মিয়ানমারে সামরিক বাহিনী ও বিভিন্ন সংগঠিত সশস্ত্র বেসামরিক গোষ্ঠীগুলোর মধ্যে রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ বেড়েই চলেছে। এক বছর আগে সামরিক জান্তা ক্ষমতা গ্রহণের পর থেকে অনেক তরুণ জীবনবাজি রেখে লড়াই করছে সামরিক বাহিনীর বিরুদ্ধে। জান্তা-জনতা এখন মুখোমুখি। এক দেশে পরস্পর হয়ে গেছে পরস্পরের শত্রু।
মিয়ানমারের প্রধান বাণিজ্যিক কেন্দ্র ইয়াঙ্গুনের শহরতলী এলাকার একটি বাস স্টপে বোমা হামলা হয়েছে। এতে ঘটনাস্থলেই নিহত হয়েছে ১ পথযাত্রী, আহত হয়েছে আরও ৯ জন।
মিয়ানমারের দৈনিক পত্রিকা দ্য গ্লোবাল নিউ লাইট অব মিয়ানমারের বরাত দিয়ে বুধবার এক প্রতিবেদনে রয়টার্স জানিয়েছে, এখনও মিয়ানমারের কোনো সশস্ত্র গোষ্ঠী হামলার দায় স্বীকার করেনি। তবে ক্ষমতাসীন জান্তা ও তাদের প্রধান বৈরীপক্ষ গণতন্ত্রপন্থীরা এ ঘটনার জন্য পরস্পরকে দোষারোপ করছে।
মঙ্গলবার সন্ধ্যার দিকে ঘটা সেই হামলার কিছু ছবি প্রকাশ করেছে দ্য গ্লোবাল নিউ লাইট অব মিয়ানমার। প্রত্যক্ষদর্শী ও নিরাপত্তা বাহিনীর বরাত দিয়ে পত্রিকাটি আরও জানিয়েছে, ইয়াঙ্গুনভিত্তিক দাতব্য সংস্থা লিন লাট আহতদের হাসপাতালে ভর্তির ব্যবস্থা করেছে।
নিরাপত্তা বাহিনী ইতোমধ্যে এ ঘটনার তদন্ত শুরু করেছে বলেও নিজেদের প্রতিবেদনে জানিয়েছে দ্যা গ্লোবার নিউ লাইট।
এদিকে, দেশটির জান্তা নিয়ন্ত্রিত সরকারি পত্রিকা তাদের প্রতিবেদনে এ বিস্ফোরণের জন্য মিয়ানমারের সশস্ত্রবাহিনী বিরোধী সশস্ত্র গোষ্ঠী পিডিএফকে (পিপলস ডিফেন্স ফোর্স) দায়ী করে বলেছে, ‘পিডিএফের সন্ত্রাসীরা বোমা হামলা করেছে।’
তবে মিয়ানমারের গণতন্ত্রপন্থীদের ছায়া সরকার ন্যাশনাল ইউনিটি গভর্নমেন্টের (নাগ) প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় ক্ষমতাসীন সামরিক বাহিনীর দাবি নাকচ করে দিয়ে বলেছে, এই হামলার পেছনে রয়েছে জান্তা এবং নাগ এ ঘটনার পৃথক তদন্ত করবে।
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম টুইটারে দেওয়া এক বার্তায় ছায়া সরকারের মুখপাত্র ডা. সাসা বলেছেন, ‘হতাহতদের ন্যায়বিচার নিশ্চিত করতে যা যা করা সম্ভব, আমরা তার সবই করব।’
অভ্যুত্থানের মাধ্যমে মিয়ানমারের গণতন্ত্রপন্থী নেত্রী অং সান সুচির নেতৃত্বাধীন সরকারকে উচ্ছেদ করে ২০২১ সালের ১ ফেব্রুয়ারি মিয়ানমারের জাতীয় ক্ষমতা দখল করে সামরিক বাহিনী। মিয়ানমারের সেনাপ্রধান মিন অং হ্লেইং এ অভ্যুত্থানে নেতৃত্ব দেন।
অভ্যুত্থানের পর থেকেই দেশটিতে শান্তিপূর্ণ আন্দোলন-বিক্ষোভ শুরু করে দেশটির গণতন্ত্রপন্থী শক্তি ও সাধারণ জনগণ। প্রথম পর্যায়ে বিক্ষোভ দমন করতে লাঠি, জলকামান, রবার বুলেট ব্যবহার করা হলেও একসময় নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যদের প্রাণঘাতী অস্ত্র ব্যবহারের নির্দেশ দেয় জান্তা।
দেশটির রাজনৈতিক কয়েদিদের আইনী সহায়তা দানকারী সংস্থা অ্যাসিসটেন্স অ্যাসোসিয়েশন অব পলিটিক্যাল প্রিজনার্সের (এএপিপি) তথ্য অনুযায়ী, গত প্রায় দেড় বছরে নিরাপত্তা বাহিনীর গুলিতে মিয়ানমার জুড়ে ১ হাজার ৮০০’রও বেশি মানুষের মৃত্যু হয়েছে।
এদিকে, শান্তিপূর্ণ বিক্ষোভ কর্মসূচি দমনে নিরাপত্তা বাহিনী প্রাণঘাতী অস্ত্র ব্যবহার শুরুর পর গণতন্ত্রপন্থী বিভিন্ন শক্তিও নিজেদের মধ্যে সংগঠিত হওয়া শুরু করে। গত বছরের মাঝামাঝি সময়ে মিয়ানমারে ন্যাশনাল ইউনিটি গভর্নমেন্ট নামের একটি ছায়া সরকার গঠিত হয়, যা মূলত দেশটিতে সক্রিয় বিভিন্ন গণতান্ত্রিক দল ও জান্তাবিরোধী সশস্ত্র গোষ্ঠীসমূহের জোট।
অং সান সু চি ও তার সরকারের সঙ্গে উত্তেজনা চলছিল মিয়ানমারের সেনাবাহিনীর, এর ফলে ২০২১ সালের ১ ফেব্রুয়ারির সকালে মিয়ানমারে একটি সেনা অভ্যুত্থান সংগঠিত হয়। ২০২০ সালের ৮ নভেম্বরে অনুষ্ঠিত নির্বাচনে সু চির দল ন্যাশনাল লিগ ফর ডেমোক্রেসি ৮৩ শতাংশ আসনে জয়ী হয়। ২০১১ সালে সেনা শাসনের অবসানের পর এটি ছিল দ্বিতীয় দফা নির্বাচন। তবে নির্বাচনে কারচুপির অভিযোগ তোলে মিয়ানমারের সেনাবাহিনী। সংকটের শুরুটা মূলত এখান থেকেই।
সামরিক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে অং সান সু চির নির্বাচিত সরকারকে উৎখাত ও ক্ষমতার পালাবদলের পর থেকে মিয়ানমারে অস্থিতিশীলতা জারি রয়েছে।এই ঘটনার পর দেশটিতে তীব্র গণ-আন্দোলন শুরু হয় এবং সামরিক ক্ষমতার জোরেই বার্মিজ সেনাবাহিনী তা দমনের চেষ্টা করে। এতে নিহত হচ্ছে শিশু নারীসহ অনেক বেসামরিক মানুষ।
মিয়ানমারে সামরিক অভ্যুত্থান হয় গত বছরের ১ ফেব্রুয়ারি। এর মাত্র এক বছরের মাথায় দেশটির ভেতরে পাঁচ লাখেরও বেশি মানুষ স্থানচ্যুত হয়েছে। লাখ লাখ মানুষ তাদের খাদ্য ও চিকিৎসা খরচ বহনের সক্ষমতা হারিয়েছে। পরিস্থিতি এতটাই নাজুক যে, নারীরা তাদের মাসিক ঋতুকালের জন্য দরকারি স্যানিটারি প্যাড জোগাড় করতে পারছে না। এতে চরম স্বাস্থ্যঝুঁকিতে পড়েছে তারা।
এদিকে সংঘাতপূর্ণ এলাকায় স্থানীয় বাজার বন্ধ হয়ে গেছে। দোকানে পণ্য সরবরাহ করাও কঠিন হয়ে পড়েছে। জরুরি পণ্য পরিবহনও বন্ধ করে দিয়েছে সেনাবাহিনী। তারা এটি করছে যাতে সশস্ত্র প্রতিরোধ দলের সদস্যরা খাবার না পেয়ে আস্তানা থেকে বেড়িয়ে আসে।
মিয়ানমারের নারীরা আল-জাজিরাকে জানিয়েছেন, চলমান পরিস্থিতিতে বিশুদ্ধ পানি ও স্যানিটারি প্যাড পেতে সমস্যা হচ্ছে। প্যাডের দাম ক্রমবর্ধমানভাবে তাদের বাজেটের বাইরে চলে গেছে। এছাড়া নারীদের ব্যক্তিগত গোপনীয়তার সুযোগও কমে গেছে।
প্রতিবেদনে নারীদের মাসিকের সময় মৌলিক প্রয়োজন মেটানোর সামর্থ্য কমে যাওয়ার কারণ হিসেবে উঠে এসেছে আবাসিক এলাকায় সেনাদের হামলা, চলমান অস্থিরতা এবং বাস্তুচ্যুতির ঘটনা।
কলম্বো বিশ্ববিদ্যালয়ের গণস্বাস্থ্য গবেষক ম্যাগি স্মিত ২০১৫ সাল থেকে আন্তর্জাতিক উদ্ধার কমিটির সঙ্গে কাজ করছেন। তিনি বলেন, বাস্তুচ্যুত নারীরা রজ:স্রাবকালের দরকারি সামগ্রী কিনতে পারছেন না। যারা কিনতে পারছেন তারা সবাই নিরাপদ ও স্বাস্থ্যকর পণ্য পাচ্ছেন না। এছাড়া পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন হওয়ার জন্য স্বাস্থ্যকর ও পরিচ্ছন্ন টয়লেটেরও অভাব রয়েছে।
বছরের পর বছর ধরে সামরিক শাসনের অধীনে থাকার অভিজ্ঞতা মিয়ানমারবাসীর রয়েছে। তবে গত এক বছরের জান্তা শাসনে দেশটিতে রক্ত ঝরেছে প্রচুর। ২০২১ সালের ১ ফেব্রুয়ারি রক্তপাতহীন সামরিক অভ্যুত্থানের পর থেকে জান্তাবিরোধী তুমুল বিক্ষোভ, বিশেষত তরুণদের প্রতিবাদ, রক্তপাত মিয়ানমারকে গৃহযুদ্ধের দিকে ঠেলে দিয়েছে। অনেকে জান্তা সরকারের বিরুদ্ধে অস্ত্র হাতে তুলে নিয়েছেন।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৪০৮
আপনার মতামত জানানঃ