সংসারে নারী-পুরুষ সবাই কাজ করেন। কিন্তু তাদের কাজের ধারায় পরিষ্কার পার্থক্য আছে। ঘরের টুকিটাকি কাজ করা এবং পরিবারের সদস্যদের যত্ন-আত্তি করা দৈনন্দিন কাজের অংশ। এ ক্ষেত্রে নারী-পুরুষ দুজনের সমান দায়িত্ব পালন করা উচিত। কিন্তু নারীর ওপর বেশি বোঝা হয়ে যাচ্ছে।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) সময়ের ব্যবহার নিয়ে সর্বশেষ সমীক্ষায় এই চিত্র ওঠে এসেছে। সোমবার(১৩ জুন) এই সমীক্ষা প্রকাশ করেছে সংস্থাটি। দেশের একজন নারী-পুরুষ দৈনিক কত ঘণ্টা কী ধরনের কাজ করেন, তা এই সমীক্ষায় প্রকাশ করা হয়েছে।
সমীক্ষার ফল অনুযায়ী, পুরুষের চেয়ে নারীরা সংসারের কাজকর্ম আট গুণ বেশি করেন। তারা গড়ে দিনে ১১ দশমিক ৬ ঘণ্টা সংসারের কাজে ব্যয় করেন। অন্যদিকে পুরুষেরা সংসারের কাজে ব্যয় করেন মাত্র ১ দশমিক ৬ ঘণ্টা।
সমীক্ষার ফল অনুযায়ী, একজন পুরুষ দৈনিক গড়ে ১১ দশমিক ৩ ঘণ্টা নানা কাজে ব্যয় করেন। আর একজন নারী নানা কাজে ব্যয় করেন গড়ে ১০ দশমিক ৯ ঘণ্টা। নারীরা প্রতিদিন গৃহস্থালির কাজে ৪ দশমিক ৬ ঘণ্টা ও পরিবারের সদস্যদের সেবা করতে ব্যয় করেন ১ দশমিক ২ ঘণ্টা। সব মিলিয়ে মজুরি ছাড়া কাজ করেন প্রতিদিন ৫ দশমিক ৬ ঘণ্টা। অন্যদিকে পুরুষেরা দৈনিক মাত্র দশমিক ৮ ঘণ্টা এমন মজুরিহীন কাজ করেন।
বিবিসি বলছে, পুরুষেরা মজুরি নিয়ে (কর্মসংস্থানভিত্তিক) প্রতিদিন গড়ে ৬ দশমিক ১ ঘণ্টা কাজ করেন। নারীরা করেন মাত্র ১ দশমিক ২ ঘণ্টা। এ ছাড়া নারী-পুরুষ প্রতিদিন নানা ধরনের কাজ করেন। যেমন- নিজের জন্য রান্না করা, টিভি দেখা, খেলাধুলা করা, সামাজিকতা রক্ষা করা ইত্যাদি।
বিবিএস আরও বলছে, টিভি দেখা, অবসর যাপন, বিনোদনসহ বিভিন্ন কাজে একজন নারী দৈনিক ২ দশমিক ৭ ঘণ্টা ব্যয় করেন। আর পুরুষ এসব কাজে সময় খরচ করেন ২ দশমিক ৬ ঘণ্টা।
এ ছাড়া সমীক্ষায় মতামত প্রদানকারীদের প্রায় ৭৩ শতাংশই মোবাইল ফোন ব্যবহার করেন। নারীদের মধ্যে প্রায় ৬০ শতাংশ মোবাইল ফোন ব্যবহার করেন। পুরুষদের মধ্যে তা ৮৬ শতাংশের বেশি। পুরুষের মধ্যে ৩০ শতাংশ এবং নারীদের মধ্যে ২১ শতাংশ ইন্টারনেট ব্যবহার করেন।
সংসারের কাজে বেশি সময় দেওয়ার কারণে তাদের শ্রমবাজারে প্রবেশের ক্ষেত্রে বড় বাধা হিসেবে কাজ করছে। এ ছাড়া বাচ্চা ছোট হলেও শ্রমবাজারে প্রবেশের ক্ষেত্রে অন্যতম প্রতিবন্ধকতা দেখা দেয়। তাই শ্রমবাজারে নারীর অংশগ্রহণ তেমন একটা বাড়েনি’।
এ বিষয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক সায়েমা হক সংবাদমাধ্যমকে বলেন, ‘সংসারের জন্য নারীরা যে সময় দিচ্ছেন, এর স্বীকৃতি নেই। তারা কোনো মজুরি পান না। সংসারের কাজে বেশি সময় দেওয়ার কারণে তাদের শ্রমবাজারে প্রবেশের ক্ষেত্রে বড় বাধা হিসেবে কাজ করছে। এ ছাড়া বাচ্চা ছোট হলেও শ্রমবাজারে প্রবেশের ক্ষেত্রে অন্যতম প্রতিবন্ধকতা দেখা দেয়। তাই শ্রমবাজারে নারীর অংশগ্রহণ তেমন একটা বাড়েনি’।
তিনি বলেন, ‘প্রতিষ্ঠানের পাশাপাশি পাড়া-মহল্লায় শিশু দিবাযত্নকেন্দ্র গড়ে তুলতে পারলে নারীর শ্রমবাজারে অংশগ্রহণ বাড়বে’।
বাংলাদেশে কোনো পুরুষকে যদি জিজ্ঞেস করা হয় আপনার স্ত্রী কী করেন আর তার জবাব যদি হয়, ‘কিছু করেন না’৷ তাহলে কী বুঝবেন? সাধারণত এর মানে, তিনি ঘর-গেরস্থালির কাজ করেন৷ কিন্তু এ দেশে ঘর-গেরস্থালির কাজকে কাজ বলে ধরা হয় না!
নারীর কাজ শুনলেই মনের চোখে ভেসে উঠে পোশাকশ্রমিকদের ছবি। কিন্তু ইট ভাঙা, মাটি কাটা, কৃষিকাজ করা, শিল্প-কারখানায় কাজ করা, শিক্ষকতা করা, ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, কৃষিবিদ, অর্থনীতিবিদ, আইনজীবী, গবেষক, পাইলট, ড্রাইভার, চা দোকানদার থেকে ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানের মালিক ও কর্মচারী, পুলিশ-আর্মি এমন বহু পেশায় নারীরা আসছেন এগিয়ে। কিন্তু সব পেশায় থেকেও বা কোনো পেশায় না থেকেও যে কাজ তারা নীরবে করে যান তা হলো গৃহস্থালি কাজ। জীবন নিংড়ে নেওয়া এই কাজে না আছে স্বীকৃতি আর না আছে সম্মান।
বিশ্লেষকরা বলেন, গৃহস্থালি কাজ ছাড়া কোনো পরিবার ও সমাজ কল্পনা করা যায় না। আর গৃহস্থালি কাজের সিংহভাগই করে থাকেন পরিবারের নারী সদস্যরা। গৃহস্থালি কাজ ছাড়া মানুষের শারীরিক, মানসিক, সাংস্কৃতিক জীবন বিকশিত হওয়া তো দূরের কথা, টিকিয়ে রাখাই কঠিন হয়ে পড়ে। কিন্তু এ কাজে কোনো স্বীকৃতি নেই, মর্যাদা নেই। এমনকি এ কাজকে সব সময় তাচ্ছিল্য করা হয়।
তারা দাবি করেন, অর্থনৈতিক দৃষ্টিকোণ, নৈতিক অবস্থান, নারীর অধিকার ও সামাজিক মর্যাদার প্রশ্নে তো বটেই, সামাজিক ন্যায্যতার কারণেও নারীর কাজের আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি দরকার।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ঘরে-বাইরে নারী যে কাজ করে তার পুরোটা হিসাবে আনলে এবং আর্থিক মূল্য বিবেচনা করলে জিডিপিতে নারী-পুরুষের অবদান সমান হবে। তখন আর কেউ বলতে পারবে না যে নারীরা কোনো কাজ করে না। আমরা যখন আধুনিকতার কথা বলতে গিয়ে সব সময় ডিজিটালাইজেশনের কথা বলি তখন অর্থনৈতিক সবকিছুরই তো হিসাব করা সম্ভব। অর্থনৈতিক দৃষ্টিকোণ, নৈতিক অবস্থান, সামাজিক মর্যাদা, নারীর অধিকার ও সামাজিক মর্যাদার প্রশ্নে তো বটেই সামাজিক ন্যায্যতার কারণেও নারীর কাজের আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি দরকার।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৩৪৮
আপনার মতামত জানানঃ