ভারতের বিভিন্ন প্রান্তে বিগত কয়েক মাস ধরেই বিভিন্ন স্থাপত্য নিয়ে বিতর্ক তৈরি হয়েছে। তা সে মথুরার ইদগাহ মসজিদ হোক কি বারাণসীর জ্ঞানবাপী মসজিদ। সেই তালিকায় রয়েছে আগ্রার তাজমহল ও দিল্লির কুতুবমিনারও। এই আবহে জ্ঞানবাপীর সমীক্ষা নিয়ে তুমুল বিতর্ক হয়েছে দেশ জুড়ে। মথুরার ইদগাহ মসজিদ ও তাজমহলেরও সমীক্ষার দাবি উঠেছিল। একই দাবি ওঠে কুতুবমুনারকে ঘিরে।
এবার কর্ণাটকের মঙ্গালুরুর একটি জুমা মসজিদকে ঘিরে বিতর্ক সৃষ্টি হয়েছে। ওই রাজ্যের একটি হিন্দু সংগঠন দাবি করেছে, মঙ্গালুরুর মালালি জুমা মসজিদের নিচে মন্দিরের অস্তিত্ব রয়েছে। এজন্য মসজিদের কাছে একটি ধর্মীয় অনুষ্ঠান করার পরিকল্পনা করেছে ওই সংগঠনটি।
বিষয়টি নিয়ে কয়েকদিন ধরে ওই এলাকায় উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ে। যার কারণে ওই মসজিদের চারপাশের ৫০০ মিটার এলাকায় ১৪৪ ধারা জারি করেছে স্থানীয় প্রশাসন। সেই সঙ্গে মোতায়েন করা হয়েছে বিপুল সংখ্যক পুলিশ।
কীভাবে এরকম একটি বিষয় প্রকাশ্যে এল? হিন্দু সংগঠন বলছে, মালালি জুমা মসজিদ মেরামত করার সময় তার ভিত থেকে মন্দিরের মতো একটি কাঠামো বেরিয়ে এসেছে। এ নিয়ে বিশ্ব হিন্দু পরিষদ জেলা প্রশাসনের কাছে দাবি জানিয়েছে, যতদিন পর্যন্ত বিষয়টি নিষ্পত্তি হয় ততদিন মসজিদ মেরামত কাজ বন্ধ রাখা হোক। এ নিয়ে রাম মন্দির আন্দোলনের মতো একটি আন্দোলন গড়ে তোলার হুঁশিয়ারি দিয়েছে ভিএইচপি।
ভিএইইচপির দাবি, এলাকার হিন্দুরা বিশ্বাস করে সেখানে নিঃসন্দেহে একটি মন্দির ছিল। ওই মন্দির উদ্ধারে আইনি লড়াই চলবে। পাশাপাশি মসজিদের কাছে একটি ধর্মীয় অনুষ্ঠানও করা হবে।
এদিকে ভারতের অন্ধ্র প্রদেশে অবস্থিত পাকিস্তানের জাতির জনক মোহাম্মদ আলী জিন্নাহের নামে থাকা একটি টাওয়ারের নাম পরিবর্তনের দাবি উঠেছে। রাজ্যের গুন্টুর শহরের মহাত্মা গান্ধী রোডে শান্তি ও সম্প্রীতির প্রতীক হিসেবে প্রতিষ্ঠিত জিন্নাহ টাওয়ারের নাম পরিবর্তনের দাবি করেছে বিজেপি ও অন্যান্য হিন্দুসংগঠনের নেতারা। মঙ্গলবার তারা এই দাবি করেন।
এলাকার হিন্দুরা বিশ্বাস করে সেখানে নিঃসন্দেহে একটি মন্দির ছিল। ওই মন্দির উদ্ধারে আইনি লড়াই চলবে। পাশাপাশি মসজিদের কাছে একটি ধর্মীয় অনুষ্ঠানও করা হবে।
তাদের দাবি, এটি কি পাকিস্তান নাকি ভারত? যদি ভারত হয় তবে পাকিস্তানের জাতির জনক জিন্নাহর নামের পরিবর্তে ভারতের সাবেক রাষ্ট্রপতি এপিজে আবদুল কালামের নামে নতুন করে নামকরণ করতে হবে।
তবে রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী ওয়াইএস জগন মোহন এই দাবি উড়িয়ে দিয়ে বলেছেন, ‘ঐতিহাসিক স্থাপত্যের নাম পরিবর্তন অপ্রয়োজনীয়।’ তবে মুখ্যমন্ত্রীর এমন অবস্থানের প্রতিবাদে বিক্ষোভ শুরু করে বিজেপি। বিক্ষোভ মিছিল জিন্নাহ টাওয়ারের দিকে যাওয়ার চেষ্টা করলে স্থানীয় পুলিশ তাদের বাধা দেয়। এরই মধ্যে, পুলিশ আন্দোলনকারীদের মধ্য থেকে বিজেপির সর্বভারতীয় সম্পাদক সুনীল দেওধরসহ আরও অনেককেই গ্রেপ্তার করেছেন।
ভারতে দেশটির বর্তমান প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর আমলে বেশ কিছু ঐতিহাসিক স্থান ও স্থাপত্যের নাম পরিবর্তন ও বিতর্ক সৃষ্টি হয়েছে। যেমন মোগলসরাই রেলওয়ে স্টেশনের নাম পরিবর্তন করে করা হয়েছে পণ্ডিত দিনদয়াল উপাধ্যায় স্টেশন। বাবরি মসজিদের জায়গায় তৈরি হচ্ছে রামমন্দির। জ্ঞানবাপী মসজিদের শিবলিঙ্গ রয়েছে বলে দাবি করে মামলা চলছে।
এদিকে, সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি নষ্টের অভিযোগে আটক উত্তর প্রদেশের হপুরের নবাবকে অভিনব শর্তে জামিন দিয়েছেন এলাহাবাদ হাইকোর্ট। তার নির্দেশ, সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির স্বার্থে এক সপ্তাহ ধরে হপুরের নবাবকে জনসাধারণের মধ্যে পানি ও শরবত বিলি করতে হবে। তবে জামিন পেলেও মামলাকে প্রভাবিত করতে পারে এমন কাজ করা চলবে না।
বিশ্লেষকরা বলেন, বলতে দ্বিধা নেই, তাদের ইতিহাসের যথেষ্ট জ্ঞান নেই। তা নিয়ে তারা যে আজগুবি কথা বলছেন, তার পিছনে আবার একটি মস্ত চক্রান্ত রয়েছে। গৈরিক ঐতিহাসিকরা ভারতীয় ইতিহাস চর্চায় নতুন ব্যাখ্যার আমদানির চেষ্টা চালাচ্ছেন। তথ্যের উপর দাঁড়িয়ে সেই বিতর্ক হলে তর্ক করতে অসুবিধা নেই। কোনও কোনও ক্ষেত্রে তা হচ্ছেও। কিন্তু তারা যে ইতিহাস বলছেন, তা বিতর্কেরও অযোগ্য।
তারা বলেন, তারা আসলে ঐতিহাসিক তথ্যকে বিকৃত করে রাজনীতি করার চেষ্টা করছেন। তাদের রাজনীতিটা হচ্ছে হিন্দুত্বের রাজনীতি। তাই অতীতের অ-হিন্দু শাসন তাদের কাছে দাসত্ব ছাড়া আর কিছু নয়। সে জন্যই ইতিহাস বদলে দেয়ার চেষ্টা। এটা কট্টর মানসিকতাকে তুষ্ট করবে, প্রশাসনিক ব্যর্থতা থেকে নজর অন্যদিকে ঘোরাবে। হয়তো বা ভোট পেতেও ঢালাও সাহায্য করবে। তবে বলে রাখা ভালো, এক বা একাধিক ব্যক্তি শত চেষ্টা করলেও ইতিহাস বদলাবে না। ঐতিহাসিক দলিল আগুন দিয়েও পুড়িয়ে ফেলা যায়, কিন্তু সত্যকে আড়াল করা যায় না।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৩৪৫
আপনার মতামত জানানঃ