মাত্র তিন বছরের মধ্যেই দেশে মোবাইল ফোনে অর্থ লেনদেনের ক্ষেত্রে ‘নগদ’ এখন বেশ পরিচিত একটি নাম। বেশ প্রশংসনীয়ভাবেই নগদ বাজারের বড় একটা অংশ তাদের নিয়ন্ত্রণে নিয়েছে। তবে এখনো নগদের মালিকানা ও ব্যবসা পরিচালনা নিয়ে যে জটিলতা, সেটির সুরাহা হয়নি। এমনকি সাধারণ মানুষের কাছে ডাক অধিদপ্তরের সেবা হিসেবে পরিচিত হলেও, আদতে এর মালিকানায় সম্পৃক্ততা নেই ডাক অধিদপ্তরের। এই ব্র্যান্ডই মূলত নগদের এতো অল্প সময়ে মানুষের কাছে বিশ্বস্ততা অর্জনের প্রধাণ কারণ। তবে এই অসৎ অবস্থানের পরেও সগৌরবে কার্যক্রম চালাচ্ছে নগদ।
বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্দেশনা অনুসারে অংশীদারত্বের জায়গা থেকে ডাক বিভাগ এবং ‘নগদ’ (থার্ড ওয়েভ টেকনোলজিস লিমিটেড) কর্তৃপক্ষ এখন মালিকানার পর্যায়ে যাওয়ার প্রক্রিয়ায় রয়েছে। দুই পক্ষের সঙ্গে সমঝোতার ভিত্তিতেই ডাক বিভাগ ৫১ শতাংশ এবং ‘নগদ’ ৪৯ শতাংশের মালিক হচ্ছে। বিষয়টি এখন রাষ্ট্রের আইন অনুসারে অনুমোদনের অপেক্ষায় আছে।
সরকারি ডাক বিভাগের সেবা হওয়ায় শুরু থেকে অন্যান্য এমএফএস প্রতিষ্ঠানের চেয়ে বাড়তি কিছু সুবিধা পেয়েছে প্রতিষ্ঠানটি। যার সুফল গ্রাহকেরাও পেয়েছেন। এ কারণে অল্প সময়ে বিপুল গ্রাহক তৈরি হয় নগদের। এমএফএস প্রতিষ্ঠান হলেও নগদ এখনো বাংলাদেশ ব্যাংকের অনুমোদিত প্রতিষ্ঠান নয়। তবে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের অনুমোদনের বিষয়টি প্রক্রিয়াধীন।
যৌথ মূলধন কোম্পানি ও ফার্মগুলোর পরিদপ্তরের (আরজেএসসি) হালনাগাদ তথ্য অনুযায়ী, থার্ড ওয়েভ টেকনোলজির নাম পরিবর্তন করে নগদ করা হয়েছে। আর মালিকানায় যুক্ত হয়েছেন নতুন অনেকে, ছেড়েও দিয়েছেন কেউ কেউ। প্রায় তিন বছরে দফায় দফায় একাধিকবার মালিকানায় পরিবর্তন হয়েছে নগদের। এখন নগদের পরিচালক ৯ জন, যারা বাংলাদেশসহ বিভিন্ন দেশে নিবন্ধিত বিভিন্ন কোম্পানির প্রতিনিধি। এর মধ্যে যুক্তরাজ্য, কানাডা ও সিঙ্গাপুরের ১ জন করে নাগরিক রয়েছেন। অন্য ৬ জন বাংলাদেশি।
নগদের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) তানভীর আহমেদ নিজের নামে থাকা অধিকাংশ শেয়ার তারই অন্য প্রতিষ্ঠান এশিয়া টেলিকম হোল্ডিংস লি. ও বাকি শেয়ার অন্য পরিচালক শাফায়েত আলমের কাছে ২০২০ সালের ফেব্রুয়ারিতে হস্তান্তর করেছেন। গত ১ জুলাই থেকে তিনি এশিয়া টেলিকম হোল্ডিংয়ের মনোনীত নগদের পরিচালক হিসেবে এমডি পদে আছেন।
শেয়ার হোল্ডারদের সভায় ডাক বিভাগের উপস্থিতি নাই
নগদের মালিকানায় অধিকাংশ সরকারের ডাক বিভাগের অধীনে থাকলেও নগদের কার্যক্রমে ডাক বিভাগকে তেমন একটা দেখা যায় না। অথবা ডাক বিভাগকে এড়িয়ে নগদের দায়িত্বরতরা নানা কৌশলে নগদের লভ্যাংশ থেকে ডাক বিভাগকে দূরে রাখতে চাইছে।
সম্প্রতি তেমনি একটি ঘটনা সামনে এসেছে। গত ৯ই মার্চ বিপুল পরিমান বোনাস শেয়ার ইস্যু করে নগদ। কিন্তু সেখানে ডাক বিভাগ সংশ্লিষ্ট কাউকেই উপস্থিত থাকতে দেখা যায়নি। এমনকি মুনাফার টাকা বাংলাদেশ ডাক বিভাগ পাওয়ার অধিকার থাকলেও বোনাস শেয়ারে প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী তা ঘটেনি। অনেকটা ডাক বিভাগের আড়ালেই যেন বাগ-বাটোয়ারা হয়েছে। এবিষয়ে ডাক বিভাগের সংশ্লিষ্ট কারোই উচ্চবাচ্চ শোনা যায়নি।
বোনাস শেয়ার বরাদ্ধের নথি
প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী বোনাস শেয়ার হোল্ডার মধ্যে দেখা যাচ্ছে, নগদের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) তানভীর আহমেদের নিজের রয়েছে ৯,৬০,০৯৪ শেয়ার এবং তার কোম্পানি ‘তাসিয়া হোল্ডিং লি.’এর নামে রয়েছে ২৬,৭৫,৫২৯টি শেয়ার। দুই নামে আরও পেয়েছেন সিঙ্গাপুরের কোম্পানি, ‘চৌধুরী ফ্রন্টিয়ার হোল্ডিং এলএলসি’ এবং ‘চৌধুরী বেঙ্গল ফিনটেক’ এর ফয়সাল আহসান চৌধুরী। বিদেশি আরেক কোম্পানি মায়ার্স হোল্ডিং লিমিটেডের গাইলস অ্যালাস্টার জেমস ফারলিও আছেন তালিকায়।
মালিকানার তালিকা অনুযায়ী আওয়ামী লীগ এমপি নাহিম রাজ্জাকের নগদে ৩৬০,০০০ শেয়ার রয়েছে।
এছাড়া ফিঞ্চলিউশনের রাহেল আহমেদ, ব্লু ওয়াটার্স হোল্ডিং এর সাফায়েত আলমসহ আরও অনেকের নাম রয়েছে।
২১ সেপ্টেম্বর ২০২১ প্রথম আলোতে প্রকাশিত একটি প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, ডাক অধিদপ্তরের মহাপরিচালক মো. সিরাজ উদ্দিন বলেছেন, ‘বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্দেশনা অনুসারে অংশীদারত্বের জায়গা থেকে ডাক বিভাগ এবং ‘নগদ’ (থার্ড ওয়েভ টেকনোলজিস লিমিটেড) কর্তৃপক্ষ এখন মালিকানার পর্যায়ে যাওয়ার প্রক্রিয়ায় রয়েছে। দুই পক্ষের সঙ্গে সমঝোতার ভিত্তিতেই ডাক বিভাগ ৫১ শতাংশ এবং ‘নগদ’ ৪৯ শতাংশের মালিক হচ্ছে। বিষয়টি এখন রাষ্ট্রের আইন অনুসারে অনুমোদনের অপেক্ষায় আছে’।
তাহলে কিভাবে হালনাগাদ করা এ সকল ব্যবসায়ীক দলিলে কেবল বিভিন্ন ব্যক্তি ও বৈদেশিক প্রতিষ্ঠানের নাম? তাহলে কি বাংলাদেশ ডাক বিভাগের নগদে কোন অংশীদারত্ব নেই?
নগদের মালিকানায় অধিকাংশ সরকারের ডাক বিভাগের অধীনে থাকলেও নগদের কার্যক্রমে ডাক বিভাগকে তেমন একটা দেখা যায় না। অথবা ডাক বিভাগকে এড়িয়ে নগদের দায়িত্বরতরা নানা কৌশলে নগদের লভ্যাংশ থেকে ডাক বিভাগকে দূরে রাখতে চাইছে।
কখনো কখনো কোনো কোম্পানি শেয়ারহোল্ডারদেরকে নগদ লভ্যাংশ না দিয়ে শেয়ার অথবা একইসঙ্গে নগদ অর্থ ও শেয়ার দিয়ে থাকে। বিনিয়োগকারীদের কাছে তা বোনাস লভ্যাংশ হিসেবে পরিচিত।
সাধারণত কোম্পানি তার ব্যবসা সম্প্রসারণের প্রয়োজনে সঞ্চিতির একাংশকে মূলধনে রূপান্তর করে। যে পরিমাণ অর্থ মূলধনে রুপান্তর করা হয় তার সমপরিমাণ অর্থের শেয়ার ইস্যু করা হয়। আর তা আনুপাতিক হারে বিতরণ করা হয় শেয়ারহোল্ডারদের মধ্যে।
আমাদের দেশে ব্যবসা সম্প্রসারণের প্রয়োজন না হলেও অনেক সময় বোনাস ইস্যু করা হয়ে থাকে। আর এসব ক্ষেত্রে কিছু অসাধু উদ্যোক্তা নানা হীন উদ্দেশ্য থেকে এ পথ বেছে নেন।
অর্থনীতিবিদরা বলেন, পুরনো ধ্যান ধারণার কারণে অনেক বিনিয়োগকারী লভ্যাংশ হিসেবে নগদ অর্থের চেয়ে বোনাসকে বেশি গুরুত্ব দিয়ে থাকেন। ফলে ভালো বোনাস দিলে বাজারে সে কোম্পানির শেয়ারের দাম অনেক বেড়ে যায়। বেনামী শেয়ার ব্যবসা থেকে লাভবান হওয়ার হীন উদ্দেশ্য থেকে অনেক ছোট ও স্থবির কোম্পানিও বোনাস ইস্যু করে থাকে।
তারা বলেন, অনেক সময় নগদ অর্থ হাতছাড়া না করার বাসনা থেকেও বোনাস লভ্যাংশ দেওয়া হয়ে থাকে।
তারা বলেন, অনেক রুগ্ন কোম্পানির উদ্যোক্তারা কারসাজির মাধ্যমে কোম্পানিকে লাভজনক দেখিয়ে বোনাস শেয়ার ইস্যু করে। পরবর্তীতে সে শেয়ার বাজারে বিক্রি করে প্রচুর অর্থ তুলে নেয়। কিন্তু বাস্তবে কোম্পানিগুলো লোকসানি হওয়ায় এদের পক্ষে নগদ লভ্যাংশ ঘোষণা করা সম্ভব নয়।
আল-জাজিরার অনুসন্ধানী দলের সদস্য ও অধিকারকর্মী জুলকারনাইন সায়ের খান আজ (২৭ মে ২০২২) তার এক ফেসবুক পোস্টে বিষয়টা তুলে ধরেছেন। সেখানে তিনি এবিষয়ে বলেছেন, মুনাফার টাকা যদি বাংলাদেশ ডাক বিভাগ পেতে পারে তাহলে বোনাস শেয়ারও তো তাদের পাওয়ার কথা? এই সকল প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী তারা কি সেটা পেয়েছে?
তিনি বলেন, নগদের মালিকানার ৫১% যদি বাংলাদশ ডাক বিভাগের হয়ে থাকে তাহলে ইস্যুকৃত ৬ কোটি ৭১ লক্ষ বোনাস শেয়ারের মধ্যে ডাক বিভাগ কেন কোন বোনাস শেয়ারই পেলো না? আর নগদই বা কিসের ভিত্তিতে এই বিপুল পরিমান বোনাস শেয়ার ইস্যু করলো? আর শেয়ার হোল্ডারদের মধ্যে বাংলাদেশ ডাক বিভাগের নাম কোথায়?
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/০০১৭
আপনার মতামত জানানঃ