আরব বসন্তের ঢেউ তিউনিসিয়া থেকে সিরিয়ায় পৌঁছাতে বেশি সময় লাগেনি। গণতন্ত্রের দাবিতে শুরুতে সিরিয়ায় ছোটখাটো বিক্ষোভ হয়। দ্রুতই এই বিক্ষোভ ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়ে। বিক্ষোভ দমনে নৃশংস পথ বেছে নেন দেশটির প্রেসিডেন্ট বাশার আল–আসাদ। এতে এক দীর্ঘমেয়াদি গৃহযুদ্ধের চক্করে পড়ে যায় সিরিয়া।
বুলেটের মুহুর্মুহু গুলি, বাবা-মা হারানো শিশুদের চিৎকার আর বাস্তুচ্যুত মানুষের ছোটাছুটি- এ যেন সিরিয়ার নিত্যদিনের চিত্র। দেশটিতে ২০১১ সালের মার্চে গৃহযুদ্ধ শুরু হওয়ার পর কেবলই বেড়েছে লাশের সারি। দেখা দিয়েছে ইতিহাসের ভয়াবহতম মানবিক সংকটের।
একসময়ের সমৃদ্ধ দেশটি এখন রীতিমতো ধ্বংসস্তূপ, যুদ্ধের ভারে শ্রান্ত। ২০১১ সালের মধ্য মার্চে দেশটিতে যে সংকটের সূচনা, তার আজও সমাধান হয়নি। এর মধ্যে পেরিয়ে গেছে ১১ বছর। দেশটিতে শান্তি ফেরেনি।
সম্প্রতি নয় বছর আগের ছয় মিনিটের একটি ভিডিও খুব সাড়া জাগিয়েছে। দুই সিরীয় যোদ্ধাকে চোখ বাঁধা, নিরস্ত্র মানুষদের হত্যা করতে দেখা গেছে সেই ভিডিওতে। খবর ডয়চে ভেলে।
ওয়াসিম সিয়াম ২০১৩ সালের ১৪ এপ্রিল সেই যে বেরিয়েছিলেন,তারপর আর দামেস্কে নিজেদের বাড়িতে ফেরেননি৷ ৩৪ বছর বয়সি ওয়াসিমের কাজ ছিল তাদামোন শহরের দক্ষিণাঞ্চলের এক সরকারি বেকারিতে ময়দা পৌঁছে দেয়া৷ সেদিন সেই কাজেই বেরিয়েছিলেন৷ ধারণা করা হয়, ময়দা পৌঁছে দিতে ঘর থেকে বের হয়ে কোনো এক সেনা ছাউনির পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় আটক করা হয় তাকে৷
ওয়াসিম ঘর থেকে বের হবার সময় যেমন সাদা টি-শার্ট আর জিন্স পরেছিলেন, ছয় মিনিটের ভিডিওতে ঠিক সেই পোশাকেই দেখা যায় তাকে৷ তবে তখন তাকে চেনা খুব কঠিন হয়ে পড়েছিল৷
ওয়াসিমের বোন তাসনিম জানান, নিজের ভাইকেই দেখে প্রথমে তিনি চিনতে পারেননি৷ ওয়াসিমকে প্রথম চিনতে পারেন তার বাবা৷ তাসনিম বলেন, ‘তাকে (ওয়াসিম) দেখতে খুব অন্যরকম লাগছিল৷ ততক্ষণে হয়ত খুব পেটানো হয়েছে, কিংবা সে খুব ভয় পাচ্ছিল বলেই হয়ত তাকে বেশ অন্যরকম লাগছিল’।
সিরিয়ায় যুদ্ধ চলছে ১১ বছর ধরে৷ এ যুদ্ধে জড়িত সব পক্ষের বিরুদ্ধেই যুদ্ধাপরাধের অভিযোগ রয়েছে৷ ছয় মিনিটের ভিডিওটি করা হয়েছিল ২০১৩ সালের ১৬ এপ্রিল, অর্থাৎ ওয়াসিম সিয়াম বাড়ি থেকে বের হয়ে নিখোঁজ হওয়ার ঠিক দুদিন পরে৷
সম্প্রতি নয় বছর আগের ছয় মিনিটের একটি ভিডিও খুব সাড়া জাগিয়েছে। দুই সিরীয় যোদ্ধাকে চোখ বাঁধা, নিরস্ত্র মানুষদের হত্যা করতে দেখা গেছে সেই ভিডিওতে।
ভিডিওতে দেখা যায়, বাশার আল আসাদ বাহিনীর অনুগত দুই সদস্য সাদা রঙের একটি ডেলিভারি ভ্যান থেকে ধরে ধরে চোখ বাঁধা মানুষদের নিয়ে আসছেন আর গুলি করে হত্যা করছেন৷
হত্যাকারীকে চিহ্নিত করা আমস্টারডাম বিশ্ববিদ্যালয়ের হলোকস্ট এবং গণহত্যা বিষয়ের অধ্যাপক উগুর উমিত উংগোর ২০১৯ সালে ভিডিওটি হাতে পান। সেই থেকে অজস্রবার দেখে, খুঁটিনাটি বিষয় বিচার-বিশ্লেষণ করে দুই হত্যাকারীকে চিহ্নিত করার চেষ্টা করেছেন তিনি।
এ কাজে তাকে সহায়তা করেছেন সহকর্মী আনসার শাদুদ। তিন বছর অক্লান্ত পরিশ্রম করার পর ওই দুই ব্যক্তিকে চিহ্নিত করতে পেরেছেন তারা। জানা গেছে, দুই হত্যাকারীর একজন নাজিব আল-হালাবি তখন প্রেসিডেন্ট বাশার আল আসাদের অনুগত এক আধা সামরিক বাহিনীতে কাজ করতেন। তবে তিনি এখন বেঁচে নেই। মাছ ধরার টুপি পরা অন্য ব্যক্তি আমজাদ ইউসেফ এখনো জীবিত। এখন তিনি আসাদ সরকারের গোয়েন্দা বাহিনীর কর্মকর্তা।
দুই হত্যাকারীকে চিহ্নিত করার পর আরো তথ্য সংগ্রহের জন্য ‘আনা শ’ ছদ্ম পরিচয়ে প্রেসিডেন্ট আসাদের কর্মকর্তা, কর্মচারীদের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা শুরু করেন আনসার শাদুদ। আসাদের ঘনিষ্ঠদের তিনি বলেন, তার বাড়ি হোমসে এবং তিনিও প্রেসিডেন্ট বাশার আল আসাদের মতো আলাওয়াত গোষ্ঠীর সন্তান। এরপর অল্প কিছুদিনের মধ্যেই সিরিয়ার সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারিদের সঙ্গে আনা শ’র বেশ ভালো সম্পর্ক গড়ে ওঠে।
এক সময় হত্যাকারী আমজাদের সঙ্গেও পরিচয় হয়ে যায় আনসার শাদুদের। কয়েক দিনের মধ্যে দুজনের সম্পর্ক এমন হয়ে যায় যে, আমজাদ ব্যক্তিগত আনন্দ-বেদনার কথাও বলতে শুরু করেন। এভাবে ব্যক্তিগত কথা বলতে বলতেই একদিন আমজাদ বলে ফেলেন, আমি তো বহু মানুষকে হত্যা করেছি। তার ওই বক্তব্য পূর্ব পরিকল্পনা অনুযায়ী রেকর্ড করা হয় এবং সেই রেকর্ড পৌঁছে দেয়া হয় জার্মান এবং ডাচ আইনজীবীদের কাছে।
অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের আন্তর্জাতিক অপরাধ আইন বিষয়ক বিশেষজ্ঞ আলেকজান্ডার শোয়ার্ৎসও ছয় মিনিটের ভিডিটি দেখেছেন। তিনি বলেন, সিরিয়ার দুই সৈন্য নিরস্ত্র, চোখ বাঁধা মানুষগুলোকে যেভাবে হত্যা করেছে তা স্পষ্টতই যুদ্ধাপরাধ। তিনি মনে করেন, পরিকল্পিতভাবেই এই হত্যাকাণ্ড চালানো হয়েছে।
২০১১ সালের মার্চ থেকে ২০২১ সালের মার্চ পর্যন্ত এক দশকে যুদ্ধকবলিত সিরিয়ায় সামরিক-বেসামরিক মিলিয়ে নারী, শিশুসহ ৩ লাখ ৫০ হাজারের বেশি মানুষের প্রাণ গেছে। এ হিসাব জাতিসংঘের। তবে সংস্থাটি বলছে, প্রকৃত সংখ্যা এর চেয়ে অনেক বেশি।
যুক্তরাজ্যভিত্তিক মানবাধিকার পর্যবেক্ষক সংস্থা সিরিয়ান অবজারভেটরি ফর হিউম্যান রাইটসের হিসাবে, ২০২১ সালের জুন পর্যন্ত সিরিয়া যুদ্ধে নিহতের সংখ্যা ৪ লাখ ৯৪ হাজার ছাড়িয়ে গেছে। অন্যদিকে অধিকার সংগঠন ভায়োলেশনস ডকুমেন্টেশন সেন্টার বলছে, চলতি বছরের ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত সিরিয়ায় নিহতের এ সংখ্যা ২ লাখ ৩৮ হাজার। এর মধ্যে ১ লাখ ৪৪ হাজারের বেশি বেসামরিক মানুষ।
যুদ্ধ শুরুর আগে সিরিয়ার জনসংখ্যা ছিল ২ কোটি ২০ লাখ। তাদের অর্ধেকের বেশি যুদ্ধের কারণে উদ্বাস্তু হয়েছে। প্রায় ৭০ লাখ মানুষ ঘরবাড়ি হারিয়ে প্রাণ বাঁচাতে সিরিয়ার এক শহর থেকে অন্যত্র চলে গেছেন। প্রায় ২০ লাখ অসহায় মানুষ বিভিন্ন শরণার্থীশিবিরে জায়গা জুটিয়েছে। ন্যূনতম মৌলিক সেবা ছাড়া সেসব শিবিরে তাদের মানবেতর জীবন কাটছে। আরও প্রায় ৬৮ লাখ সিরিয়াবাসী প্রতিবেশী লেবানন, জর্ডান, তুরস্কসহ বিভিন্ন দেশে পালিয়ে গেছে। অনেকে শরণার্থী হিসেবে ইউরোপে আশ্রয় নিয়েছে। সিরীয়দের দেশ ছাড়ার এসব ঘটনাকে সাম্প্রতিক ইতিহাসে সবচেয়ে বড় শরণার্থী সংকট বলে মত বিশ্লেষকদের।
জাতিসংঘ বলছে, ২০২২ সালের ফেব্রুয়ারিতে সিরিয়ায় ১ কোটি ৪৬ লাখের বেশি মানুষের মানবিক সহায়তা প্রয়োজন ছিল। তাদের মধ্যে প্রায় ৫০ লাখ মানুষ চরম সংকটে ভুগছে। দেশটিতে প্রতিদিন ১ কোটি ২০ লাখের বেশি মানুষ পর্যাপ্ত খাবার পায় না। প্রায় ৫ লাখ সিরীয় শিশু ভয়াবহ অপুষ্টিতে ভুগছে।
বর্তমান বিশ্বে শরণার্থী সমস্যার সবচেয়ে দুঃখজনক চিত্র সিরিয়ায়। সিরিয়ার গৃহযুদ্ধের ফলে এই শরণার্থীদের মানবেতর জীবনযাপন করতে হচ্ছে। উন্নত দেশগুলো যে অর্থ ও ত্রাণ সহায়তা করছে তা খুব সামান্য। যে কারণে সিরিয়ান শরণার্থীদের দুর্দশা চরমে পৌঁছেছে। আন্তর্জাতিকভাবেও রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক সংকট তৈরি করেছে সিরিয়ান শরণার্থীরা।
সিরিয়ার শরণার্থীদের শিশু ও নারীরা পড়েছে স্বাস্থ্য ঝুঁকিতে। ইউরোপের কয়েকটি দেশ সিরিয়া শরণার্থীদের জন্য মানবতার হাত বাড়িয়ে দিলেও আর্থিকভাবে সচ্ছল, উন্নত ও সামরিক শক্তিধর দেশগুলো সিরিয়া শরণার্থীদের ব্যাপারে নিয়েছে কৌশলী ভূমিকা। তাদের আশ্রয় দিতে চাচ্ছে না সব সময় মানবতার বুলি আওড়ানো বেশির ভাগ দেশের রাষ্ট্রনেতারা।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৫২৪
আপনার মতামত জানানঃ