভাগ হয়ে গিয়েছিল। শফিউল আলম প্রধান ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক হয়ে আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে কথা বলতে শুরু করেছিল।
এই বৈরী পরিবেশেই বাংলাদেশের সংবিধান প্রণয়ন হয়েছিল। সংবিধানের মূলনীতি ছিল- বাঙালি জাতীয়তাবাদ, সমাজতন্ত্র, গণতন্ত্র এবং ধর্মনিরপেক্ষতা। মওলানা ভাসানী এই সংবিধানেরও বিরোধিতা করেছিলেন।
এ সময় প্রকৃতিও বৈরী হয়েছিল। বন্যায় সারা দেশ তলিয়ে গিয়েছিল, ধ্বংস হয়েছিল মানুষের বসতবাড়ি, প্রাণ হারিয়েছিল অসংখ্য মানুষ। মারা গিয়েছিল লাখ লাখ গবাদিপশু, ধ্বংস হয়েছিল জমির ফসল। সড়ক এবং ট্রেন যোগাযোগ হয়েছিল বিচ্ছিন্ন। এই অবস্থায় নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসের দাম বেড়ে গিয়েছিল। বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক দাতা সংস্থার সাহায্য চেয়েও পাননি। মজুদদাররা প্রয়োজনীয় খাদ্য বাজারে ছাড়ল না। এই সুযোগে মোশতাকসহ সব বিরোধীপক্ষ বঙ্গবন্ধু সরকারের বিরোধিতা শুরু করেছিল এবং জনগণের মধ্যে অসন্তোষের আগুন জ্বালিয়ে দেওয়ার কাজ শুরু করেছিল গোপনে। এই অবস্থা সামাল দিতে তিনি বাকশাল গঠনের সিদ্ধান্ত নেন। যেন অবাধ্য সন্তানকে কঠোর হাতে দমন করে ভালো পথে আনার কৌশল। তিনি বাকশালের মাধ্যমে সরাসরি জনগণের সঙ্গে সম্পৃক্ত হতে চেয়েছিলেন।
ক্রমবর্ধমান অস্থিরতার মুখে ২৮ ডিসেম্বর ১৯৭৪ শেখ মুজিবুর রহমান জরুরি অবস্থা জারি করেন, যা তাকে কোনো রাজনৈতিক নিষেধাজ্ঞা আরোপের ক্ষমতাপ্রধান করে। ১৯৭৫ সালের ২৫ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধু সংবিধানের চতুর্থ সংশোধনী উত্থাপন করেন। এই সংশোধনীর মাধ্যমে দেশে প্রচলিু সংসদীয় শাসনব্যবস্থা বাতিল করে বাকশালব্যবস্থা চালু করা হয়।
বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠাতা রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিবুর রহমানের যে পদক্ষেপ নিয়ে এখনও সবচেয়ে বেশি বিতর্ক হয়, সেটি হচ্ছে একদলীয় শাসন ব্যবস্থা প্রবর্তন করা। এই শাসন ব্যবস্থা বাকশাল নামে পরিচিত। দেশটির সংবিধানে চতুর্থ সংশোধনীর মাধ্যমে বহুদলীয় সংসদীয় সরকার পদ্ধতি বিলুপ্ত করে রাষ্ট্রপতি শাসিত সরকার ব্যবস্থা প্রবর্তন করা হয়েছিল ১৯৭৫ সালের ২৫শে জানুয়ারি।
বাকশাল তৈরির পটভূমি নিয়ে আলোচনায় বিশ্লেষকদের অনেকের কথায় সেই সময়কার নৈরাজ্যকর একটা পরিস্থিতির কথা উঠে আসে। সেই পরিস্থিতির দায় কার, তা নিয়েও নানা আলোচনা রয়েছে।
লেখক ও গবেষক বদরুদ্দিন উমর বলেছেন, শেখ মুজিবের জন্য তার দল আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের দুর্নীতি একটা বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছিল। অন্যদিকে দলের একটি অংশ বেরিয়ে যাওয়ার পর সরকার নিয়ন্ত্রণহীন হয়ে পড়েছিল।”
তখন বিরোধীদের ওপর নিবর্তনমূলক ব্যবস্থা নিয়েও পরিস্থিতি সামলাতে না পেরে শেখ মুজিব সব ক্ষমতা নিজের হাতে নিয়ে বাকশাল গঠন করেছিলেন।
“ঐ সময় প্রশাসন থেকে শুরু করে আওয়ামী লীগ দল ইত্যাদির মধ্যে একটা ভাঙন তৈরি হয়েছিল। যে ভাঙনটা তথাকথিত আওয়ামী লীগের যে সংগঠন ছিল, সেটা দিয়ে সামাল দেয়া সম্ভব ছিল না।”
“সেখানে তাদের সহমতের দল সিপিবিসহ অন্যদের নিয়ে একটা সংগঠন করা দরকার ছিল এবং যেটা সামাল দিতে পারে। শেখ মুজিব তা মনে করেছিলেন। সেজন্যই তিনি বাকশাল করেছিলেন।”
আওয়ামী লীগের একটা অংশ বেরিয়ে গিয়ে বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার কথা বলে জাসদ নামের দল গঠন করেছিল ১৯৭২ সালের অক্টোবরে। দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে সর্বহারা বা চরমপন্থী কিছু বামদলের সশস্ত্র তৎপরতাও চলছিল। আওয়ামী লীগের নেতারা সে সময়ের নৈরাজ্যকর পরিস্থিতির জন্য জাসদ এবং চরমপন্থী দলগুলোর ওপরই দায় চাপিয়ে থাকেন।
আওয়ামী লীগ নেতা নূহ আলম লেনিন বাকশাল প্রতিষ্ঠার সময় আওয়ামী লীগের মিত্র কমিউনিস্ট পার্টির রাজনীতিতে ছিলেন।
উনিশশো চুয়াত্তর সালের ১৭ই মার্চ ঢাকার রমনা এলাকায় তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মনসুর আলীর বাসভবন ঘেরাও করেছিল জাসদ। তখন সেখানে গোলাগুলি হয়েছিল এবং হতাহত হয়েছিল অনেক মানুষ।
এর আগে দু’বছর ধরে অনেক রাজনৈতিক নেতা-কর্মীকে হত্যা, খাদ্য ও পাটের গুদামে আগুন, থানা লুটের মতো নাশকতা চলছিল দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে।
আওয়ামী লীগের একজন বর্ষীয়ান নেতা ডা. এস এ মালেক বলছিলেন, সেই সময়ের পরিস্থিতি বহুদলীয় গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় সামাল দেয়া সম্ভব ছিল না।
“সেদিন ৭২-এর সংবিধান প্রণয়ন করে সংসদের নির্বাচন দিয়ে সংসদীয় পদ্ধতির সরকার হলো। কিন্তু আমরা কি দেখলাম? একদিকে সংসদীয় অবাধ গণতন্ত্র অন্যদিকে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর বাড়ি আক্রমণ। পাঁচজন সাংসদকে মেরে ফেলে দেয়া হলো। রেল লাইন তুলে ফেলা হলো। এবং স্বাধীনতা বিরোধী শক্তি সেখানে তৎপর হলো।”
তিনি আরও বলেছেন, “এই পরিস্থিতিতে আমার মতে, বঙ্গবন্ধুর পক্ষে সংসদীয় গণতন্ত্র দিয়ে দেশ শাসন করা সম্ভব ছিল না। সেজন্য তিনি বাকশালের মাধ্যমে জাতীয় ঐক্যের কথা বললেন। তিনি সকলকে ঐক্যবদ্ধ করে উন্নয়ন কর্মসূচি নিয়ে এগুতে চেয়েছিলেন।”
তবে এই মতামত বিরোধিতাও করেছে অনেকে। অনেক বিশেষজ্ঞের মতে, উনিশশো পচাত্তর সালের ৭ই জুন যখন বাংলাদেশ কৃষক শ্রমিক আওয়ামী লীগ বা বাকশাল প্রতিষ্ঠা করা হয়, তখন বিলুপ্ত করা হয়েছিল আওয়ামী লীগসহ সব রাজনৈতিক দল। রাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রণে চারটি পত্রিকা রেখে বাকি সব পত্রিকা বন্ধ করে দেয়া হয়েছিল।
বদরুদ্দিন উমর বলেছেন, বাকশাল ছিল একনায়কতন্ত্র, সেজন্য মানুষ তা গ্রহণ করেনি। বাকশাল গঠনের পরে দেশের ওপর ফ্যাসিস্ট জুলুম আরম্ভ হয়ে গিয়েছিল। সব দলকে বন্ধ করে দিয়ে, নিষিদ্ধ করে দিয়ে, সব খবরের কাগজ নিষিদ্ধ করে দিয়ে লোকজনকে ধরপাকড় করে ব্যাপকভাবে জুলুম করেছিলেন।
উমর মনে করেন, কৃষক-শ্রমিকের সাথে বাকশালের কোনো সম্পর্ক ছিল না। এটা কি সহজ জিনিস নাকি সমস্ত সংবাদপত্র বন্ধ করে দিলাম। হাজার হাজার লোককে জেলে দিলাম। এটা কি খেলনা জিনিস? সেজন্যই লোকে মনে রাখে এবং সমালোচনা করে। তবে শেখ মুজিব বাকশালকে দ্বিতীয় বিপ্লব হিসাবে ঘোষণা করেছিলেন।
এসডব্লিউ/এসএস/১৫৫০
আপনার মতামত জানানঃ