বাংলাদেশের মানুষ এতদিন বিশ্বের নামকরা অনেক প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠানকে জড়িয়ে গ্রাহকের তথ্য ফাঁস ও বেহাতের নানা ঘটনার কথা শুনেছে। এবার নিজেদের তথ্য বেহাত ও সেই তথ্য দিয়ে প্রতারণার খবর পেলেন বাংলাদেশের নাগরিকরা। আর তথ্য পাচারের এই কেলেঙ্কারির খবরটি এসেছে টেলিকম সংস্থা গ্রামীণফোন থেকে। বেসরকারি মোবাইল ফোন অপারেটর গ্রামীণফোনের তথ্যভাণ্ডার থেকে গ্রাহকের গোপনীয় তথ্য প্রতারক চক্রের কাছে বিক্রির অভিযোগ উঠেছে। এ ঘটনায় প্রতিষ্ঠানটির কর্মকর্তা রুবেল মাহমুদ অনিকসহ চারজনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।
পুলিশ বলছে, এসব তথ্য ব্যবহারের মাধ্যমে চিকিৎসক, প্রকৌশলী, রাজনীতিবিদ, অবসরপ্রাপ্ত সামরিক ও বেসামরিক কর্মকর্তা এবং ধনাঢ্য ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে লাখ লাখ টাকা হাতিয়ে নিয়েছে ওই চক্র। গ্রামীণফোনের তথ্যভাণ্ডারে সংরক্ষিত গ্রাহকের তথ্য বিক্রির অভিযোগ প্রসঙ্গে জানতে প্রতিষ্ঠানটির জেনারেল ম্যানেজার (কমিউনিকেশন) মো. হাসানের মোবাইল ফোনে সংবাদমাধ্যম থেকে একাধিকবার কল করেও সাড়া পাওয়া যায়নি। এমনকি খুদে বার্তা পাঠানো হলেও কোনো জবাব দেননি তিনি।
৯ ডিসেম্বর ২০২০, গতকাল ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) তেজগাঁও বিভাগের একাধিক কর্মকর্তা জানান, গ্রামীণফোনের কাছে সংরক্ষিত তথ্য সংগ্রহ করে প্রতারক চক্র নানা কৌশলে জিম্মি করে অন্তত ২৫ জনের কাছ থেকে কোটি টাকার ওপরে হাতিয়ে নিয়েছে। তবে মান-সম্মানের ভয়ে অধিকাংশই পুলিশের কাছে কোনো অভিযোগ কিংবা মামলা করেননি। সম্প্রতি একাধিক ব্যক্তির কাছ থেকে অভিযোগ পেয়ে তদন্তে নেমে এ চক্রের সন্ধান পায় পুলিশ। এরপর রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় অভিযান চালিয়ে চক্রের প্রধান পারভীন আক্তার নূপুর, তার বড় বোন শেফালী বেগম, গ্রামীণফোনের কাস্টমার সার্ভিস ম্যানেজার রুবেল মাহমুদ অনিক এবং মতিঝিলের পারফেক্ট ট্রাভেল এজেন্সির কর্মচারী শামসুদ্দোহা খান ওরফে বাবুকে গ্রেপ্তার করা হয়।
তেজগাঁও বিভাগের উপকমিশনার (ডিসি) হারুন-অর-রশীদ সংবাদমাধ্যমকে বলেন, ‘গ্রামীণফোন কোম্পানির কর্মকর্তা থেকে শুরু করে তথাকথিত ট্রাভেল এজেন্সি, আইনজীবী মিলে এই চক্র গড়ে উঠেছিল, যাদের সবাইকে আমরা গ্রেপ্তার করেছি। আদালতের মাধ্যমে রিমান্ডে এনে জিজ্ঞাসাবাদ করেছি। তারা তাদের কৃত অপরাধ কর্মকাণ্ডের কথা স্বীকার করেছে আমাদের কাছে। গ্রামীণফোনের যে কর্মকর্তাকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে সে বিষয়ে কোম্পানিকে অবহিত করার প্রক্রিয়া চলছে। পাশাপাশি এই চক্রের মাধ্যমে যারা প্রতারিত কিংবা ব্ল্যাকমেইলের শিকার হয়েছেন তাদের তথ্যও সংগ্রহ করা হচ্ছে।’
তদন্তসংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানান, হাতিরঝিল থানায় হওয়া একটি মামলার আসামি শেফালীকে গত ৩ ডিসেম্বর সন্ধ্যায় মোহাম্মদপুর থানা এলাকা ও বাবুকে রমনা থানা এলাকা গ্রেপ্তার করা হয়। পরদিন নূপুরকে গুলশানের নিকেতন এলাকা থেকে গ্রেপ্তার করা হয়। একইদিন জিজ্ঞাসাবাদের জন্য ১০ দিনের রিমান্ড চেয়ে আসামিদের আদালতে পাঠানো হয়। পরে ৬ ডিসেম্বর নূপুরকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য এক দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করে আদালত। ওই দিনই তাকে হাতিরঝিল থানা হেফাজতে এনে মামলার ঘটনা সংশ্লিষ্ট আলামত উদ্ধারে বের হয়ে রাত সোয়া ৯টার দিকে তার নিকেতনের বাসায় গিয়ে দুটি মোবাইল ফোন, দুটি পাসপোর্ট এবং একটি ভাঁজ করা সাদা কাগজ উদ্ধার করা হয়। ওই কাগজে গ্রামীণফোন সার্ভিস সেন্টারে কর্মরত অনিকের হাতে লেখা ছয় গ্রাহকের ফোন নম্বর, জন্মতারিখ ও জাতীয় পরিচয়পত্র নম্বর লেখা ছিল। ওই ছয়জনের সিম রেজিস্ট্রেশনে ব্যবহৃত ব্যক্তিগত তথ্য (নাম, বাবার নাম, ঠিকানা, জন্মতারিখ, জাতীয় পরিচয়পত্র নম্বর) সংগ্রহ করে মিথ্যা মামলা করার জন্য তৈরি কাগজপত্রও উদ্ধার করা হয়েছে।
কর্মকর্তারা আরও জানান, প্রতারক চক্রের হোতা নূপুর ১০ হাজার টাকার বিনিময়ে গ্রামীণফোন সার্ভিস সেন্টারের কর্মকর্তা অনিকের মাধ্যমে সর্বশেষ ছয়জনের তথ্য সংগ্রহ করে। এর আগেও গোপনীয় তথ্য সরবরাহের জন্য গ্রাহকপ্রতি অনিক দুই হাজার টাকা করে নিয়েছে বলে নূপুর জিজ্ঞাসাবাদে জানিয়েছে। এখন পর্যন্ত অন্তত ২৫ জনের তথ্য পাওয়া গেছে, যারা প্রতারিত হয়েছেন এই চক্রের হাতে। তাদের প্রত্যেকের তথ্য গ্রামীণফোনের তথ্যভাণ্ডার থেকে পাচার হয়েছে বলে জানা গেছে। নূপুরের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, গত ৬ ডিসেম্বর বাড্ডা এলাকা থেকে দুটি মোবাইলসহ অনিককে গ্রেপ্তার করা হয়। নূপুরের বাসা থেকে উদ্ধার হওয়া কাগজে দেওয়া তথ্য নিজ হাতে লেখা এবং ১০ হাজার টাকার বিনিময়ে এ তথ্য বিক্রির কথা জিজ্ঞাসাবাদে স্বীকার করে অনিক। এছাড়া আগেও বেশ কয়েকবার টাকার বিনিময়ে নূপুরের কাছে গ্রাহকের গোপনীয় তথ্য বিক্রির কথাও স্বীকার করে।
আরও জানা যায়, চক্রের সদস্যরা প্রথমে ষাটোর্ধ্ব পদস্থ কর্মকর্তা, ধনাঢ্য ব্যবসায়ী, শিল্পপতিদের মোবাইল ফোন নম্বর সংগ্রহ করে। এরপর কখনো সমাজকর্মী, কখনো সুবিধাবঞ্চিত শিশুদের জন্য তহবিল সংগ্রহে নিয়োজিত কর্মী, কখনো চাকরিপ্রার্থী কিংবা বিভিন্ন অজুহাতে ফোনালাপ শুরু করে। কখনো প্রয়োজন দেখিয়ে সাক্ষাৎ করে। সামান্য হৃদ্যতা হয়ে গেলে ব্যক্তিগত স্পর্শকাতর বা গোপন কথার রেকর্ড জমায় মোবাইল ফোনে। শুরু হয় ব্ল্যাকমেইলের পালা। কারও কাছ থেকে ২ লাখ, কারও কাছ থেকে ৫ লাখ আবার কারও কাছ থেকে ২০ লাখ টাকা হাতিয়ে নিয়েছে তারা।
তেজগাঁও বিভাগের অতিরিক্ত উপকমিশনার হাফিজ আল ফারুক বলেন, এই চক্রের টার্গেটে পড়া বিভিন্ন পদস্থ কর্মকর্তা, ধনাঢ্য ব্যবসায়ী ও শিল্পপতিদের মোবাইল সিম রেজিস্ট্রেশনে ব্যবহৃত বিভিন্ন গোপনীয় তথ্য দিয়ে সহায়তা করত গ্রামীণফোন কর্মকর্তা অনিক। যেকোনো গ্রাহকের তথ্য চক্রের প্রয়োজন অনুসারে সরবরাহ করত সে।
তিনি আরও বলেন, এখন পর্যন্ত আসামিদের জিজ্ঞাসাবাদ ও তদন্তে অন্তত ২৫ জনের তথ্য পাওয়া গেছে যারা এই চক্রের মাধ্যমে লাখ লাখ টাকার প্রতারণার শিকার হয়েছেন। তাদের মধ্যে আছেন চিকিৎসক, প্রকৌশলী, রাজনীতিবিদ, অবসরপ্রাপ্ত সামরিক ও বেসামরিক কর্মকর্তা, ধনাঢ্য ব্যবসায়ী এবং শিল্পপতি। পাশাপাশি সিএনজিচালিত অটোরিকশার চালক, দর্জি, ফলমূল বিক্রেতাও রয়েছেন এ তালিকায়। আলাপচারিতার রেকর্ড বা সিম রেজিস্ট্রেশনে ব্যবহৃত সংগ্রহকৃত তথ্য টার্গেট ব্যক্তির স্ত্রী, সন্তান, পরিচিতজন ও সহকর্মীদের কাছে পাঠিয়ে নূপুরের সঙ্গে তার প্রেম বা বৈবাহিক সম্পর্ক প্রমাণের হুমকি দিয়ে টাকা দাবি করত চক্রটি।
তদন্তকারী পুলিশ কর্মকর্তারা জানান, অনেকেই এই চক্রের সদস্যদের দাবি অনুযায়ী টাকা দিতে গিয়ে নিঃস্ব হয়েছেন। লজ্জায় অনেকেই অভিযোগ করতে চান না। ৭-৮ জন আত্মহত্যা করারও সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন।
এসডাব্লিউ/এমএন/আরা/১৩৪০
আপনার মতামত জানানঃ