আজ একপথে বইছে তো কাল অন্য পথে বয়ে চলা পদ্মা যেন বহুরূপী। এ জন্য পদ্মা নদীতে সেতু নির্মাণ ছিল খুবই চ্যালেঞ্জিং একটি কাজ। নকশায় সময় লেগেছে বেশ। পরে বেশ কিছু পরিবর্তনও আনতে হয়েছে। নিয়মিত নদীভাঙন, নাব্যসংকট গতিপথ পরিবর্তনের কারণে কাজ বন্ধ রাখতে হয়েছে মাসের পর মাস। তবে প্রমত্তা পদ্মাকে শাসন করার চেয়েও কঠিন কাজ ছিল অর্থায়নের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করা। সম্পূর্ণ নিজেদের অর্থায়নে তৈরি হচ্ছে পদ্মা সেতু। বিশ্বব্যাংককে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে এত বড় একটি প্রকল্প নিজেদের অর্থায়নে করা বাংলাদেশের জন্য অভূতপূর্ব এক বিষয়।
সব চ্যালেঞ্জ পেরিয়েই আজ মাথা তুলে দাঁড়িয়েছে স্বপ্নের পদ্মা সেতু। আর এর পেছনে সবচেয়ে বড় অবদান চীনা নির্মাতা প্রতিষ্ঠান চায়না মেজর ব্রিজের। প্রতিষ্ঠানটির একঝাঁক দক্ষ প্রকৌশলী বাংলাদেশের প্রকৌশলীদের সঙ্গে মিলেমিশে কাজ করেছেন। বোমা হামলা, করোনা, সন্ত্রাস, নানা বিপদ সত্ত্বেও চীনারা প্রকল্প ছেড়ে যাননি। পদ্মার বুকে এই মহাচ্যালেঞ্জ জয়ে বাংলাদেশের গৌরবের অংশীদার তাই গণচীনও। এ জন্যই তো শেষ স্প্যানের গায়ে দুই দেশের পতাকা এঁকে তার সঙ্গে লেখা ছিল দুই দেশের অটুট বন্ধুত্বের বাণী।
প্রকল্প সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, পদ্মা সেতুর কার্যক্রম শুরু হওয়ার পর থেকে এক মুহূর্তের জন্যও থেমে থাকেনি এর নির্মাণকাজ। প্রাকৃতিক সমস্যার কারণে এক কাজ বন্ধ তো অন্য কাজ চলমান ছিল। এমনকি মহামারী করোনাকালেও জীবনের ঝুঁকি নিয়ে সেখানে কাজ করেছেন চীনা নাগরিকরা। ২০১৬ সালের ১ জুলাই রাজধানীর হলি আর্টিজানে সন্ত্রাসী হামলার পর অনেক বিদেশি নিজেদের গুটিয়ে নিলেও চীনারা পদ্মার কাজ থেকে নিজেদের গুটিয়ে নেয়নি। চীনে বন্যা ও করোনার মধ্যেও সেখানে নির্মিত হয়েছে ব্রিজের বিভিন্ন সামগ্রী। যেকোনো পরিস্থিতি সামলে এগিয়ে নিয়েছেন প্রকল্পকে। এ ছাড়া চীনের বিভিন্ন নির্মাণসামগ্রী ও যন্ত্রপাতিও ছিল অত্যাধুনিক।
পদ্মার এপার-ওপার জোড়া লাগাল তিয়ান-ই : ৩ হাজার ৬০০ টন ধারণক্ষমতার বিশ্বের সবচেয়ে বড় ভাসমান ক্রেনের নাম হচ্ছে তিয়ান-ই। আর এই ক্রেনের ওপর বহন হতো স্বপ্নের পদ্মা সেতুর স্প্যান। ২০১৭ সালের ৩০ সেপ্টেম্বর সেতুর ৩৭ ও ৩৮ নম্বর পিলারের ওপর প্রথম স্প্যান বসানো হয়। আর ওই স্প্যানটি কনস্ট্রাকশন ইয়ার্ড থেকে বহন করে নির্ধারিত পিলারের কাছে নিয়ে যায় তিয়ান-ই। এরপর একের পর এক স্প্যান বহন করে পিলারের কাছে পৌঁছে দেয় এ ভাসমান ক্রেন। আবার এই ক্রেনের মাধ্যমে পিলারের ওপর বসানো হয়েছে একের পর এক স্প্যান।
১০ ডিসেম্বর ২০২০, বৃহস্পতিবার ১২ ও ১৩ নম্বর পিলারের ওপর সেতুর সর্বশেষ স্প্যান বসানো হয়েছে। আগের দিন বুধবার দুপুরে মুন্সীগঞ্জের লৌহজং উপজেলার কুমারভোগ কনস্ট্রাকশন ইয়ার্ড থেকে ‘টু-এফ’ নামে সেতুর শেষ স্প্যানটি নিয়ে রওনা হয় ভাসমান ক্রেনটি। ওই দিন বিকেল নাগাদ নির্ধারিত পিলারে পৌঁছায়। গতকাল শেষ স্প্যান বসানোর মধ্য দিয়ে পদ্মা সেতুর এপার-ওপার জোড়া লাগানোর কাজ শেষ করেছে তিয়ান-ই।
পদ্মা সেতুর উপসহকারী প্রকৌশলী হুমায়ুন কবীর স্থানীয় সাংবাদিকদের জানিয়েছেন, প্রায় কুড়ি বছর আগে বিশ্বের সবচেয়ে বড় এ ভাসমান ক্রেন নির্মিত হয়। পদ্মা সেতু নির্মাণের ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান চীন থেকে ভাড়া আনেন এ ক্রেন। ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানকে প্রতি মাসে তিয়ান-ইর ভাড়াসহ ব্যবস্থাপনা খরচ গুনতে হয় ৩০ লাখ টাকা। চীন থেকে পদ্মায় তিয়ান-ই আসতে সময় নিয়েছিল প্রায় দেড় মাস। গতকাল শেষ স্প্যান বসানোর পর আর পদ্মায় থাকছে না কম্পিউটার অপারেটেড ভাসমান এ ক্রেন।
পদ্মার শেষ স্প্যানে চীন ও বাংলাদেশের পতাকা : ‘বহু বছরের প্রচেষ্টায় দেশি-বিদেশি শ্রমশক্তির মাধ্যমে স্বপ্নের পদ্ম সেতু আজ বাস্তবায়নের পথে। ইস্পাতে তৈরি সেতুর ৪১টি স্প্যান সোনার বাংলার উত্তর ও দক্ষিণাঞ্চলকে সংযুক্তির মাধ্যমে চীন ও বাংলাদেশের বন্ধুত্বের বন্ধন অটুট রাখবে।’ পদ্মা সেতুর সর্বশেষ তথা ৪১তম স্প্যানের গায়ে ব্যানারে এ কথাগুলো ঠাঁই পেয়েছে। একই সঙ্গে শেষ স্প্যানে ঠাঁই পেয়েছে চীন ও বাংলাদেশের পতাকা। ব্যানারের বাম পাশে চীন ও ডান পাশে দেখা গেছে বাংলাদেশের পতাকা।
টুকরো টুকরো স্টিল জোড়া দিয়ে তৈরি হয় স্প্যান : টুকরো টুকরো স্টিল জোড়া দিয়ে তৈরি হয়েছে স্বপ্নের পদ্মা সেতুর একেকটি স্প্যান। ১৫০ মিটার দৈর্ঘ্যরে স্প্যানের কোনোটিতে ১০৮ টুকরো স্টিল আবারও কোনোটিতে ১১৫টি স্টিলের জোড়া লাগানো হয়েছে। ত্রিভুজ আকৃতির স্টিলের টুকরোর জোড়া লাগানো হয়েছে মুন্সীগঞ্জের লৌহজং উপজেলার পদ্মা সেতু প্রকল্পের কুমারভোগ কনস্ট্রাকশন ইয়ার্ডে। প্রতিটি স্টিলের টুকরো ১৫ থেকে সর্বোচ্চ ৯০ টন ওজনের। আর স্টিলের টুকরোগুলো এসেছে চীন থেকে।
পদ্মা সেতু প্রকল্পে পৌঁছানোর পর কুমারভোগ কনস্ট্রাকশন ইয়ার্ডে স্টিলের টুকরোগুলো জোড়া লাগানোর পর শতভাগ প্রস্তুত করা হতো একেকটি স্প্যান। আর স্প্যানগুলোর ওজন দাঁড়াত ২ হাজার ৮০০ টন। প্রতিটি স্প্যান কনস্ট্রাকশন ইয়ার্ড থেকে বহন করে নির্ধারিত পিলারের কাছে নিয়ে যায় বিশ্বের সবচেয়ে বড় ভাসমান ক্রেন তিয়ান-ই। আর ওই ক্রেনের মাধ্যমেই নির্ধারিত পিলারের ওপর বসানো হয়েছে প্রতিটি স্প্যান।
এসডাব্লিউ/এমএন/আরা/১৭৪০
আপনার মতামত জানানঃ