পাকিস্তানে কর্মরত নিজ দেশের নাগরিকদের সুরক্ষার জন্য সে দেশে সেনা ঘাঁটি তৈরির অনুমতি দিতে ইসলাবাদকে একটানা চাপ দিয়ে চলেছে বেইজিং। এপ্রিল মাসে করাচিতে চীনা নাগরিকদের উপরে সন্ত্রাস হামলার ঘটনার পর থেকে বেজিংয়ের দাবি, তাদের দেশের নাগরিকদের সুরক্ষার জন্য পাকিস্তানে সেনা ছাউনি তৈরি প্রয়োজন।
ইতিমধ্যে বিভিন্ন জায়গাও দেখা শুরু করেছে চীন। পাকিস্তানের যে সব অঞ্চলে আমেরিকার প্রভাব ছিল, বিশেষ করে ঠাণ্ডা যুদ্ধের সময়, সেই জায়গাগুলি তাদের পছন্দের তালিকায় রয়েছে। খবর আনন্দবাজার
চীন-পাকিস্তান অর্থনৈতিক করিডর প্রকল্পে হাজার হাজার চীনা কর্মী পাকিস্তানের করাচি, বালুচিস্তান, গিলগিট-বালটিস্তানে কাজ করছেন। এক মাস আগে ‘বালুচিস্তান লিবারেশন আর্মি’ (বিএলএ)-র এক মহিলা আত্মঘাতী জঙ্গি করাচি বিশ্ববিদ্যালয় চত্বরে একটি ভ্যানে বিস্ফোরণ ঘটায়। এতে ভ্যানের যাত্রী তিন চিনা নাগরিক ও পাকিস্তানি গাড়ি চালকের প্রাণ যায়। এর পর থেকে কাজের সূত্রে পাকিস্তানে থাকা তাদের দেশের বাসিন্দাদের নিরাপত্তা নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করতে শুরু করেছে চীন। তারা অবিলম্বে পাকিস্তানে নিজেদের সেনা ঘাটি তৈরি করতে চায়। সেই মর্মে ক্রমাগত ইসলামাবাদের উপরে চাপ দিয়ে যাচ্ছে তারা।
সূত্রের খবর, সেনা ঘাঁটি তৈরিতে পাক সরকারের ছাড়পত্রের বিনিময়ে চীনও তাদের কিছু সুবিধা পাইয়ে দিতে রাজি। যেমন, যে ঋণের বোঝা রয়েছে পাকিস্তানের কাঁধে, তাতে কিছুটা রেহাই। বেজিংয়ের কাছে ইসলামাবাদের বকেয়া ঋণের বিষয়টি সুবিধাজনক শর্তে দেখা হবে বলে প্রতিশ্রুতি দিয়েছে তারা।
পাকিস্তানের অন্যতম মিত্র রাষ্ট্র চীন। কিন্তু বেলুচিস্তানে বারবার হামলার শিকার হতে হচ্ছে চীনা নাগরিকদের। বিশেষ করে, তাদের নিশানা করছে স্থানীয় সন্ত্রাসবাদী সংগঠন বিএলএ। পাকিস্তানের এই বেলুচিস্তান প্রদেশের সীমান্ত ঘেঁষে রয়েছে আফগানিস্তান ও ইরান। অনুপ্রবেশের ঘটনা এখানে অহরহ ঘটে। অনুপ্রবেশকারীদের সন্ত্রাসে ইন্ধনের ঘটনাও চেনা-পরিচিত। ৬০০০ কোটি ডলারের চীন-পাকিস্তান অর্থনৈতিক করিডর প্রকল্পে তারা ইতিমধ্যেই একাধিক জঙ্গি হামলা চালিয়েছে।
৩ হাজার কিলোমিটার দীর্ঘ চীন-পাকিস্তানের এই অর্থনৈতিক করিডরটি চীনের উইঘুর অঞ্চলের সঙ্গে পশ্চিম পাকিস্তানের বেলুচিস্তান প্রদেশের গোয়াদার বন্দরকে যুক্ত করেছে। এই সড়কের অনেকটাই যাচ্ছে পাক-অধিকৃত কাশ্মীর দিয়ে। তাই দিল্লি বরাবর এই সড়ক পথ তৈরি নিয়ে প্রতিবাদ জানিয়ে এসেছে। যদিও পাক-চীন প্রকল্প অব্যাহত রয়েছে।
পাকিস্তানের যে সব অঞ্চলে আমেরিকার প্রভাব ছিল, বিশেষ করে ঠাণ্ডা যুদ্ধের সময়, সেই জায়গাগুলি তাদের পছন্দের তালিকায় রয়েছে।
পাকিস্তানের পররাষ্ট্রনীতি দীর্ঘদিন ধরেই পশ্চিমানির্ভর ছিল। কিন্তু সাম্প্রতিক বছরগুলোতে চীন তাদের সবচেয়ে শক্তিশালী আন্তর্জাতিক সহযোগী দেশে পরিণত হয়েছে। বিভিন্ন সময়ে ঋণসহায়তা নিয়ে দেশটির পাশে দাঁড়িয়েছে চীন।
২০১৩ সাল থেকে চীনের বড় ধরনের প্রকল্পে অংশগ্রহণ করছে পাকিস্তান। চায়না-পাকিস্তান ইকোনমিক করিডরে (সিপিইসি) পরিবহন, জ্বালানি ও অবকাঠামোগত খাতে শত শত বিলিয়ন ডলার ব্যয় করছে।
আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের প্রতিবেদন অনুযায়ী, চীনের কাছ থেকে নেওয়া ১ হাজার ৮৪০ কোটি ডলার ঋণ পরিশোধ বাকি পাকিস্তানের।
এদিকে পাকিস্তানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী বিলাওয়াল ভুট্টো জারদারি দুই দিনের রাষ্ট্রীয় সফরে চীন যাচ্ছেন। আজ শনিবার চীনের রাজধানী বেইজিং সফর করার কথা রয়েছে বিলাওয়ালের। পাকিস্তানে চলমান অর্থনৈতিক সংকটের মধ্যে নতুন পররাষ্ট্রমন্ত্রী দীর্ঘদিনের অর্থনৈতিক সহযোগী দেশটিতে সফর করছেন। সফরকালে চীনের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ওয়াং ইর সঙ্গে দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্যিক ও অর্থনৈতিক সহায়তা নিয়ে আলোচনা হবে।
গত মাসে ইমরান খানের অপসারণের মধ্য দিয়ে পাকিস্তানের রাজনীতিতে নতুন মোড় নেয়। পাকিস্তান মুসলিম লিগের (পিএমএল–এন) নেতা শাহবাজ শরিফ প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হন। সরকার গঠন করতেই অর্থনৈতিক সংকটের মুখোমুখি হয় শাহবাজ শরিফের নেতৃত্বাধীন জোট।
পাকিস্তান বর্তমানে বৈদেশিক ঋণ নিয়ে দুশ্চিন্তার মধ্যে আছে। বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভও কমে যাচ্ছে। দেখা দিয়েছে মূল্যস্ফীতি। এর ধারাবাহিকতায় ডলারের বিপরীতে দেশটির মুদ্রা রুপির চরম অবনমন হয়েছে। দেশটিতে প্রতি ডলার এখন ২০০ রুপিতে দাঁড়িয়েছে।
গতকাল শুক্রবার পাকিস্তানের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় চীন সফর নিয়ে একটি বিবৃতি প্রকাশ করেছে। এতে বলা হয়েছে, দুই দিনের সফরে বিলাওয়াল চীনের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ওয়াং ইর সঙ্গে বৈঠক করবেন। বৈঠকে দুই দেশের বাণিজ্য ও অর্থনৈতিক সহযোগিতা বৃদ্ধি নিয়ে আলোচনা হবে।
এদিকে চীনের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের একজন মুখপাত্র বলেছেন, বৈঠকে দুই দেশের মধ্যে পারস্পরিক কৌশলগত সহযোগিতার সব বিষয় নিয়ে গভীরভাবে আলোচনা করা হবে।
বেইজিং এবং ইসলামাবাদের মধ্যে কূটনৈতিক সম্পর্ক হয় ১৯৫১ সালে, এবং উভয় দেশের মধ্যে মৈত্রী দৃঢ় হয় কারণ উভয় দেশই স্বীকার করে যে তাদের একটি অভিন্ন প্রতিপক্ষ রয়েছে। তা হচ্ছে ভারত এবং ভারত দক্ষিণ এশিয়ায় তার আধিপত্য বজায় রাখার চেষ্টা করছে।
পাকিস্তান ও চীনের মধ্যে প্রথম বাণিজ্য চুক্তি ১৯৬৩ সালে স্বাক্ষরিত হয় এবং ২০১৩ সালে চীন-পাকিস্তান অর্থনৈতিক করিডোর (সিপিইসি) প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে অর্থনৈতিক সম্পর্ক জোরদার হয়।চীনের অর্থায়নে তৈরি এই প্রকল্পের লক্ষ্যই হচ্ছে পাকিস্তানের অবকাঠামো এবং এর অর্থনীতির উন্নতি সাধন। সিপিইসি চীনের বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভের একটি অংশ।
অর্থনৈতিক সম্পর্ক, বাণিজ্য এবং সিপিইসি এর মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়, কারণ চীন পাকিস্তানের বৃহত্তম ঋণদাতাদের মধ্যে একটি, পাকিস্তানের ঋণের ২৭ শতাংশেরও বেশি রয়েছে চীনের কাছে।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৯৪৮
আপনার মতামত জানানঃ