বছরের পর বছর ধরে ইরান ও ইসরায়েল একে অপরের বিরুদ্ধে নানা ধরনের গোপন তৎপরতা চালিয়ে আসছে। ইসরায়েল ইরানকে তাদের জন্য সবচেয়ে বড় হুমকি বলে মনে করে। ইরানও ইসরায়েলকে বিবেচনা করে তাদের শত্রু হিসেবে যারা যুক্তরাষ্ট্রের সাথে আছে। এছাড়াও ইরানের আঞ্চলিক শক্তি হয়ে ওঠার বিরুদ্ধে ইসরায়েলকে তারা একটি বড় বাধা হিসেবেই দেখে।
ঘটনাবলী নাটকীয় মোড় নেয় ২০২০ সালে যখন ইরানের নেতারা তাদের শীর্ষস্থানীয় পরমাণু বিজ্ঞানী মহসিন ফখরিজাদেহর হত্যার জন্য ইসরায়েলকে দায়ী করতে শুরু করেন। রাজধানী তেহরানের বাইরে গাড়ি চালিয়ে যাওয়ার সময় তাকে গুলি করে হত্যা করা হয়। ইরানের অভিযোগ যে তাকে দূর-নিয়ন্ত্রিত মেশিন গান দিয়ে হত্যা করা হয়েছে।
ইসরায়েল এই অভিযোগ স্বীকার করেনি এবং প্রত্যাখ্যানও করেনি। প্রসঙ্গত মহসিন ফখরিজাদেহ ইরানের পঞ্চম পরমাণু বিজ্ঞানী, যারা ২০০৭ সালের পর আততায়ীদের হাতে খুন হয়েছেন।
পরে ইসরায়েলি গুপ্তচর সংস্থা মোসাদের সাবেক প্রধান বলেন যে এই বিজ্ঞানী “বহু বছর ধরেই” ইসরায়েলের টার্গেট ছিলেন। তিনি বলেন, তার বৈজ্ঞানিক জ্ঞানের কারণে ইসরায়েলি গোয়েন্দা সংস্থা উদ্বিগ্ন ছিল। কারণ পশ্চিমা গোয়েন্দা সংস্থাগুলোও মনে করে ইরান যে গোপনে পরমাণু অস্ত্র তৈরি করার জন্য কাজ করছিল তার প্রধান ছিলেন মহসিন ফখরিজাদেহ।
এর কয়েক মাস পর জো বাইডেন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হলে তিনি ইরানের সঙ্গে স্বাক্ষরিত আন্তর্জাতিক পরমাণু চুক্তি পুনরুজ্জীবিত করা উদ্যোগ নেন যা তার পূর্বসূরি ডোনাল্ড ট্রাম্প বাতিল করে দিয়েছিলেন। কিন্তু এর মধ্যেও ইরান এবং ইসরায়েল পরস্পরের বিরুদ্ধে গোপন তৎপরতা অব্যাহত রাখে।
ইসরায়েল ঘোষণা করে যে তারা ইরানিদের চালানো কথিত একটি হত্যা-প্রচেষ্টা ব্যর্থ করে দিয়েছে। ইসরায়েল অভিযোগ করে যে ইরান ইসরায়েলের ভেতরে ড্রোন দিয়ে হামলার চেষ্টা করেছিল। দুটো দেশই পরস্পরের মালবাহী জাহাজে হামলা চালায়। গত সপ্তাহে তেহরানের পক্ষ থেকে অভিযোগ করা হয় যে ইরানের একটি ভূগর্ভস্থ পরমাণু স্থাপনায় নাশকতামূলক হামলার জন্য ইসরায়েলই দায়ী।
মাত্র কয়েকদিন আগে ইরান জানায় যে ইসরায়েলি বাহিনী মোসাদের সঙ্গে জড়িত থাকার অভিযোগে তারা তিন ব্যক্তির বিচার শুরু করেছে। তাদের বিরুদ্ধে ইরানি পরমাণু বিজ্ঞানীদের হত্যা করার সঙ্গে জড়িত থাকারও অভিযোগ আনা হয়েছে।
এছাড়াও ইরান দেশের ভেতরে বেশ কয়েকটি রহস্যজনক মৃত্যুর কথা উল্লেখ করেছে। তাদের মধ্যে মহাকাশ বিষয়ক দু’জন কর্মকর্তাও রয়েছেন। ইরান বলছে দায়িত্ব পালনের সময় তারা “শহীদ” হয়েছেন। এছাড়াও তাদের মধ্যে রয়েছেন প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের একজন প্রকৌশলী। তবে এসব হত্যাকাণ্ডের জন্য তারা ইসরায়েলকে দায়ী করেনি।
ইরান এবং ইসরায়েলের মধ্যে দীর্ঘদিন ধরে যে ছায়াযুদ্ধ চলছে তা যেন এখন ছায়ার ভেতর থেকে বের হয়ে আসতে শুরু করেছে। এমনকি তেহরান নামের একটি অ্যাপল টিভি শোতে দেখানো হয়েছে মোসাদের একজন এজেন্ট ইরানের নিরাপত্তা বাহিনী রেভ্যুলুশনারি গার্ডের ভেতরে একেবারে উচ্চ পর্যায়ে ঢুকে পড়েছে।
ডোনাল্ড ট্রাম্পের শাসনামলে যিনি হোয়াইট হাউজে জাতীয় নিরাপত্তা পরিষদের পরিচালক হিসেবে কাজ করেছেন সেই রিচার্ড গোল্ডবার্গও (ইরানের গণ-বিধ্বংসী অস্ত্র মোকাবেলা করাই ছিল তার দায়িত্ব) বলেছেন, ইরানের ভেতরে নিরাপত্তা ব্যবস্থায় বড় ধরনের ত্রুটি না হলে মহসিন ফখরিজাদেহকে হত্যা করা যেত না।
তিনি বলেন, অত্যন্ত সুরক্ষিত একটি পরমাণু স্থাপনায় ঢুকতে হলে অথবা গুরুত্বপূর্ণ কোনো কর্মকর্তার কাছে গিয়ে পৌঁছাতে হলে, সরকারের ভেতর থেকে সহযোগিতার প্রয়োজন।
ইরান বলে আসছে তাদের পরমাণু কর্মসূচির উদ্দেশ্য হচ্ছে শান্তিপূর্ণ কাজে এর ব্যবহার। কিন্তু ডোনাল্ড ট্রাম্প ২০১৮ সালে এই চুক্তি থেকে বের হয়ে এসে দেশটির ওপর নিষেধাজ্ঞা পুনর্বহাল করার পর থেকে ইরান সর্বোচ্চ মাত্রায় ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধ করতে শুরু করে। বলা হচ্ছে পরমাণু অস্ত্র তৈরি করার জন্য যতো ইউরেনিয়ামের প্রয়োজন তারা এখন সেই পরিমাণ ইউরেনিয়াম সংগ্রহের কাছাকাছি পৌঁছে গেছে।
পরমাণু চুক্তি পুনরুজ্জীবিত করার জন্য বিশ্বের শক্তিধর দেশগুলোর সঙ্গে ভিয়েনাতে তাদের যে আলোচনা চলছিল সেটাও স্থবির হয়ে আছে। ইরানের ভেতরে চালানো হামলার জবাবে সন্দেহ করা হচ্ছে যে তেহরানও ওই অঞ্চলে যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরায়েলি স্বার্থের ওপর আক্রমণ করেছে।
মার্চ মাসে ইরান ইরাকের কুর্দিস্তান অঞ্চলে তাদের ভাষায় একটি “ইসরায়েলি কৌশলগত কেন্দ্রে” ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র নিক্ষেপ করেছে। অভিযোগ করা হয় যে ইরান-সমর্থিত মিলিশিয়ারা ইরাকে মার্কিন সৈন্যদের ঘাঁটি লক্ষ্য করে রকেট ও ড্রোন হামলা চালিয়েছে। তাদের বিরুদ্ধে রসদ বহনকারী গাড়ির বহরে বোমা হামলা চালানোরও অভিযোগ উঠেছে।
সম্প্রতি ইসরায়েল নজিরবিহীনভাবে তুরস্কের ইস্তাম্বুল শহরে তার নাগরিকদের সতর্ক করে দিয়েছে ওই শহর ছেড়ে চলে যাওয়ার জন্য। ইসরায়েলি নাগরিকদের তারা তুরস্ক ভ্রমণ না করার ব্যাপারেও সতর্ক করে দিয়েছে। ইসরায়েল বলছে তাদের কাছে খবর আছে যে “ইরানি এজেন্টরা সেখানে ইসরায়েলি নাগরিকদের ক্ষতি করতে পারে।”
ইসরায়েলের বিদায়ী প্রধানমন্ত্রী নাফতালি বেনেট ইরানের ভেতরে পরমাণু, ক্ষেপণাস্ত্র এবং ড্রোন কর্মসূচির বিরুদ্ধে গোপন অপারেশন বৃদ্ধি করার কথা ঘোষণা করেছেন যার নাম দেওয়া হয়েছে “অক্টোপাস ডকট্রিন।” প্রধানমন্ত্রী নাফতালি বেনেট বলেছেন ইসরায়েল এখন “সন্ত্রাসী অক্টোপাসের মাথার বিরুদ্ধে” ব্যবস্থা নিচ্ছে।
তেহরান বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক এবং ইরানি পরমাণু কর্মসূচি বিষয়ক যে দলটি ভিয়েনা আলোচনায় অংশ নিচ্ছে তার মিডিয়া উপদেষ্টা মোহাম্মদ মারান্দি বলেছেন, “পশ্চিমা রাজনৈতিক সুরক্ষার নামে বেসামরিক নিরীহ লোকজনকে হত্যা করা ইরসায়েলি সরকারের জন্য নতুন কিছু নয়। কিন্তু ইসরায়েল তাদের রাজনৈতিক লক্ষ্যে এই কাজ আরো বাড়িয়ে চলেছে। ইরান অবশ্যই তার জবাব দেবে। তবে ইরান ধৈর্যশীল।”
ইরানের রেভ্যুলুশনারি গার্ডের যে বিশেষ বাহিনী কুদস ফোর্স বিদেশে অপারেশন পরিচালনা করে থাকে তার প্রধান জেনারেল এসমাইল কানি ঘোষণা করেছেন যে যেখানেই যুক্তরাষ্ট্র-বিরোধী অথবা ইসরায়েল-বিরোধী আন্দোলন হবে সেখানেই তারা সমর্থন দিয়ে যাবে।
যুক্তরাষ্ট্র ২০২০ সালের জানুয়ারি মাসে কাসেম সোলেইমানিকে ইরাকের রাজধানী বাগদাদে ড্রোন হামলা চালিয়ে হত্যা করার পর তিনি এই হুমকি দিয়েছেন।
কাসেম সোলেইমানি দীর্ঘদিন ধরেই যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক বাহিনীর টার্গেট ছিলেন। এর আগেও তাকে কয়েকবার হত্যার চেষ্টা করা হয়েছে। তাকে হত্যার পর তৎকালীন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প বলেছিলেন, “সোলেইমানি ছিলেন বিশ্বের এক নম্বর সন্ত্রাসী।”
এছাড়াও ট্রাম্প প্রশাসন মধ্যপ্রাচ্যে ক্ষমতার ভারসাম্যে পরিবর্তন আনার চেষ্টা করে। সংযুক্ত আরব আমিরাত এবং বাহরাইনের সঙ্গে সম্পর্ক স্বাভাবিক করার মাধ্যমে তারা ইরানকে আরো বেশি করে বিচ্ছিন্ন করে ফেলার চেষ্টা চলায়।
আরব দেশগুলোর সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের এই সমঝোতাকে বলা হয় “আব্রাহাম চুক্তি।” নাম প্রকাশ করতে চান নি এরকম একজন আরব কূটনীতিক বলেন, “ইরান আব্রাহাম চুক্তিকে ঘৃণা করে।” ইরানের সাবেক একজন কর্মকর্তা বলেছেন ইরান মনে করে না যে এই চুক্তি দীর্ঘস্থায়ী হবে। তারা এই চুক্তিকে “সাময়িক প্রেমের সম্পর্ক” বলেই মনে করে।
এসডব্লিউ/এসএস/২০৩০
আপনার মতামত জানানঃ