পাকিস্তানে গুম ও জোরপূর্বক অপহরণের বিষয়টি অনেক পুরনো হলেও সাম্প্রতিক বছরগুলোতে তা ব্যাপকহারে বৃদ্ধি পেয়েছে। যখন যে সরকার ক্ষমতায় থাকে তাদের স্বার্থ রক্ষার্থেই এই নির্মম গুম-অপহরণ কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে পাকিস্তান সেনাবাহিনী ও প্রতিষ্ঠানটির নিয়ন্ত্রণাধীন গোয়েন্দা সংস্থাগুলো।
ক্ষমতাসীনদের তালিকা ধরে বেছে বেছে সরকারবিরোধী রাজনৈতিক নেতাকর্মী, মানবাধিকার কর্মী ও সাংবাদিক গুম অভিযান চালিয়ে যাচ্ছে সংস্থাটি। এ কাজ করে আসছে দেশটির সেনাবাহিনীসহ গোয়েন্দা সংস্থাগুলো। আর এসবের বিচার চেয়ে পরিবারগুলোর করা শান্তিপূর্ণ বিক্ষোভেও দমন-পীড়ন চালাচ্ছে।
অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল পাকিস্তানি কর্তৃপক্ষকে অবিলম্বে জোরপূর্বক নিখোঁজের বিচার চেয়ে পরিবারগুলোর শান্তিপূর্ণ বিক্ষোভের উপর দমন-পীড়ন বন্ধ করার আহ্বান জানিয়েছে। সংস্থাটি বলেছে, জোরপূর্বক গুম আন্তর্জাতিক মানবাধিকার আইনের গুরুতর লঙ্ঘন এবং আন্তর্জাতিক আইনের অধীনে একটি অপরাধ।
‘ব্রেভিং দ্য স্টর্মঃ এনফোর্সড ডিসঅ্যাপিয়ারেন্স অ্যান্ড দ্য রাইট টু প্রোটেস্ট’ শিরোনামের একটি প্রতিবেদনে, মানবাধিকার পর্যবেক্ষণ সংস্থা বলেছে যে, পাকিস্তান সরকারের উচিত অবিলম্বে সমস্ত বন্দিকে গ্রেপ্তার বা আটকের কারণ সম্পর্কে জানানো। তাদের অধিকার সম্পর্কে সম্পূর্ণ তথ্য দেওয়া, যার মধ্যে রয়েছে তাদের আটকের বৈধতা চ্যালেঞ্জ করার জন্য একজন আইনজীবীর নিয়োগ।
প্রতিবেদনে নিখোঁজদের পরিবারের শান্তিপূর্ণ বিক্ষোভ দমন করতে রাষ্ট্রের হয়রানি, ভীতি প্রদর্শন এবং এমনকি সহিংসতার ব্যবহার নথিভুক্ত করা হয়েছে। বিচার ব্যবস্থার মাধ্যমে প্রতিকারের সমস্ত উপায় শেষ করে অনেক পরিবার তাদের প্রিয়জনকে মুক্তি দেওয়ার জন্য বা তাদের অবস্থান সম্পর্কে তথ্যের জন্য কর্তৃপক্ষকে চাপ দেওয়ার জন্য বিক্ষোভে ফিরে আসে।
মানবাদজিকার সংস্থাগুলোর তথ্য মোতাবেক, পাকিস্তানের গোয়েন্দা পরিষেবাগুলো নিয়মিতভাবে মানবাধিকার কর্মী, রাজনৈতিক কর্মী, ছাত্র এবং সাংবাদিকদের টার্গেট করার জন্য জোরপূর্বক গুম করেছে, শত শত নিখোঁজদের ভাগ্য এখনও অজানা।
অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের কাছে বর্ণিত ঘটনাগুলো ইঙ্গিত করে যে, পাকিস্তানের পুলিশ এবং গোয়েন্দা এজেন্টরা শান্তিপূর্ণ বিক্ষোভকে ছত্রভঙ্গ করতে অপ্রয়োজনীয় শক্তি ব্যবহার করেছে। যা আন্তর্জাতিক মানবাধিকার আইন এবং মান লঙ্ঘন করে।
পাকিস্তানের পুলিশ এবং গোয়েন্দা এজেন্টরা শান্তিপূর্ণ বিক্ষোভকে ছত্রভঙ্গ করতে অপ্রয়োজনীয় শক্তি ব্যবহার করেছে। যা আন্তর্জাতিক মানবাধিকার আইন এবং মান লঙ্ঘন করে।
২০০১ সালে আফগানিস্তানে মার্কিন আগ্রাসনের পর পাকিস্তানে গুমের ঘটনা ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পায়। বৃদ্ধি পায় সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড। দেশটির বহু মানুষ শিকার হয় আত্মঘাতী বোমা হামলার।
মোশাররফের আমলেই শুরু হয় যুক্তরাষ্ট্র-পাকিস্তানের সম্মিলিত ‘সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধ’। বহু লোককে সন্ত্রাসী সন্দেহে আটক করে নিয়ে যায় সরকারি বাহিনীগুলো। আটককৃতদের অনেককেই তুলে দেয়া হয় মার্কিন কর্তৃপক্ষের হাতে। বন্দি করে রাখা হয় কুখ্যাত গুয়ানতানামো কারাগারে।
গুমের বিরুদ্ধে কাজ করে এমন মানবাধিকার সংস্থা ডিফেন্স অব হিউম্যান রাইটস পাকিস্তানের চেয়ারম্যান ও খ্যাতনামা মানবাধিকার কর্মী আমিনা মাসুদ জাঞ্জুয়া বলেন, গত দুই দশকে পাকিস্তানে ৫ হাজারের বেশি গুমের ঘটনা ঘটেছে।
অ্যামনেস্টির মতে, ২০১১ সাল থেকে ২০১৮ পর্যন্ত কমিশনের কাছে ৩ হাজার গুমের মামলা এসেছে। গুমের ঘটনাগুলোর বেশিরভাগই সিন্ধু ও বেলুচিস্তানের।
তবে দেশটির বিচারবিভাগ বলছে, এই সংখ্যা অতিরঞ্জিত। যারা এ ঘৃণ্য কর্মকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত সরকারের সেই বাহিনীগুলোর বিরুদ্ধে লিখিত কোনো অভিযোগ বা কোনো পদক্ষেপ নেয়া হয় না।
পাকিস্তান সংবাদমাধ্যম ডন বলছে, কেবল ২০১৬ সালের প্রথম ৭ মাসেই ৫১০টি গুমের রিপোর্ট করেছে পত্রিকাটি। গুমের ঘটনা তদন্ত করতে দেশটিতে কমিশন অব ইনকয়ারি অন এনফোর্সড ডিসঅ্যাপিয়অরান্স নামে একটি তদন্ত কমিশন গঠন করা হয়।
যুক্তরাষ্ট্রের ওকলাহোমা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাউথ এশিয়ান পলিটিক্সের অধ্যাপক আকিল শাহ বলেন, রাজনীতিবিরোধী নেতাদের গুম-অপহরণ সংস্কৃতি এ অঞ্চলের বহুল প্রচলিত ‘পুরাতন ঐতিহ্য। সম্প্রতি বছরগুলোতে এ অপচর্চা আরও বেড়েছে। আর এ জন্য দায়ী সরকার ও তার আজ্ঞাবহ রাষ্ট্রীয় বাহিনী। সরকারি স্বার্থবিরোধী সামাজিক মাধ্যম ও রাজনীতিক, অধিকারকর্মী ও সাংবাদিকদের ওপর সাঁড়াশি অভিযানের মাত্রা বৃদ্ধি করেছে।’
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৫৫৫
আপনার মতামত জানানঃ