আজ নিরাপদ মাতৃত্ব দিবস। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ১৯৯৭ সালের ২৮ মে নিরাপদ মাতৃত্ব দিবস ঘোষণা করেন এবং ১৯৯৮ সাল থেকে দেশব্যাপী জাতীয়ভাবে দিবসটি পালিত হয়ে আসছে।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা-ডব্লিউএইচও’র মতে, একজন মা গর্ভাবস্থা, প্রসব অবস্থা ও প্রসব পরবর্তী ৪২ দিনের মধ্যে মারা গেলে ঐ ঘটনাকে ‘মাতৃমৃত্যু’ হিসেবে গণ্য করা হয়।
সংস্থাটি বলছে, প্রসবজনিত জটিলতায় সারা বিশ্বে প্রতি দিন ৮০০ মাতৃমৃত্যু হয়। এর ৯৯ শতাংশ মৃত্যুই উন্নয়নশীল দেশে হয়ে থাকে।
স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের দেওয়া তথ্যানুযায়ী, দেশে বর্তমানে প্রতি লাখে জীবিত শিশুর জন্ম দিতে গিয়ে মাতৃমৃত্যু ১৬৫ জন, যা ২০০৯ সালে ছিল ২৫৯ জন। গত ১০ বছরে মাতৃমৃত্যু হার কমেছে প্রতি লাখে জীবিত শিশুর জন্মে প্রায় ৯৪ জন। যদিও গত ১০ বছরের পরিসংখ্যানে কিছুটা উন্নতি হয়েছে।
দেশের মাতৃমৃত্যু হারের কারণগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বেশি ঘটে হেমারেজে, যা ৩১ শতাংশ। বর্তমান সরকার জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণ ও প্রসূতি মায়ের দক্ষ সেবা নিশ্চিত করার বিষয়টি অগ্রাধিকার দিয়ে বেশ কিছু কার্যক্রম হাতে নিয়েছে। টেকসই উন্নয়নের লক্ষ্যমাত্রা (এসডিজি) অর্জনে ২০৩০ সালের মধ্যে দেশে মাতৃমৃত্যুর হার প্রতি লাখে ৭০ জনে নামিয়ে আনার লক্ষ্যে সরকার ব্যাপক কাজ করছে।
বিশেষজ্ঞদের মতে, নিরাপদ মাতৃত্ব নিশ্চিত করতে এখনো চিকিৎসকদের বিপরীতে অভিজ্ঞ নার্সের সংখ্যা অনেক কম। প্রয়োজনের তুলনায় প্রশিক্ষিত ধাত্রীর সংখ্যাও কম। কিন্তু মাতৃ ও শিশুমৃত্যু কমাতে তাদের ভূমিকা অপরিহার্য। একজন দক্ষ ও প্রশিক্ষিত নার্স-ধাত্রী তৈরিতে প্রতিষ্ঠানিক শিক্ষা ও কর্মপরিবেশ জরুরি বলে বিশেষজ্ঞরা মনে করেন।
‘শিশু ও মাতৃমৃত্যুর হার কমানোর কৌশল নির্ধারণ’ সংক্রান্ত একটি সভায় স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক হোম ডেলিভারিকে নিরুৎসাহিত করার নির্দেশনা দেন।
তিনি বলেন, প্রায় ১৪ হাজার কমিউনিটি ক্লিনিকের মাধ্যমে দেশের আনাচে-কানাচে স্বাস্থ্যসেবা পৌঁছে গেছে। এখন মায়েদের হোম ডেলিভারিতে নিরুৎসাহিত করতে মাঠ পর্যায়ের স্বাস্থ্যকর্মীদের উদ্যোগী হতে হবে। যত্রতত্র ও অস্বাস্থ্যকর ক্লিনিকে মায়েদের ডেলিভারি বন্ধ করতে হবে। দেশের সরকারি হাসপাতালে সেবা নিতে উদ্ধুদ্ধ করতে হবে। যেসব ক্লিনিক স্বাস্থ্য সম্মত নয়, সেগুলো প্রয়োজনে সিলগালা করে দিতে হবে। লোকবল আরো প্রয়োজন হলে নিয়োগ দিন।
মন্ত্রী বলেন, মিডওয়াইফ কর্মীদের কাজে লাগাতে হবে। তাদের নিরাপদ ডেলিভারি করাতে উৎসাহিত করতে হবে। যেখানে যে উদ্যোগ প্রয়োজন সেখানে সেভাবেই কাজ করতে হবে, তবুও মাতৃমৃত্যু হার ধীরে ধীরে ৫০-এর নিচে নামিয়ে আনতে হবে।
মাতৃমৃত্যুর পেছনে অনেক কারণ আছে, আর সেগুলোর শিকড় প্রোথিত রয়েছে দারিদ্র্য, অসাম্য আর যৌনবিদ্বেষের ভেতর। বেশিরভাগ নারীই মারা যান সেসব প্রত্যন্ত, পিছিয়ে পড়া, আলোর মুখ না দেখা অঞ্চলগুলোতে, যেখানে এখনও প্রয়োজনীয় চিকিৎসা ব্যবস্থা গিয়ে পৌঁছায়নি।
উন্নত বিশ্বে যেখানে একজন নারীর প্রসবের পেছনে কাঁড়ি কাঁড়ি অর্থ ঢালা হয়, সেখানে প্রত্যন্ত অঞ্চলে নারীরা ঘরের এককোণে শুয়ে অশিক্ষিত দাইয়ের হাতে সন্তান জন্ম দিতে গেলে তাদের মধ্যে অনেকেরই যে মৃত্যু ঘটবে, সেটিই তো স্বাভাবিক।
২০১৪ সালে, বিশ্বের প্রসূতিশাস্ত্রের চালচিত্র বিষয়ক একটি প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, বিশ্বে যত দাই, সেবিকা ও চিকিৎসক রয়েছেন, তাদের মধ্যে মাত্র ৪২% বাস করেন ঐ ৭৩টি দেশে, যেখানে মা ও নবজাতক শিশুর মৃত্যুর হার সবচেয়ে বেশি।
এর মানে দাঁড়াচ্ছে, আজও তৃতীয় বিশ্বের এক বিশাল নারীগোষ্ঠী পেশাদার কারও সাহায্য ছাড়াই, একা একা কিংবা প্রতিবেশী কোনো তথাকথিত দাইয়ের সহায়তায় সন্তান জন্ম দিচ্ছে। আর এ থেকেই সব জটিলতা বাড়ছে, সেই সাথে বাড়ছে ঝুঁকি ও মৃত্যু প্রবণতাও।
প্রত্যন্ত অঞ্চলের নারীদের ক্ষেত্রে আরেকটি বিষয় কাজ করে। সেই বিষয়টি হলো অর্থনৈতিক। প্রত্যন্ত অঞ্চলে যেহেতু অনেক দূরে দূরে একেকটি স্বাস্থ্য কেন্দ্রের অবস্থান, তাই অনেক নারীকেই এমন জায়গায় বাস করতে হয় যার আশেপাশে ১০-১৫ মাইলের মধ্যেও কোনো স্বাস্থ্যকেন্দ্র নেই। হঠাৎ তাদের প্রসব বেদনা উঠলে বা তারা অসুস্থ অনুভব করতে থাকলে দ্রুত তাদেরকে স্বাস্থ্য কেন্দ্রে নিয়ে যেতে প্রয়োজন উচ্চমূল্যের পরিবহন ব্যবস্থা, যার খরচ মেটানোর মতো আর্থিক সঙ্গতি অধিকাংশেরই থাকে না।
দ্য গাটম্যাচার ইনস্টিটিউট হিসাব কষে দেখিয়েছে, লাতিন আমেরিকায় যেখানে ৯০% নারীই তাদের সন্তানের জন্ম দেবে উন্নত কোনো স্বাস্থ্য কেন্দ্রে, সেখানে আফ্রিকার নারীদের মাঝে সেই হার হবে কেবলই ৫০%।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, গর্ভাবস্থায় তথা সন্তান জন্ম দেয়ার পূর্বে একজন নারীকে অন্তত আটবার চিকিৎসকের কাছে গিয়ে নিজের শারীরিক পরীক্ষা করিয়ে আসতে হবে। এই পরীক্ষাগুলোর মাধ্যমে গর্ভবতী নারীর শরীরের হালনাগাদ অবস্থা সম্পর্কে যেমন জানা যায়, তেমনই নিশ্চিত হয়ে নেয়া যায় যে, সন্তান জন্ম দিতে গিয়ে তাকে কোনো জটিলতার সম্মুখীন হতে হবে কি না, আর যদি সে সম্ভাবনা থাকে তবে তা কীভাবে আগে থেকেই প্রতিরোধ করা সম্ভব।
কোনো নারীর পারিপার্শ্বিক সমস্যা থাকলে, যেমন তার যদি ম্যালেরিয়া রোগ হয়ে থাকে বা তিনি এইচআইভি পজিটিভ হন, তবে এই পরীক্ষাগুলোর প্রয়োজনীয়তা আরও বেশি। কিন্তু অনুন্নত দেশের নারীদের গর্ভাবস্থায় আটবার চিকিৎসকের কাছে যাওয়ার প্রবণতা একদমই কম।
গাটম্যাচারের হিসাব অনুযায়ী, উন্নয়নশীল দেশগুলোতে ৬৩% নারী যেখানে গর্ভাবস্থায় অন্তত চারবার চিকিৎসকের কাছে গিয়ে স্বাস্থ্য পরীক্ষা করান, আফ্রিকা অঞ্চলে সে পরিমাণ ৫১%।
সংস্থাটি বৈজ্ঞানিক হিসাবের মাধ্যমে আরও জানাচ্ছে যে, সকল গর্ভবতী নারীই যদি বিশ্ব স্বাস্থ্য সংখ্যার সুপারিশ মেনে চলতো, তাহলে বিশ্বব্যাপী মাতৃমৃত্যুর হার ৬০% হ্রাস পেত। অর্থাৎ, বছরে তখন মাতৃমৃত্যুর ঘটনা ঘটতো মাত্র ১,১২,০০০টি।
এসডব্লিউ/এসএস/১৫৩০
আপনার মতামত জানানঃ