নারী নির্যাতনে শীর্ষে থাকা বাংলাদেশে প্রায় প্রতিদিন খবরের কাগজে নারী নির্যাতনের চিত্র উঠে আসছে। এর বাইরেও নির্যাতনের অসংখ্য ঘটনা ঘটছে। নারীরা শিকার হচ্ছে খুন, ধর্ষণ কিংবা ভয়াবহ নির্যাতনের। এসব ঘটনায় জড়িতদের শাস্তির দৃষ্টান্ত খুব বেশি পরিলক্ষিত হয় না। অনেক সময় ভোক্তভোগী আইনের আশ্রয় নিলেও অপরাধী ফাঁকফোকরে ছাড়া পেয়ে যায়। করোনা মহামারিতে মানুষ যখন বেঁচে থাকার সংগ্রাম করছে, তখনও নারীর প্রতি সহিংসতা বন্ধ নেই বরং বেড়েছে।
বেসরকারি সংস্থা আইন ও সালিশ কেন্দ্রের (আসক) পরিসংখ্যান বলছে, ২০১৯ থেকে ২০২১ সাল পর্যন্ত তিন বছরে বখাটের যন্ত্রণায় অতিষ্ঠ হয়ে আত্মহননের পথ বেছে নিয়েছেন অন্তত ৪৪ জন নারী। এ সময়ে যৌন হয়রানির শিকার হয়েছেন আরও ৬৬৪ জন। আর এ বছরের প্রথম পাঁচ মাসে বখাটের উৎপাতে আত্মহত্যা করেছেন ৪ জন।
এমন প্রেক্ষাপটে আজ সোমবার(১৩ জুন) দেশব্যাপী নানা আয়োজনে পালিত হচ্ছে নারী উত্ত্যক্তকরণ প্রতিরোধ দিবস। ২০১০ সাল থেকে জাতীয়ভাবে দিবসটি পালন করা হচ্ছে।
আসকের হিসাব বলছে, ২০১৯ সালের জানুয়ারি থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত বখাটের হাতে হয়রানির শিকার হয়ে আত্মহত্যা করেছেন ১৮ নারী। ২০২০ সালে একই কারণে আত্মহত্যা করেন ১৪ জন। এর পরের বছর অর্থাৎ ২০২১ সালে উত্ত্যক্তকরণে আত্মহনন করেন ১২ জন। আর এ বছরের প্রথম পাঁচ মাসে বখাটের উৎপাতে আত্মহত্যা করেছেন ৪ জন।
বেসরকারি সংগঠন প্ল্যান ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের ২০২০ সালের এক জরিপ বলছে, ডিজিটাল প্ল্যাটফর্ম ব্যবহারকারীদের মধ্যে ৪৫ শতাংশ নারী কখনো না কখনো উত্ত্যক্তের শিকার হয়েছেন।
আসকের পরিচালক ও মানবাধিকার আইনজীবী নীনা গোস্বামী বলেন, ঘরে-বাইরে কিংবা অফিসে-রাস্তায় সর্বত্রই নারীরা উত্ত্যক্তের শিকার হন। এর মধ্যে খুব কম ঘটনাই সামনে আসে। এসব ক্ষেত্রে যে মামলাগুলো হয়, বেশির ভাগেরই আবার রায় আসে না। কারণ, এগুলোর সাক্ষী পাওয়া যায় না।
বিশেষজ্ঞরা বলেন, অনেকেই ভাবেন, ইভ টিজিংয়ের মতো তুচ্ছ কারণে একটা মেয়ে কেন আত্মহত্যা করেন। আসলে যে আত্মহত্যা করেন, তার কাছে বিষয়টা অনেক বড়। এর সঙ্গে পারিবারিক কাঠামো ও ব্যক্তিত্বের কাঠামো জড়িত। একজন মানুষ, যিনি পারিবারিকভাবে ইতিবাচকতার মধ্যে বড় হয়েছেন, তিনি কোনো বিষয়কে যেভাবে দেখবেন, নেতিবাচকতার মধ্যে বড় হওয়া মানুষ বিষয়টাকে সেভাবে দেখবেন না।
ঘরে-বাইরে কিংবা অফিসে-রাস্তায় সর্বত্রই নারীরা উত্ত্যক্তের শিকার হন। এর মধ্যে খুব কম ঘটনাই সামনে আসে।
নারী উত্ত্যক্তকরণের শেষ কোথায়, এমন প্রশ্নে মানবাধিকারকর্মী ও মনোবিজ্ঞানীরা বলছেন, মেয়েদের দোষারোপের সংস্কৃতি বন্ধ করতে হবে। ছেলেদের সুমানসিকতা গড়ায় মা-বাবাকে সচেষ্ট থাকতে হবে। আর আইনগতভাবে শাস্তির বিষয়টিও কঠোরভাবে অনুসরণ করতে হবে।
এ বিষয়ে আসকের পরিচালক নীনা গোস্বামী বলেন, নারী উত্ত্যক্তকরণ প্রতিরোধে সচেতনতা অবশ্যই দরকার। সেই সঙ্গে দরকার ভ্রাম্যমাণ আদালতের সংখ্যা বাড়ানো। বখাটেরা শাস্তির আওতায় এলে উত্ত্যক্তকরণের সংখ্যা কিছুটা হলেও কমবে।
এদিকে নারী উত্ত্যক্তকরণ প্রতিরোধ দিবসে কিশোরগঞ্জের করিমগঞ্জে জঙ্গলবাড়ি উচ্চ বিদ্যালয়ে এক ছাত্রীকে উত্ত্যক্তের প্রতিবাদ করায় চার শিক্ষিকাকে হেনস্তা করেছে বখাটেরা। রোববার (১২ জুন) বিকেল ৫টার দিকে উপজেলার দেওয়ানগঞ্জ বাজার সংলগ্ন তালিয়াপাড়া এলাকায় এ ঘটনা ঘটে।
স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, করিমগঞ্জের কাদিরজঙ্গল ইউনিয়নের জঙ্গলবাড়ি উচ্চ বিদ্যালয়ের দুই ছাত্রীকে বিদ্যালয়ে আসা-যাওয়ার পথে ৩-৪ বখাটে প্রায়ই উত্ত্যক্ত করত। মোবাইলফোনে তাদের ছবিও তুলত। রোববার প্রথম সাময়িক পরীক্ষা চলাকালীন বখাটেরা বিদ্যালয়ে প্রবেশ করে দুই ছাত্রীর সঙ্গে দেখা করে। এ দৃশ্য দেখে শিক্ষিকা শাহনাজ পারভীন-১, শাহনাজ পারভীন-২, লাভলী রাণি পাল ও তানিয়া ছিদ্দিকী তাদের বিদ্যালয় থেকে বের হয়ে যেতে বলেন।
ছুটি শেষে চার শিক্ষিকা অটোরিকশাযোগে বাড়ি ফেরার পথে দেওয়ানগঞ্জ বাজার সংলগ্ন তালিয়াপাড়া এলাকায় পৌঁছালে বখাটেরা অটোরিকশাটি থামায়। পরে শিক্ষিকাদের শরীরে গোবর ও কাঁদা মিশ্রিত ময়লা পানি ছুড়ে মারে।
এ ঘটনায় শিক্ষিকা শাহনাজ পারভীন-১ সন্ধ্যার পর তার ব্যক্তিগত ফেসবুক আইডি থেকে একটি পোস্ট করলে প্রতিবাদের ঝড় উঠে। বখাটেদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবি জানানো হয় সেই পোস্টের কমেন্ট বক্সে।
বিশেষজ্ঞরা বলেন, ‘আমাদের সমাজে নারীদের প্রাপ্য সম্মান দেওয়া হয় না। সেক্ষেত্রে পরিবার থেকে প্রতিটি প্রজন্ম শিখছে মেয়েরা মানুষ নয়, তারা শুধু ব্যবহারের জন্য। এভাবে পরিবার থেকেই মূলত নারীর প্রতি অসম্মানের শুরু। এতে বাড়ছে নারী ও শিশু নির্যাতনের হার। নারীর ক্ষমতায়ন ও উন্নয়নের কথা বলছে রাষ্ট্র। কিন্তু রাষ্ট্রীয়ভাবে আমরা নারীদের সম্মানের জায়গায় তুলে ধরতে পারছি না।’
তারা বলেন, ‘পরিবার থেকেই নারীদের সম্মান দেওয়ার শিক্ষাটা জরুরি। পাশাপাশি আমাদের প্রচলিত শিক্ষা ব্যবস্থায় যা রয়েছে তা একপ্রকার ইঁদুর দৌড়ের মতো। আমরা শুধু দৌড়াচ্ছি আর দৌড়াচ্ছি। মানবিক শিক্ষা না শিখে ডিগ্রির পেছনে দৌড়াচ্ছি। পরিবার ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে মানবিক শিক্ষা শুরু করা দরকার।’
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৬১১
আপনার মতামত জানানঃ