আমরা যতই চাঁদ, মহাকাশ জয় করি না কেন, পৃথিবীর অনেক রহস্যই আজও অজানাই রয়ে গেছে। আমাজন জঙ্গল এমনই একটি রহস্য। এটি পৃথিবীর সবচেয়ে বড় জঙ্গল।
আমাজনের গভীর জঙ্গলের আড়ালে লুকিয়ে আছে প্রাচীন শহর। কিন্তু এত দিন কোনও মানুষ খোঁজ পাননি এই শহরের। তবে সম্প্রতি এই শহরের খোঁজ মিলল অত্যাধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করে। খবর আনন্দবাজার
নতুন প্রযুক্তি ব্যবহার করে এই হারানো শহরগুলির খোঁজ পাওয়া গিয়েছে। নতুন এই প্রযুক্তির নাম ‘লেজার ইন দ্য স্কাই’। ঘন গ্রীষ্মমণ্ডলীয় বনের গভীরে কী আছে, তা জানতেই এই প্রযুক্তি ব্যবহার করা হয়।
এই প্রযুক্তিতে হেলিকপ্টার, ছোট বিমান বা ড্রোনের সঙ্গে যুক্ত একটি লেজার স্ক্যানার দিয়ে আকাশ থেকেই ভূখণ্ড জরিপ করে দেখা হয়। এই লেজারের স্ক্যানিংয়ের ফলে ওই ভূখণ্ডের একটি ডিজিটাল মডেল কম্পিউটারের পর্দায় ধরা পড়ে।
বলিভিয়ার ল্যানোস ডি মোজোস সাভানা জঙ্গলে এই শহরগুলির খোঁজ পাওয়া গিয়েছে। বহু বছর ধরে ঘন গাছের ছাউনির নীচে লুকিয়ে ছিল এই শহরগুলি।
গবেষকদের মতে, এই শহর ৫০০ থেকে ১৪০০ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে তৈরি। জঙ্গলের কাসারাবে সম্প্রদায় এই শহরগুলি তৈরি করেছিল বলেই প্রাথমিকভাবে মনে করা হচ্ছে।
‘লেজার ইন দ্য স্কাই’ প্রযুক্তিতে যে ছবি ধরা পড়েছে, তাতে দেখা গিয়েছে, ঘন জঙ্গলের ভেতরে বিস্তৃত এবং জটিল কিছু কাঠামো। পাশাপাশি ৫৪ একর জুড়ে বিস্তৃত এই কাঠামোতে ১৬ ফুট উঁচু ছাদও রয়েছে।
৩০টি ফুটবল মাঠের সমান এই কাঠামোর পাশে ৬৯ ফুট লম্বা এক পিরামিডের খোঁজও মিলেছে।
এ ছাড়াও আমেরিকা এবং জার্মানির গবেষকদের আন্তর্জাতিক দল এই শহরের কয়েক মাইলের মধ্যে বিস্তৃত জলাধার এবং একাধিক ছোট ছোট কাঠামোও খুঁজে পেয়েছেন।
আর এই লুকনো শহরগুলির খোঁজ আমাজনে বসবাসকারী সম্প্রদায়ের সম্পর্কে পুরনো সব ধারণা বদলে দিচ্ছে।
গবেষকরা মনে করছেন, বনাঞ্চলে বসবাস করলেও আমাজনে এমন কিছু সম্প্রদায় বাস করত, যারা সময়ের তুলনায় বেশ কিছুটা এগিয়ে ছিল।
আমাজনের জঙ্গলে এই নয়া আবিষ্কৃত এলাকাকে কেন্দ্র করে একটি নগর-সভ্যতা গড়ে উঠেছিল বলেও গবেষকরা মনে করছেন।
একই সঙ্গে এই শহরগুলির প্রাথমিক গঠন দেখে মনে করা হচ্ছে যে, এই সভ্যতার মানুষেরা স্থাপত্যকার্যে বেশ নিপুণ ছিলেন। এবং এই এলাকা যথেষ্ট পরিকল্পনা মাফিক তৈরি করা হয়েছিল বলেও গবেষকরা দাবি করেছেন।
বনাঞ্চলে বসবাস করলেও আমাজনে এমন কিছু সম্প্রদায় বাস করত, যারা সময়ের তুলনায় বেশ কিছুটা এগিয়ে ছিল।
বিংশ শতাব্দীর শেষ পর্যন্ত মনে করা হত, আমাজন অঞ্চলের বাসিন্দারা মূলত শিকারি উপজাতির এবং আমাজন অঞ্চলের দক্ষিণ-পশ্চিম প্রান্তে থাকা মোজোস সমভূমিতে বছরে কয়েক মাস বন্যা হওয়ার কারণে এই এলাকার বাসিন্দারা স্থায়ী বসতি তৈরি করতে পারেন না।
তবে সাম্প্রতিক কালে সাভানা বনাঞ্চল জুড়ে হওয়া আবিষ্কারে সেই বদ্ধমূল ধারণা অনেকটাই মিথ্যে প্রমাণিত করেছে।
এই লুকনো শহরগুলির চারপাশ একটি প্রাচীর দিয়ে ঘেরা ছিল বলেও গবেষকরা মনে করছেন।
জঙ্গলের ঘনত্ব এবং একাধিক উঁচু মাটির ঢিপির কারণে এই শহরগুলির বেশ কয়েকটি এলাকা এখনও গবেষকদের চোখে ধরা পড়েনি বলেও গবেষকদের দল জানিয়েছেন।
আমাজন জঙ্গল নিয়ে বিশদে জানতে গবেষকরা প্রথমবার বায়ুবাহিত লেজার প্রযুক্তি ব্যবহার করেন। আর তখনই লেজার চিত্রে এই শহরের ছবি ধরা পড়ে।
তবে জঙ্গলের মধ্যে এই শহুরে এলাকাগুলিতে কত মানুষ বাস করত, তা এখনও অনুমান করা সম্ভব নয় বলেই জানিয়েছেন গবেষকরা। তবে প্রাথমিকভাবে এই এলাকা মোটামুটি ঘনবসতিপূর্ণ ছিল বলেও তারা মনে করছেন।
এখানকার বাসিন্দারা কেন এই শহর ছেড়ে চলে গিয়েছিলেন, তা-ও গবেষণা সাপেক্ষ বলেই গবেষকরা মনে করছেন।
আমাজান জঙ্গল আমাজন নদীর অববাহিকায় অবস্থিত পৃথিবীর সবচেয়ে বড় নিরক্ষীয় বন, যা দক্ষিণ আমেরিকা মহাদেশের উত্তরভাগে অবস্থিত ৯টি দেশের অন্তর্ভুক্ত। এর আয়তন প্রায় সাড়ে পাঁচ মিলিয়ন বর্গ কিলোমিটার। আমাজান বন অত্যন্ত দুর্গম। তবে দক্ষ গাইডসহ নদী পথে ভ্রমণ এই নিরক্ষীয় বনের প্রাকৃতিক বিষ্ময় দেখার সবচেয়ে ভালো উপায়।
প্রাচীনকাল থেকেই অভিযাত্রীরা আমাজানে যাত্রা করে মূলত স্বর্ণ, রৌপ্য এবং ধন-রত্নের খোঁজে। পর্তুগিজ অভিযাত্রীরা বিশ্বাস করত, বিশাল এ বনের মধ্যেই কোথাও লুকিয়ে আছে ‘এলডোরাডো’ নামক এক গুপ্ত শহর, যা পুরোপুরি সোনার তৈরি। এই ভ্রান্ত ধারণাটি এসেছে গ্রিক পৌরাণিক গল্প থেকে যেখানে বলা হয়েছে যে ‘এলডোরাডো’ নামক সোনায় মোড়ানো শহরটি পাহারা দেয় এক শ্রেণীর বিশেষ নারী যোদ্ধারা, যাদেরকে গল্পে ‘আমাজন’ বলে অভিহিত করা হয়েছে। পর্তুগিজ, স্প্যানিশ এবং ফ্রেঞ্চ অভিযাত্রীরা প্রতিযোগিতায় নামে এই ‘এলডোরাডো’ শহর আবিষ্কারের জন্য। কিন্তু কেউ এই কাল্পনিক শহরের খোঁজ পায়নি। শহরের সন্ধান না পেলেও স্থায়ী হয়ে যায় সেই নারী যোদ্ধাদের নাম। তাদের নামানুসারেই এই জঙ্গলের নাম হয় ‘আমাজান’ জঙ্গল।
অ্যামাজন জঙ্গল। অপার বিস্ময়ের অরণ্য। কী নেই এখানে! প্রাণী বৈচিত্র্য, উদ্ভিদ বৈচিত্র্য আরও কত কি! সম্প্র্রতি বিজ্ঞানীরা জানান, অ্যামাজনের জঙ্গলে গাছের প্রজাতির সংখ্যার তালিকা তৈরি করতে তিনশ বছর লেগে যাবে। এরই মধ্যে জাদুঘরে রাখা ৫ লাখেরও বেশি উদ্ভিদের নমুনা পরীক্ষা করা হয়েছে। এ পর্যন্ত গাছের প্রায় ১২ হাজার প্রজাতি আবিষ্কৃত হয়েছে।
ধারণা করা হচ্ছে, আরও প্রায় চার হাজার বিরল প্রজাতির উদ্ভিদের দেখা মিলতে পারে পৃথিবীর ফুসফুস খ্যাত আমাজনে। বিজ্ঞানীরা আরও নতুন নতুন আবিষ্কার এবং সেসব লিপিবদ্ধ হওয়ার অপেক্ষায় রয়েছে। আমাজনে আছে মাংসখেকো গাছ। এই গাছের আঠায় প্রজাপতি, ফড়িংয়ের মতো ছোট প্রাণীরা আটকে যায়। তখন গাছের পাতা ঢেকে গিলে নিতে শুরু করে।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৭০৭
আপনার মতামত জানানঃ