রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন শুরু করতে রাজি হয়েছে মিয়ানামর সরকার। এমনটাই জানিয়েছে জাতিসংঘের শরণার্থী বিষয়ক সংস্থার (ইউএনএইচসিআর) হাইকমিশনার ফিলিপো গ্র্যান্দি।
এর আগে মিয়ানমারে রাষ্ট্রীয় সহিংসতার শিকার হয়ে বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়া রোহিঙ্গারা নিরাপদ প্রত্যাবাসনের অনিশ্চয়তায় নানা অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে জড়িত হচ্ছে বলে মন্তব্য করেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
ইউএনএইচসিআর-এর হাইকমিশনার মঙ্গলবার সকালে গণভবনে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাতে আসেন। সেখানে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনসহ বিভিন্ন বিষয় নিয়ে আলোচনা করেন তারা। বৈঠক শেষে প্রধানমন্ত্রীর প্রেস সচিব ইহসানুল করিম এ তথ্য জানিয়েছেন।
শেখ হাসিনা বলেন, ‘রোহিঙ্গারা তাদের প্রত্যাবাসন নিয়ে দীর্ঘ অনিশ্চয়তার কারণে হতাশ হয়ে পড়ছে, যার একটি সম্ভাব্য ঝুঁকি রয়েছে। কারণ, এটি তাদের অনেককে অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে জড়িত হতে প্ররোচিত করছে।’
প্রধানমন্ত্রীর আশঙ্কার সঙ্গে একমত পোষণ করেছেন ফিলিপো গ্র্যান্দি। তিনি বলেন, রোহিঙ্গাদের দীর্ঘ অবস্থান তাদের অনেককে অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে জড়িত হতে প্ররোচিত করবে।
মিয়ানমার সফরের কথা উল্লেখ করে হাইকমিশনার জানান, রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসন শুরু করতে মিয়ানমার সরকারকে অনুরোধ করেছেন তিনি।
ফিলিপো গ্র্যান্দি বলেন, ‘মিয়ানমারের বর্তমান সরকার প্রত্যাবাসন শুরু করতে সম্মত হয়েছে। ইউএনএইচসিআর প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়ায় সহায়তা করবে।’
মিয়ানমারের পাঠ্যক্রম ও ভাষার পাশাপাশি দক্ষতা উন্নয়নে সরকার রোহিঙ্গাদের অনানুষ্ঠানিক শিক্ষার সুবিধা দিচ্ছে বলেও হাইকমিশনারকে জানান প্রধানমন্ত্রী।
তিনি বলেন, ‘১১ লাখের বেশি জোরপূর্বক বাস্তুচ্যুত মিয়ানমারের নাগরিক বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়ার কারণে গভীর বনভূমি ও কক্সবাজারের উখিয়ার পরিবেশ নষ্ট হয়েছে।’
রোহিঙ্গারা গাছ কাটার মাধ্যমে বনভূমি হ্রাস এবং এলাকার পরিবেশগত বিপর্যয় সৃষ্টি করছে বলেও মন্তব্য করেন সরকারপ্রধান।
প্রতি বছর ৪৫ হাজার রোহিঙ্গা শিশুর জন্ম হচ্ছে জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, সরকার সব ধরনের সুযোগ-সুবিধাসহ ভাসান চরেন রোহিঙ্গাদের জন্য অস্থায়ী আশ্রয়ের ব্যবস্থা করেছে। এ পর্যন্ত ৩০ হাজার রোহিঙ্গাকে সেখানে স্থানান্তর করা হয়েছে বলেও জানান তিনি।
বিশ্ব জুড়ে উদ্বাস্তু, রাষ্ট্রহীন ও বাস্তুচ্যুত মানুষের সহায়তায় ইউএনএইচসিআরের ভূমিকার প্রশংসা করেন প্রধানমন্ত্রী।
অ্যাম্বাসেডর-অ্যাট-লার্জ এম জিয়াউদ্দিন, প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের সিনিয়র সচিব তোফাজ্জেল হোসেন মিয়া এবং ইউএনএইচসিআর বাংলাদেশের প্রতিনিধি জোহানেস ভ্যান ডার ক্লাউ এ সময় উপস্থিত ছিলেন।
ফিলিপ্পো গ্র্যান্দি বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন এবং বিপুল সংখ্যক জোরপূর্বক বাস্তুচ্যুত রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দেয়ায় সরকারের প্রশংসা করেন।
এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, রোহিঙ্গা ছাড়াও রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ এবং আফগানিস্তান ইস্যু বিশ্বব্যাপী শরণার্থীর সংখ্যা বৃদ্ধি করেছে।
উল্লেখ্য, এর আগে গত মার্চ মাসে গণমাধ্যমে প্রকাশিত এক প্রতিবেদন অনুসারে চীনের মধ্যস্থতায় কক্সবাজারে আশ্রিত রোহিঙ্গাদের ফেরত নিতে রাজি হয়েছিল মিয়ানমার সরকার। এ লক্ষ্যে রোহিঙ্গাদের ফেরত নিতে মিয়ানমার নিজেদের আগ্রহের কথা জানিয়ে বাংলাদেশকে চিঠিও দিয়েছিল।
ওই সময় নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক উখিয়া টেকনাফে ৩৪টি ক্যাম্পে আশ্রিত সাধারণ রোহিঙ্গারা নিজ দেশে ফিরে যেতে রাজি বলে মত প্রকাশ করেছেন। তবে প্রত্যাবাসন শব্দ মুখে নিলেই ক্যাম্পে তাদের ওপর বিপদ ঘটায় সন্ত্রাসীরা। হয়তো অপহরণ নতুবা খুন করে লাশ গুম করে ফেলে আরসা ক্যাডাররা।
ক্যাম্পে আশ্রিত একাধিক রোহিঙ্গা নেতা বলেন, যেভাবে ভাসানচরে নেয়া হচ্ছে-ঠিক তদ্রুপ প্রত্যাবাসনে রাজি রোহিঙ্গাদের প্রশাসনের তত্ত্বাবধানে নিয়ে যেতে হবে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর নিয়ন্ত্রণে থাকা অবস্থায় ওই রোহিঙ্গাদের ফেরত পাঠাতে হবে মিয়ানমারে। নিজ দেশে ফেরত যাচ্ছে খবর পাবার সঙ্গে সঙ্গে ওই রোহিঙ্গাদের ওপর চড়াও হবে আরসা ক্যাডাররা। উল্লেখ্য, মিয়ানমারের মংডু, রাচিদং, বুচিদং ও আকিয়াবে এখনও বসবাসরত অবস্থায় রয়েছে প্রায় ছয় লাখ রোহিঙ্গা।
বলা বাহুল্য, রাখাইনে সেনা অভিযানে ঠিকতে না পেরে ২০১৭সালের ২৫ আগস্টের পরবর্তী ২ মাসে বাংলাদেশে চলে আসে সাড়ে ৭ লাখের বেশি রোহিঙ্গা। আন্তর্জাতিক চাপের মধ্যে মিয়ানমার সরকার রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নিতে বাংলাদেশের সঙ্গে চুক্তি করলেও সেই প্রত্যাবাসন শুরু হয়নি এ পর্যন্ত।
প্রত্যাবাসন নিয়ে সন্দেহ আছে অনেকের মধ্যেই। অনেকেই ভাবছেন প্রত্যাবাসন আদৌ সম্ভব নয়। চার বছর আগে মিয়ানমার ও বাংলাদেশ রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন শুরুর জন্য মাঠপর্যায়ের চুক্তি সই করেছিল। মিয়ানমারের রাজধানী নেপিডোতে করা ওই চুক্তিতে বলা হয়েছিল, প্রত্যাবাসন শুরু করে ‘সম্ভব হলে তা দুই বছরের মধ্যে’ শেষ করা হবে।
কিন্তু রাখাইনে ফেরার মতো পরিবেশ তৈরি না হওয়ায় দুই দফা তারিখ চূড়ান্ত করেও রোহিঙ্গাদের সেখানে পাঠানোর চেষ্টা বিফলে গেছে। এই পরিস্থিতিতে রোহিঙ্গাদের আদৌ ফেরত পাঠানো যাবে কি না, সেটাই এখন বড় প্রশ্ন হয়ে দেখা দিয়েছে। এদিকে, রোহিঙ্গা আশ্রয়শিবিরে আইনশৃঙ্খলা ও নিরাপত্তার বিষয়টি বেশ কিছুদিন ধরে উদ্বেগের সৃষ্টি করেছে।
এদিকে তথ্য উপাত্ত বলছে বাংলাদেশে রোহিঙ্গা শরণার্থীদের প্রতি আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের আগ্রহ দিন দিন কমে আসছে৷
বাংলাদেশে রোহিঙ্গা শরণার্থীদের সার্বিক বিষয় দেখাশোনা করে শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশন৷ জাতিসংঘের ইউএনএইচসিআর এর সঙ্গে যুক্ত রয়েছে৷ ২০২১ সালে জয়েন্ট রেসপন্স প্লান-এর যে হিসাব তাতে দেখা যায় ১০ লাখ ৩৬ হাজার রোহিঙ্গা শরণার্থীর জন্য মোট ডোনারদের সহায়তা প্রয়োজন ছিলো ৯৪৩ মিলিয়ন মার্কিন ডলার৷ দিয়েছে ৬৭৪ মিলিয়ন ডলার যা প্রয়োজনের তুলনায় ২৮ ভাগ কম৷ ২৬৯ মিলিয়ন ডলার সহায়তা পাওয়া যায়নি৷
এর আগেও কোনো বছরই প্রত্যাশিত সহায়তা পাওয়া যায়নি৷ ২০১৭ সালে প্রয়োজন ছিলো ৪৩৪ মিলিয়ন ডলার, পাওয়া গেছে ৩১৭ মিলিয়ন ডলার৷ ২০১৮ সালে ৯৫১ মিলিয়ন ডলারের মধ্যে পাওয়া গেছে ৬৫৫ মিলিয়ন ডলার৷ ২০১৯ সালে ৯২০ মিলিয়ন ডলারের মধ্যে পাওয়া গেছে ৬৯৯ মিলিয়ন ডলার৷ ২০২০ সালে ১০৫৮ মিলিয়ন ডলারের মধ্যে পাওয়া গেছে ৬২৯ মিলিয়ন ডলার৷
এসডব্লিউ/এসএস/২০২৫
আপনার মতামত জানানঃ