অসত্য নিউজ পরিবেশনা, গুজব রটানো এবং অনৈতিক কর্মকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত থাকার অভিযোগে বেশকিছু অনলাইন নিউজ পোর্টাল বন্ধের কার্যক্রম প্রক্রিয়াধীন রয়েছে বলে জানিয়েছেন তথ্য ও সম্প্রচারমন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদ।
মঙ্গলবার (১৪ জুন) জাতীয় সংসদের প্রশ্নোত্তরে চট্টগ্রাম-১১ আসনের এম আবদুল লতিফের প্রশ্নের জবাবে মন্ত্রী এ তথ্য জানান। স্পিকার ড. শিরীন শারমিন চৌধুরীর সভাপতিত্বে প্রশ্নোত্তর টেবিলে উত্থাপিত হয়।
চট্টগ্রাম-১১ আসনের এম আবদুল লতিফের প্রশ্নের জবাবে তথ্যমন্ত্রী অনিবন্ধিত অনলাইন নিউজ পোর্টাল বন্ধে সরকারের বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণের কথা বলেন।
তথ্যমন্ত্রী বলেন, ‘হাইকোর্টের নির্দেশ অনুযায়ী জনমনে বিভ্রান্তি ছড়ায়— এমন কার্যক্রম পরিচালনাকারী ও সরকারের গোয়েন্দা সংস্থার তথ্যের ভিত্তিতে ১৭৯টি অনলাইন নিউজ পোর্টালের ডোমেইন বরাদ্দ বাতিলসহ লিংক বন্ধ করার জন্য ডাক ও টেলিযোগাযোগ বিভাগে চিঠি দেওয়া হয়েছে।’
তিনি বলেন, ‘এছাড়া অসত্য নিউজ পরিবেশনা, গুজব রটানো এবং অনৈতিক কর্মকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত থাকার অভিযোগে আরও বেশকিছু অনলাইন নিউজ পোর্টাল বন্ধের কার্যক্রম প্রক্রিয়াধীন রয়েছে।’
বেনজীর আহমেদের প্রশ্নের জবাবে তথ্যমন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদ জানান, বর্তমানে ঢাকা জেলা থেকে প্রকাশিত দৈনিক, সাপ্তাহিক ও মাসিক পত্রিকার সংখ্যা ১১২৬টি। এর মধ্যে দৈনিক পত্রিকা ৪৯৯টি, সাপ্তাহিক ৩৪৫টি ও মাসিক ২৮২টি।
এর আগে গত বছর ১৭৮টি অনিবন্ধিত নিউজ পোর্টাল বন্ধ করে টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিটিআরসি। এ বিষয়ে ডাক ও টেলিযোগাযোগমন্ত্রী মোস্তাফা জব্বার বলেছিলেন, আমাদের ওপর উচ্চ আদালতের নির্দেশ রয়েছে অনিবন্ধিত পোর্টালগুলো বন্ধ করার। তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রণালয় যে তালিকাগুলো আমাদের দিয়েছে, তা অনিবন্ধিত পোর্টাল হিসেবে, সেগুলো বন্ধ করা হয়েছে।
গত বছর ১০ অক্টোবর ডাক ও টেলিযোগাযোগ বিভাগের সচিব বরাবর তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রণালয়ের উপ-সচিব মুহাম্মদ দেলওয়ার হোসেন স্বাক্ষরিত পত্রে অনিবন্ধিত ও অননুমোদিত ১৭৯টি নিউজ পোর্টালের ডোমেইন বরাদ্দ বাতিলকরণসহ লিংক বন্ধ করার অনুরোধ করা হয়। এরমধ্যে একটি নিউজ পোর্টাল বন্ধ না করে চালু রাখারও অনুরোধ করা হয় ওই পত্রে।
এর আগে অনিবন্ধিত নিউজ পোর্টাল বন্ধের প্রক্রিয়া শুরু করে বিটিআরসি। কিন্তু সে সময় ভুলের কারণে নিবন্ধিত কয়েকটি অনলাইনও বন্ধ হয়ে যায়। মন্ত্রী বলেন, বিষয়টি আমি জানার পরে নির্দেশ দিলে অনলাইন নিউজ পোর্টাল বন্ধের প্রক্রিয়া স্থগিত হয়ে যায়। এবার যেসব অনিবন্ধিত নিউজ পোর্টাল বন্ধ করা হয়েছে তার তালিকা তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রণালয় দিয়েছে। যোগাযোগ করে নিবন্ধনের তথ্য প্রমাণ দিলে সেসব সাইট খুলে দেওয়া হবে।
কোভিড-১৯ অতিমারিকালে গণমাধ্যম ও সাংবাদিকদের পেশাগত ও অর্থনৈতিক ঝুঁকি আরও প্রকট হয়েছে। বহু গণমাধ্যম বন্ধ হয়ে গেছে। তাই মুক্ত গণমাধ্যম এবং তথ্যের অবাধ প্রবাহের সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতা ও আন্তর্জাতিক প্রতিশ্রুতির বাস্তবায়নে অবিলম্বে স্বাধীন ও পেশাদার গণমাধ্যমের অনুকূল পরিবেশ নিশ্চিত এখন অতিব প্রয়োজন হয়ে উঠেছে।
টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, সংবিধানের ৩৯ অনুচ্ছেদে চিন্তা ও বিবেকের স্বাধীনতার নিশ্চয়তা প্রদানের পাশাপাশি প্রত্যেক নাগরিকের বাক ও ভাব প্রকাশের স্বাধীনতা এবং সংবাদপত্রের স্বাধীনতার নিশ্চয়তা প্রদান করা হয়েছে। কিন্তু প্রকাশ্য ও প্রচ্ছন্ন নানামুখী চাপ ও বিধিনিষেধের বেড়াজালে সাংবিধানিক এই অধিকার মলাটবদ্ধ নথিতে রূপান্তরিত হয়েছে।
২০২০ সালে বিশ্ব গণমাধ্যম দিবসে ইউনেসকোর মূলমন্ত্র ছিল: জার্নালিজম আন্ডার ডিজিটাল সিজ বা ডিজিটাল অবরোধে সাংবাদিকতা। অভিধাটি বাংলাদেশের সাংবাদিক ও সাংবাদিকতার জন্য শতভাগ সত্য। আমরা এক অবরুদ্ধ পরিস্থিতিতেই আছি। সব মাধ্যমেই সাংবাদিকতার বিপদ ওত পেতে থাকে; তবে ডিজিটাল মাধ্যমটির মাথার ওপর খাঁড়া হয়ে ঝুলছে। বিশ্ব সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা সূচকে বাংলাদেশ গত বছরের তুলনায় ১০ ধাপ পিছিয়েছে, এটা অস্বাভাবিক নয়।
বিশ্ব মুক্ত গণমাধ্যম দিবসে রিপোর্টার্স উইদাউট বর্ডারস (আরএসএফ) ২০২২ সালের যে প্রতিবেদন প্রকাশ করে, তাতে দেখা যায়, ১৮০টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ১৬২তম (স্কোর ৩৬ দশমিক ৬৩)। ২০২১ সালের সূচকে বাংলাদেশের অবস্থান ছিল ১৫২তম (স্কোর ৫০ দশমিক ২৯)। আর ২০২০ সালের সূচকে বাংলাদেশের অবস্থান ছিল ১৫১তম। অর্থাৎ, গত দুই বছরের সূচকেও বাংলাদেশের এক ধাপ করে অবনতি হয়েছিল। এবারের সূচকে প্রতিবেশী দেশগুলোর মধ্যে মিয়ানমার ছাড়া সবার নিচে বাংলাদেশের অবস্থান। সূচকে বাংলাদেশের চেয়ে ভালো অবস্থানে রয়েছে ভারত (১৫০), পাকিস্তান (১৫৭), শ্রীলঙ্কা (১৪৬), আফগানিস্তান (১৫৬), নেপাল (৭৬), মালদ্বীপ (৮৭), ভুটান (৩৩)।
গণমাধ্যমের এই বেহাল দশার ক্ষেত্রে আরএসএফ ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের সমালোচনা করে। দলটির নেতা-কর্মী ও সমর্থকেরা প্রায়ই তাদের অপছন্দের সাংবাদিকদের ওপর চড়াও হন, অন্যদিকে সাংবাদিকদের মুখ বন্ধ করতে ও হয়রানি করতে মামলা-মোকদ্দমার আশ্রয় নিয়ে থাকেন। গণমাধ্যম বন্ধ করে দেয়।
বাংলাদেশের বেশির ভাগ গণমাধ্যমের বেশ কয়েকটি বড় ব্যবসায়ী গোষ্ঠীর। তারা একে দেখেন প্রভাব সৃষ্টি ও সর্বোচ্চ সুবিধা লাভের হাতিয়ার হিসেবে। এই মালিকেরা স্বাধীন সম্পাদকীয় নীতি নয়, বরং সরকারের সঙ্গে সুসম্পর্ক রাখাকে অগ্রাধিকার দেন। এর ফলে সরকারের লোকজনই ঠিক করে দেন বেসরকারি টিভি চ্যানেলের টক শোর অতিথি কারা হবেন।
এছাড়া মূলধারার গণমাধ্যম ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের সমস্যাগুলো সামনে আনে না। এমনকি তারা উগ্রবাদী ইসলামি গ্রুপগুলো সম্পর্কেও কিছু প্রকাশ বা প্রচার করে না। এসব গ্রুপ অতীতে সেক্যুলার লেখক-সাংবাদিকদের হত্যা করেছে, এখন তাদের বিরুদ্ধে সামাজিক যোগযোগমাধ্যমে নানা অপপ্রচার চালাচ্ছে।
আরএসএফের বাংলাদেশ প্রতিনিধি সাংবাদিক সালিম সামাদ বলেন, বাংলাদেশে সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে এর আগে যেসব আইন ছিল, সেগুলো প্রায় অকার্যকর হয়ে গেছে। এ কারণেই সরকার ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন জারি করেছে। সরকারের দাবি, ব্যক্তি বা সম্প্রদায়ের প্রতি কেউ ঘৃণা ও বিদ্বেষ ছড়ালে এ আইনের মাধ্যমে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। কিন্তু সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ব্যবহার করে যারা ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের বিরুদ্ধে বিদ্বেষ ছড়ায়, ধর্মের নামে যারা অপপ্রচার চালায়, তাদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয় না। এ অবস্থায় মতপ্রকাশ কিংবা গণমাধ্যমের স্বাধীনতা খর্ব হতে বাধ্য।
আরএসএফের প্রতিবেদনে দেশগুলোকে পাঁচ শ্রেনিতে ভাগ করা হয়েছে। সেগুলো হলো—অতি সংকটজনক, অসুবিধাজনক, সমস্যামূলক, সন্তোষজনক ও ভালো। আমরা শেষোক্ত চারটি বৈশিষ্ট্যের কোনোটিতে নেই। আমরা আছি অতি সংকটজনক পরিস্থিতিতে।
মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে অর্জিত বাংলাদেশের জন্য এটি কেবল হতাশাজনক নয়, লজ্জাজনকও। সরকারের পক্ষ থেকে বলা হয়, বাংলাদেশের অর্থনীতি অবিশ্বাস্য দ্রুতগতিতে এগিয়ে চলেছে। আমরা স্বল্পোন্নত দেশের তালিকা থেকে বেরিয়ে উন্নয়নশীল দেশের কাতারে চলে এসেছি। মানুষের গড় আয় ও আয়ু বেড়েছে। করোনা পরিস্থিতিও সফলভাবে মোকাবিলা করেছি। এত অগ্রগতি সত্ত্বেও গণমাধ্যমের স্বাধীনতার সূচকে কেন এতটা পিছিয়ে আছি? আপনারা বাংলাদেশকে আর কত নিচে নামবেন?
এসডব্লিউ/এসএস/১৭৩০
আপনার মতামত জানানঃ