দক্ষিণ এশিয়ার ঘনবসতিপূর্ণ দেশ ভারতের অযোধ্যার রামমন্দির নিয়ে ভারতের সুপ্রিম কোর্টের রায়ের পর থেকেই দেশটির বিভিন্ন প্রান্তে হিন্দুত্ববাদীরা যেন অতিউৎসাহী হয়ে উঠেছেন। জ্ঞানবাপী মসজিদ, কুতুব মিনার, তাজমহলের মতো ইসলামিক স্থাপনা হিন্দু নিদর্শন বলে দাবি করা হচ্ছে। এবার খাজা মইনুদ্দিন চিশতীর দরগাও সেই তালিকায় যোগ হলো।
উত্তরপ্রদেশ রাজ্যের জ্ঞানবাপী মসজিদ, রাজধানী নয়াদিল্লির কুতুব মিনার, আগ্রার তাজমহলের পর এবার আজমীরের বিখ্যাত খাজা মঈনুদ্দিন চিশতীর দরগা! যা কি-না মুসলিমদের কাছে পবিত্রতম একটি স্থান। এবার সেটিকেও একসময়কার হিন্দু মন্দির বলে দাবি করছে রাজস্থানের এক হিন্দু সংগঠন।
এমনকি ওই সংগঠনটি খাজা মঈনুদ্দিন চিশতীর দরগায় খননকার্য চালানোর জোড় দাবিও জানিয়েছে।
শুক্রবার (২৭ মে) প্রতিবেদন প্রকাশের মাধ্যমে ভারতীয় সংবাদমাধ্যম রিপাবলিক ওয়ার্ল্ড এবং ওয়ান ইন্ডিয়া তথ্যটি নিশ্চিত করেছেন।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, আজমীরের বিখ্যাত খাজা মঈনুদ্দিন চিশতীর দরগাকে হিন্দু শিব মন্দির বলে দাবি করা রাজস্থানের ওই সংগঠনের নাম মহারানা প্রতাপ সেনা।
হিন্দুত্ববাদী এই সংগঠনের দাবি, মঈনুদ্দিন চিশতীর দরগার দেওয়ালে তারা বিভিন্ন হিন্দু সংস্কৃতির প্রতীক দেখতে পেয়েছেন। এমনকি দরগার দেওয়াল ও জানালায় নাকি স্বস্তিক চিহ্নও দেখা গেছে।
মহারানা প্রতাপ সেনা নামের ওই সংগঠনটির নেতা রাজ্যবর্ধন সিং পারমারের দাবি, ‘খাজা মঈনুদ্দিন চিশতীর দরগা আসলে প্রাচীন মন্দির। দেওয়াল ও জানালায় স্বস্তিক-সহ হিন্দু ধর্মের বহু প্রতীক আমরা দেখেছি। আমরা চাই পুরাতত্ত্ব বিভাগ ওই দরগায় গিয়ে সার্ভে করুক।’
যদিও খাজা মঈনুদ্দিন চিশতী দরগা কর্তৃপক্ষ এই দাবি প্রত্যাখ্যান করেছে। তারা পরিষ্কার করেই জানিয়েছে যে, খাজার দরগার কোথাও কোনো স্বস্তিক চিহ্ন নেই। সুফি সাধক মঈনুদ্দিন চিশতীর এই দরগা আজমীরে প্রায় ৮৫০ বছর ধরে স্বমহিমায় বিরাজ করছে। শুধু মুসলিমরাই নন, দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে হিন্দুরাও এসে এই দরগায় প্রার্থনা করেন। সাম্প্রদায়িক উসকানি দেওয়ার উদ্দেশেই এই ধরনের বিভ্রান্তি ছড়ানো হচ্ছে।
অন্যদিকে দরগার খাদিমদের সংগঠন আঞ্জুমান সাইয়্যাদ জাদগানের প্রধান মঈন চিশতী জানিয়েছেন, দরগায় কোথাও কোনো স্বস্তিক চিহ্ন নেই, এটি আমরা দায়িত্ব নিয়ে বলতে পারি। সাড়ে আটশো বছর এই দরগা এখানে দাঁড়িয়ে আছে। আজ পর্যন্ত এই ধরনের কোনো প্রশ্ন কেউ তোলেনি। আজ ভারতে এমন এক পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে, যা আগে কোনোদিন দেখা যায়নি।
শুধু মুসলিমরাই নন, দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে হিন্দুরাও এসে এই দরগায় প্রার্থনা করেন। সাম্প্রদায়িক উসকানি দেওয়ার উদ্দেশেই এই ধরনের বিভ্রান্তি ছড়ানো হচ্ছে।
তিনি বলেন, খাজা মঈনুদ্দিন চিশতীর দরগায় প্রার্থনা করা কোটি কোটি মানুষের ধর্মীয় তাৎপর্য নিয়ে প্রশ্ন উঠলে তাদের অনুভূতিতে আঘাত লাগে। সরকারকে এই ধরনের বিষয়ে প্রতিক্রিয়া জানানোরও আহ্বান জানান মঈন চিশতী। এছাড়া খাজা মঈনুদ্দিন চিশতীর দরগাকে হিন্দু মন্দির হিসেবে দাবি করাকে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি নষ্ট করার চেষ্টা বলে অভিহিত করেছেন দরগার সচিব ওয়াহিদ হোসাইন চিশতী।
ভারতের বিভিন্ন প্রান্তে বিগত কয়েক মাস ধরেই বিভিন্ন স্থাপত্য নিয়ে বিতর্ক তৈরি হয়েছে। তা সে মথুরার ইদগাহ মসজিদ হোক কি বারাণসীর জ্ঞানবাপী মসজিদ। সেই তালিকায় রয়েছে আগ্রার তাজমহল ও দিল্লির কুতুবমিনারও। এই আবহে জ্ঞানবাপীর সমীক্ষা নিয়ে তুমুল বিতর্ক হয়েছে দেশ জুড়ে। মথুরার ইদগাহ মসজিদ ও তাজমহলেরও সমীক্ষার দাবি উঠেছিল। একই দাবি ওঠে কুতুবমুনার ও কর্ণাটকের মঙ্গালুরুর একটি জুমা মসজিদকে ঘিরে।
ভারতে দেশটির বর্তমান প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর আমলে বেশ কিছু ঐতিহাসিক স্থান ও স্থাপত্যের নাম পরিবর্তন ও বিতর্ক সৃষ্টি হয়েছে। যেমন মোগলসরাই রেলওয়ে স্টেশনের নাম পরিবর্তন করে করা হয়েছে পণ্ডিত দিনদয়াল উপাধ্যায় স্টেশন। বাবরি মসজিদের জায়গায় তৈরি হচ্ছে রামমন্দির। জ্ঞানবাপী মসজিদের শিবলিঙ্গ রয়েছে বলে দাবি করে মামলা চলছে।
বিশ্লেষকরা বলেন, বলতে দ্বিধা নেই, তাদের ইতিহাসের যথেষ্ট জ্ঞান নেই। তা নিয়ে তারা যে আজগুবি কথা বলছেন, তার পিছনে আবার একটি মস্ত চক্রান্ত রয়েছে। গৈরিক ঐতিহাসিকরা ভারতীয় ইতিহাস চর্চায় নতুন ব্যাখ্যার আমদানির চেষ্টা চালাচ্ছেন। তথ্যের উপর দাঁড়িয়ে সেই বিতর্ক হলে তর্ক করতে অসুবিধা নেই। কোনও কোনও ক্ষেত্রে তা হচ্ছেও। কিন্তু তারা যে ইতিহাস বলছেন, তা বিতর্কেরও অযোগ্য।
তারা বলেন, তারা আসলে ঐতিহাসিক তথ্যকে বিকৃত করে রাজনীতি করার চেষ্টা করছেন। তাদের রাজনীতিটা হচ্ছে হিন্দুত্বের রাজনীতি। তাই অতীতের অ-হিন্দু শাসন তাদের কাছে দাসত্ব ছাড়া আর কিছু নয়। সে জন্যই ইতিহাস বদলে দেয়ার চেষ্টা। এটা কট্টর মানসিকতাকে তুষ্ট করবে, প্রশাসনিক ব্যর্থতা থেকে নজর অন্যদিকে ঘোরাবে। হয়তো বা ভোট পেতেও ঢালাও সাহায্য করবে। তবে বলে রাখা ভালো, এক বা একাধিক ব্যক্তি শত চেষ্টা করলেও ইতিহাস বদলাবে না। ঐতিহাসিক দলিল আগুন দিয়েও পুড়িয়ে ফেলা যায়, কিন্তু সত্যকে আড়াল করা যায় না।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৭৩৬
আপনার মতামত জানানঃ