একসময়ের সমৃদ্ধ দেশ সিরিয়া এখন রীতিমতো ধ্বংসস্তূপ, যুদ্ধের ভারে শ্রান্ত। ২০১১ সালের মধ্য মার্চে দেশটিতে যে সংকটের সূচনা, তার আজও সমাধান হয়নি। এর মধ্যে পেরিয়ে গেছে ১১ বছর। দেশটিতে শান্তি ফেরেনি। ইউক্রেনে রাশিয়ার হামলা ও যুদ্ধ নিয়ে বিশ্ববাসী সরব, উদ্বেগ-উৎকণ্ঠায় ভুগলেও সিরিয়া নিয়ে উদ্বেগ কম।
সেই সিরিয়া যুদ্ধ নিয়ে জাতিসংঘ মানবাধিকার কার্যালয় একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। সেখানে বলা হয়েছে, দীর্ঘ যুদ্ধে সিরিয়ায় প্রতিদিন গড়ে ৮৪ জনের মৃত্যু হয়েছে। এর মধ্যে শিশুও আছে। মৃত্যুর প্রকৃত সংখ্যা আরও বেশিই হবে। কারণ, এ হিসাব করা হয়েছে কেবল যুদ্ধে সরাসরি যারা মারা গেছে, তাদের ধরে।
জাতিসংঘ মানবাধিকার কার্যালয়ের প্রতিবেদনের সূত্র ধরে আল-জাজিরার খবরে বলা হয়েছে, সিরিয়া যুদ্ধে গত ১০ বছরে ৩০ লাখ ৬ হাজার ৮৮৭ জন সাধারণ মানুষ নিহত হয়েছে। এ সংখ্যা দেশটির যুদ্ধপূর্ব মোট জনসংখ্যার প্রায় ১ দশমিক ৫ শতাংশের সমান।
গতকাল মঙ্গলবার এক প্রতিবেদনে জাতিসংঘ মানবাধিকার কার্যালয় ৮টি তথ্যসূত্রের ভিত্তিতে নিহত হওয়ার এ পরিসংখ্যান দিয়েছে। ২০১১ সালের ১ মার্চ থেকে ২০২১ সালের ৩১ মার্চ পর্যন্ত যুদ্ধের প্রথম ১০ বছরে মানুষের মৃত্যুর আনুমানিক হিসাব দেওয়া হয়েছে এ প্রতিবেদনে। এত মানুষের মৃত্যুতে যুদ্ধে জড়িত পক্ষগুলোর বেসামরিক নাগরিকদের সুরক্ষা দেওয়ার আন্তর্জাতিক মানবাধিকার নীতিকে সম্মান না দেখানোর বিষয়টিও সামনে এসেছে প্রতিবেদনে।
জাতিসংঘের মানবাধিকারবিষয়ক প্রধান মিশেল ব্যাশেলে বলেছেন, এ প্রতিবেদনে সংঘাত-সম্পর্কিত হতাহত হওয়ার পরিসংখ্যানগুলো কেবল বিমূর্ত সংখ্যা নয়, এগুলো পৃথক মানুষের প্রতিনিধিত্ব করছে। এই ৩০৬৮৮৭ সংখ্যাটি বেসামরিক নাগরিকদের প্রত্যেকের হত্যার প্রভাব তাদের পরিবার এবং সম্প্রদায়ের ওপর গভীরভাবে ফেলবে।
প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছে, মৃত্যুর আনুমানিক এই পরিসংখ্যানের চেয়ে প্রকৃত মৃত্যু এখনো আরও বেশিই হবে। কারণ, এই হিসাব কেবল যুদ্ধে সরাসরি যারা মারা গেছে, তাদেরই ধরা হয়েছে। কিন্তু যুদ্ধের প্রভাবে খাবার, পানি কিংবা স্বাস্থ্যসেবা না পেয়ে যাদের পরোক্ষ মৃত্যু হয়েছে, তাদের এ হিসাবে ধরা হয়নি। এমনকি, যুদ্ধে নিহত অবেসামরিক মানুষের (সেনা, পুলিশ, যোদ্ধা ও অন্যান্য) সংখ্যাও এখানে ধরা হয়নি।
এর আগের জাতিসংঘ বলেছিল, ২০২২ সালের ফেব্রুয়ারিতে সিরিয়ায় ১ কোটি ৪৬ লাখের বেশি মানুষের মানবিক সহায়তা প্রয়োজন ছিল। তাদের মধ্যে প্রায় ৫০ লাখ মানুষ চরম সংকটে ভুগছে। দেশটিতে প্রতিদিন ১ কোটি ২০ লাখের বেশি মানুষ পর্যাপ্ত খাবার পায় না। প্রায় ৫ লাখ সিরীয় শিশু ভয়াবহ অপুষ্টিতে ভুগছে।
২০১১ সালের মার্চে সিরিয়ায় প্রেসিডেন্ট বাশার আল–আসাদের বিরুদ্ধে বিক্ষোভ শুরু হয়। নিজ দেশের শাসনকাঠামোর বিরুদ্ধে জনগণের, বিশেষত বেকার তরুণদের প্রতিবাদ আসে বিক্ষোভ থেকে। তারুণ্যের সেই প্রতিবাদ দমাতে খড়্গ হাতে তুলে নেন দেশটির প্রেসিডেন্ট। রক্ত ঝরে রাজপথে। সেই শুরু, এরপর দেশটির সংঘাত রূপ নেয় গৃহযুদ্ধে। এতে একে একে জড়িয়ে পড়ে আঞ্চলিক শক্তি থেকে শুরু করে বৈশ্বিক পরাশক্তিরা। প্রাণ যায় কয়েক লাখো মানুষের। দেখা দেয় ইতিহাসের ভয়াবহতম মানবিক সংকটের।
যেভাবে শুরু সংকটের
মধ্যপ্রাচ্যের দেশ সিরিয়ায় ১৯৭১ সালে ক্ষমতায় এসেছিলেন শাসক হাফেজ আল-আসাদ। ২০০০ সালে তাঁর মৃত্যু হয়। তখন পর্যন্ত সিরিয়ার প্রেসিডেন্ট ছিলেন তিনি। এরপর ওই বছরের ১৭ জুলাই ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হন তাঁর ছেলে বাশার আল-আসাদ। ২১ বছর পরও তিনি সিরিয়ার প্রেসিডেন্ট পদে রয়েছেন। বাশার আল-আসাদের ক্ষমতা নেওয়ার আগে থেকেই সিরিয়ার তরুণদের মধ্যে ক্রমবর্ধমান বেকারত্ব, দুর্নীতি, রাজনৈতিক ও বাক্স্বাধীনতার অভাববোধ থেকে তুমুল হতাশা ছিল, যা উসকে দেয় আরব বসন্ত।
২০১১ সালের মার্চে সিরিয়ার দক্ষিণের শহর দেরাতে প্রথম সরকারবিরোধী বিক্ষোভ শুরু হয়। তবে তার আগে দেশটির বিভিন্ন স্থানে ছোট ও বিচ্ছিন্ন বিক্ষোভ হয়েছিল। বিক্ষোভ দমিয়ে গদি টিকিয়ে রাখতে সরকারি বাহিনীকে মাঠে নামান বাশার আল-আসাদ। দমন-পীড়নের মুখে বিক্ষোভকারীরা বাশার আল-আসাদের পদত্যাগ দাবি তোলেন। ফলে বেড়ে যায় সরকারি দমন-পীড়নের মাত্রা। বিক্ষোভ ছড়িয়ে পড়ে পুরো সিরিয়ায়। সিরিয়ায় বড় ধরনের বিক্ষোভ দেখা যায় ২০১১ সালের ১৫ মার্চ। এ দিনকেই সিরিয়ায় গণ-আন্দোলনের শুরুর দিন হিসেবে গণ্য করা হয়।
একপর্যায়ে বাশার আল-আসাদের বিরোধীরা হাতে অস্ত্র তুলে নেয়। তাদের ‘বিদেশি শক্তির মদদে পরিচালিত সন্ত্রাসী’ হিসেবে চিহ্নিত করে সিরিয়া সরকার। চলে চরম দমন-পীড়ন। তবে খুব একটা লাভ হয়নি। সিরিয়াজুড়ে শতাধিক সশস্ত্র গোষ্ঠী বাশার আল-আসাদের বিরুদ্ধে লড়াই শুরু করে। একের পর এক এলাকা সরকারের নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায়। দেশটিতে শুরু হয় গৃহযুদ্ধ।
এ পরিস্থিতির সুযোগ নেয় বিদেশি শক্তি-পরাশক্তিরা। কেউ কেউ বাশার আল-আসাদের পাশে দাঁড়ায়। তাঁর প্রতি সহায়তার হাত বাড়িয়ে দেয়। কেউবা সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলোকে অর্থ ও অস্ত্র দিয়ে সহায়তা করে। এর মধ্য দিয়ে দেশটিতে উত্থান হয় ইসলামিক স্টেট (আইএস) ও আল-কায়েদার। স্বশাসনের দাবি তুলে সংঘাতে নতুন মাত্রা যুক্ত করে সিরিয়ার কুর্দিরা। তবে এগুলোর জন্য সবচেয়ে ভুক্তভোগী হতে হচ্ছে দেশটির সাধারণ মানুষকে। জানমালের ক্ষতি পোহাতে হচ্ছে তাদের।
এসডব্লিউ/এসএস/১২৫০
আপনার মতামত জানানঃ