কথিত ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাতের অভিযোগে নোয়াখালীর হাতিয়া থানায় করা মামলায় স্কুলশিক্ষকের ৮ বছরের কারাদণ্ড দিয়েছেন আদালত। একই রায়ে তাকে ২০ হাজার টাকা অর্থদণ্ড, অনাদায়ে ৬ মাস বিনাশ্রম কারাদণ্ড দেয়া হয়।
চট্টগ্রাম বিভাগীয় সাইবার ট্রাইব্যুনালের বিচারক মোহাম্মদ জহিরুল কবিরের আদালত সোমবার বিকেলে এই রায় দেয়।
দণ্ডিত শিক্ষকের নাম দেবু দাস। তিনি নোয়াখালীর হাতিয়া থানার বাসিন্দা এবং চৌমুহনী উচ্চ বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক।
গণমাধ্যমকে বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন আদালতের বেঞ্চ সহকারী কামরুল হাসান।
এজাহারের বরাতে তিনি জানান, ২০১৭ সালের ১৫ অক্টোবর ও ২৮ অক্টোবর নিজের ফেসবুক আইডি Debu das Debe das থেকে ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত করে পোস্ট দেন তিনি। এই অভিযোগে ১ নভেম্বর পুলিশ বাদী হয়ে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে তার বিরুদ্ধে মামলা করেন।
কামরুল বলেন, ‘২০১৮ সালের ১০ জুন এই মামলার চার্জ গঠন করা হয়। বিচার শুরুর পর ৮ জন সাক্ষীর সাক্ষ্যগ্রহণ শেষে সোমবার আদালত রায় ঘোষণা করেন। বিচারক রায়ে আসামি দেবু দাসকে ৮ বছর কারাদণ্ড ও ২০ হাজার টাকা অর্থদণ্ড দিয়েছেন। দণ্ডের অর্থ অনাদায়ে আরো ৬ মাসের বিনাশ্রম কারাদণ্ড দিয়েছেন।’
রায় ঘোষণার সময় ওই শিক্ষক আদালতে উপস্থিত ছিলেন বলে জানান তিনি।
রায়ে আসামি দেবু দাসকে ৮ বছর কারাদণ্ড ও ২০ হাজার টাকা অর্থদণ্ড দিয়েছেন। দণ্ডের অর্থ অনাদায়ে আরো ৬ মাসের বিনাশ্রম কারাদণ্ড দিয়েছেন।
বিশ্লেষকরা বলছেন, দেশে কয়েকদিন পরপরেই শোনা যায় কথিত ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাতের ঘটনা। ধর্মীয় অনুভূতির বিষয়টি সম্পূর্ণভাবে আপেক্ষিক। এরপরেও যদি কেউ মনে করে যে কোন ঘটনা তার ধর্মীয় অনুভূতিকে আঘাত করেছে; তাহলে দেশের আইন আদালত সব আছে, তিনি আইনের দারস্থ হতে পারেন। কিন্তু গত কয়েকটি দশকে ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাতের কথা বলে বিভিন্ন সময়ে কথিত অভিযুক্ত ব্যক্তিকে নির্মমভাবে আক্রমণসহ তার ঘরবাড়ি, ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ভাংচুরসহ অগ্নিসংযোগ করে পুড়িয়ে দেয়া হয়েছে। বিষয়টিতে দেশের মানুষের বাকস্বাধীনতা বিশেষ করে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের মানুষের বাকস্বাধীনতা দিনেদিনে হুমকির মুখে পড়ে যাচ্ছে।
প্রচলিত আইনে অনুভূতির সংজ্ঞা এখনও অস্পষ্ট বলে, অনেক আইনজ্ঞদের মতামত দিতে দেখেছি বিভিন্ন সময়ে। ২৯৫ ধারায় জেল-জরিমানার কথা বলা হয়েছে। ২৯৫ এর ‘ক’ ধরার অপরাধ অজামিনযোগ্য। আইনজীবীরা বলছেন, ‘সাম্প্রতিক সময়ে এই আইনের প্রয়োগ হচ্ছে প্রতিপক্ষকে ‘হয়রানির হাতিয়ার’ হিসেবে’।
‘দণ্ডবিধির ২৯৫ এর ‘ক’ ধারা মতে, কোনও শ্রেণির ধর্মীয় বিশ্বাসকে অবমাননা করে ওই শ্রেণির ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত করার উদ্দেশ্যে দুরভিসন্ধিমূলক কাজ করা হলে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি দুই বছর পর্যন্ত কারাদণ্ড বা অর্থদণ্ড বা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হবেন।
ওই ধারায় আরও বলা হয়েছে, ম্যাজিস্ট্রেট মামলা আমলে নিতে পারবেন। আর এ ধারার অপরাধ জামিন-অযোগ্য।
বিশ্লেষকরা বলেন, কোন ধর্মীয় টেক্সটে যদি কোন বিষয়ের উল্লেখ থাকে, সে বিষয়টি নিয়ে লেখালেখি করলেও কি ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত হবে? বিষয়গুলি আমাদের কাছে সুস্পষ্ট নয়। এ কারণেই সমস্যাগুলো দিনেদিনে জট পাকিয়ে যাচ্ছে। জ্ঞানের চর্চা করা মানুষের মধ্যে হতাশা তৈরি হচ্ছে। নারী, অমানবিকতা, বর্বরতা, নৃশংসতার নির্দেশনা যদি কোন ধর্মীয় টেক্সটে থাকে, এরপরেও সে বিষয়টি নিয়ে কথা বলা যাবে কি যাবে না তা আমাদের কাছে পরিস্কার না। আমরা দেখলাম বিষয়গুলোর উপরে একটি অলিখিত নিষেধাজ্ঞা আছে।
আমাদের দেশে বিগত বছরগুলোতে ধর্মীয় অনুভূতি বলতে কেবলমাত্র সংখ্যাগরিষ্ঠের অনুভূতিতেই প্রাধান্য দেয়া হয়েছে। আইনের প্রয়োগের ক্ষেত্রে একটা প্রচণ্ড একচোখা দৃষ্টিভঙ্গি দেখি। সংখ্যাগরিষ্ঠের পক্ষ থেকে যদি কারও নামে ধর্মীয় অনুভূতির অভিযোগ করা হয়, প্রতিটি ক্ষেত্রেই আমরা দেখেছি কথিত অভিযুক্ত ব্যক্তিটি অপরাধ করেছেন কি করেননি এটা যাচাই না করেই আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ না দিয়েই তাকে সাথে সাথে গ্রেপ্তার করা হয়। অভিযুক্ত ব্যক্তিটি যদি সংখ্যালঘু বিশেষ করে হিন্দু সম্প্রদায়ের হয় তাহলে তো কোন কথাই নেই। বিষয়টি দিনে দিনে সংখ্যালঘুদের কাছে শ্বাসরুদ্ধকর হয়ে যাচ্ছে।
তারা বলেন, ‘দেশের সংবিধানে বাকস্বাধীনতা দেওয়া হয়েছে। পরবর্তী সময়ে ডিজিটাল অ্যাক্টসহ যেসব আইন হয়েছে, সেগুলো রক্তের বিনিময়ে অর্জিত স্বাধীনতার মধ্য দিয়ে যে বাকস্বাধীনতা ও গণতন্ত্র অর্জন করেছি, তার সঙ্গে সুস্পষ্টভাবে বিপরীতমুখী ও সাংঘর্ষিক। এগুলো বাকস্বাধীনতার পথকে সংকুচিত করেছে।’
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৪৫৬
আপনার মতামত জানানঃ