ভয়েস কল ও ইন্টারনেট সংযোগে গ্রাহকদের ‘মানসম্মত সেবা দিতে না পারার’ কারণ দেখিয়ে দেশের শীর্ষ মোবাইল ফোন অপারেটর গ্রামীণফোনের নতুন সিম বিক্রির ওপর নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে টেলিযোগাযোগ খাতের নিয়ন্ত্রক সংস্থা। পরবর্তী নির্দেশনা না দেয়া পর্যন্ত গ্রামীণফোন সিম বিক্রি করতে পারবে না।
বুধবার(২৯ জুন) এমন সিদ্ধান্তের কথা জানিয়ে গ্রামীণফোনকে চিঠি দিয়েছে বিটিআরসি। সংস্থাটির ভাইস চেয়ারম্যান সুব্রত রায় মৈত্র গণমাধ্যমকে এই তথ্য নিশ্চিত করেছেন।
সুব্রত রায় মৈত্র বলেন, সেবার মান নিয়ে প্রশ্ন থাকায় অনির্দিষ্টকালের জন্য গ্রামীণফোনের সিম বিক্রি নিষিদ্ধ করা হয়েছে। পরবর্তী নির্দেশ না দেওয়া পর্যন্ত নতুন সিম বিক্রি করতে পারবে না গ্রামীণফোন।
তিনি বলেন, গ্রামীণফোনের বিরুদ্ধে গ্রাহকদের অভিযোগ ছিল। আবার বিটিআরসির পরীক্ষাতেও সেবার মান সন্তোষজনক বলে মনে হয়নি।
বিটিআরসির হিসাব অনুযায়ী, দেশে মোবাইলফোনের সক্রিয় গ্রাহকের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ১৭ কোটি ১ লাখ ৩৭ হাজার। বিটিআরসির মে মাসের প্রতিবেদন বলছে, গ্রামীণফোনের বর্তমান গ্রাহকসংখ্যা ৮ কোটি ৪৯ লাখ ৫০ হাজার।
ডাক ও টেলিযোগাযোগ মন্ত্রী মোস্তাফা জব্বার সংবাদমাধ্যমকে বলেন, আমরা চেষ্টা করেও গ্রামীণফোনের সেবার মান ভালো করার কোনও উদ্যোগ নিতে দেখিনি। তারা গ্রাহক বাড়াবে, কিন্তু সেবার মান বাড়াবে না, এটা হতে দেওয়া যাবে না। যতদিন না তারা সেবার মান ভালো করবে এবং তা সন্তোষজনক পর্যায়ে উন্নীত না হবে ততদিন গ্রামীণফোনের সিম বিক্রিতে নিষেধাজ্ঞা থাকবে।
বুধবার (২৯ জুন) দুপুরে বিষয়টির অনুমোদনের পরে বিটিআরসি এ বিষয়ক একটি নির্দেশনা গ্রামীণফোনে পাঠিয়েছে। অপারেটরটি গ্রাহকদের কোয়ালিটি অব সার্ভিস নিশ্চিত করতে পারলেই নতুন সিম বিক্রি করতে পারবে বলে জানা গেছে।
এ বিষয়ে এক বিবৃতিতে গ্রামীণফোনের হেড অব কমিউনিকেশন খায়রুল বাসার বলেন, বিটিআরসি ও আন্তর্জাতিক সংস্থা আইটিইউ’র সেবার মানদণ্ড অনুসরণ করার পাশাপাশি সেবা প্রদানের ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট মানদণ্ড থেকেও এগিয়ে আছে গ্রামীণফোন। ধারাবাহিকভাবে নেটওয়ার্ক ও সেবার মানোন্নয়নে আমরা বিটিআরসি’র সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে কাজ করছি। নেটওয়ার্ক আধুনিকীকরণে নানা পদক্ষেপ গ্রহণ করেছি। সম্প্রতি অনুষ্ঠিত হওয়া নিলামেও গ্রামীণফোন সর্বোচ্চ অনুমোদিত তরঙ্গ অধিগ্রহণ করেছে। অপ্রত্যাশিত এ চিঠি ও নিষেধাজ্ঞা নিয়ে পরবর্তী পদক্ষেপ নির্ধারণে আমরা পরিস্থিতি মূল্যায়ন করছি। আমরা মনে করি, আমাদের সম্ভাব্য গ্রাহকদের স্বার্থে নিয়ন্ত্রক সংস্থার সঙ্গে গঠনমূলক আলোচনাই হবে এ সমস্যা সমাধানের সর্বোত্তম উপায়।
আমরা চেষ্টা করেও গ্রামীণফোনের সেবার মান ভালো করার কোনও উদ্যোগ নিতে দেখিনি। তারা গ্রাহক বাড়াবে, কিন্তু সেবার মান বাড়াবে না, এটা হতে দেওয়া যাবে না। যতদিন না তারা সেবার মান ভালো করবে এবং তা সন্তোষজনক পর্যায়ে উন্নীত না হবে ততদিন গ্রামীণফোনের সিম বিক্রিতে নিষেধাজ্ঞা থাকবে।
প্রসঙ্গত, গত ৩১ মার্চ অনুষ্ঠিত সর্বশেষ নিলামে সবচেয়ে বেশি তরঙ্গ (৬০ মেগাহার্টজ) কেনে গ্রামীণফোন। এর আগে গ্রামীণফোনের হাতে ছিল ৪৭ দশমিক ৪০ মেগাহার্টজ তরঙ্গ। সব মিলিয়ে অপারেটরটির তরঙ্গের পরিমাণ ১০৭ দশমিক ৪০ মেগাহার্টজ। যদিও বাকি অপারেটরদের মতো গ্রামীণফোনও নতুন বরাদ্দ পাওয়া তরঙ্গ ব্যবহার করতে পারছে না। আগামী ডিসেম্বর থেকে অপারেটরগুলো তরঙ্গ ব্যবহার করতে পারবে বলে জানা গেছে।
জানা যায়, বর্তমানে এক মেগাহার্টজ তরঙ্গে গ্রামীণফোন ১৪ লাখ লাখ গ্রাহককে সেবা দিচ্ছে, অন্যান্য অপারেটরের চেয়েও যা বেশি। নতুন তরঙ্গ যুক্ত হলে তা হবে (এক মেগাহার্টজে) ৭ লাখ ৭০ হাজার গ্রাহক।
যখন তখন কল ও এসএমএস দিয়ে গ্রাহকদের বিরক্ত করা বেসরকারি মোবাইল অপারেটরদের বিরুদ্ধে অভিযোগ দীর্ঘদিনের। দেশের শীর্ষস্থানীয় বেসরকারি মোবাইল ফোন অপারেটর গ্রামীণফোন (জিপি) এখন গ্রাহক হয়রানিতেও শীর্ষস্থান দখল করেছে বলে সম্প্রতি বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশনের (বিটিআরসি) একটি হিসাবে উঠে এসেছে।
বিটিআরসি জানিয়েছে, দেশের ৪টি মোবাইল অপারেটর তাদের গ্রাহকদের দিনে প্রায় ১৫২ কোটি প্রমোশনাল এসএমএস পাঠায়। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি গ্রামীণফোনের এবং সবচেয়ে কম এসএমএস পাঠায় টেলিটক।
হিসাব বলছে— ৪টি মোবাইল অপারেটরের মধ্যে সবচেয়ে বেশি এসএমএস দেয় গ্রামীণফোন। তারা দৈনিক গড়ে ৬৫ কোটি এসএমএস দেয় গ্রাহকদের।
দুর্বল নেটওয়ার্ক, কল ড্রপ, বিরক্তিকর এসএমএস, ইন্টারনেট প্যাকেজ বিড়ম্বনা, কল সেন্টারের গ্রাহক সেবা পেতে ভোগান্তিসহ নানা হয়রানির শিকার হচ্ছেন গ্রামীণফোনের (জিপি) গ্রাহকরা।
জিপির কল ড্রপ যেমন বেড়েছে, পাশাপাশি কিছু সার্ভিসে প্রচণ্ড বিরক্ত হচ্ছেন তারা। এর একটি হচ্ছে সময়ে-অসময়ে পাঠানো অপারেটরটির প্রচারণামূলক এসএমএস। সারাদিন তো আছেই, এমনকি গভীর রাতেও তাদের মোবাইলে এসব এসএমএস আসছে বলে অভিযোগ করছেন ক্ষুব্ধ গ্রাহকরা।
কল ড্রপ বা বিরক্তিকর এসএমএসের বাইরে ইন্টারনেট নিয়েও গ্রাহকদের রয়েছে নানান অভিযোগ। প্যাকেজ থাকার পরও সরাসরি টাকা কেটে নেয়া, ঠিকমতো সংযোগ না পাওয়াসহ বিভিন্ন অভিযোগ তাদের। এসব ব্যাপারে গ্রাহকদের অভিযোগের কোনো সুরাহাও হচ্ছে না।
বিশ্লেষকরা বলেন, ফোর-জি চালুর পর নেটওয়ার্ক ব্যবস্থা দ্রুত সম্প্রসারণ ও উন্নয়নের কথা বললেও দিনদিন আরও খারাপের দিকে যাচ্ছে। সেই সাথে কলড্রপের পরিমাণ ৫ শতাংশের নিচে থাকার শর্ত থাকলেও অপারেটররা তা মানছে না। কোনো ক্ষতিপূরণও প্রদান করছে না। প্রমোশনাল ম্যাসেজের মাত্রা এতটাই বৃদ্ধি পেয়েছে যে গ্রাহকরা মেসেজের যন্ত্রণায় ত্যক্তবিরক্ত। এমনকি গভীর রাতে মেসেজ আসার ফলে অনেক হৃদরোগী আরো অসুস্থ হয়ে পড়ছেন। আমরা মনে করি, নিয়ন্ত্রক সংস্থার দুর্বলতার ফলেই অপারেটররা গ্রাহকদেরকে ভোগাতে সাহস পাচ্ছে।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১২০৪
আপনার মতামত জানানঃ