প্রকৃতি সুন্দর আবার ভয়ংকরও। তার প্রমাণ আমরা প্রাকৃতিক দুর্যোগগুলোতেই পেয়ে থাকি। তবে প্রকৃতি মাঝে মাঝে এমন বিরূপ আচরণ করে যে তার প্রতিফলন দেখলে আঁতকে উঠতে হয়। আর তেমনই একটি বিষয় হচ্ছে সিংকহোল। যাকে অনেকেই প্রকৃতির দানবগর্ত বলে থাকে।
চীনের লেই কাউন্টিতে আবিষ্কৃত হয়েছে ১৯২ মিটার গভীর একটি সিংকহোল। গবেষকরা ধারণা করছেন, এই দানবীয় গর্তের মধ্যে রয়েছে অন্য আরেকটি দুনিয়া। সেখানে থাকতে পারে প্রাগৈতিহাসিক এবং অচেনা অনেক প্রজাতির প্রাণী ও উদ্ভিদ।
দক্ষিণ চীনের গুয়াংশি ঝুয়াং অঞ্চলের কাছেই অবস্থিত এই সিংকহোলটি আবিষ্কার করেছেন অভিযাত্রীরা।
নাইননিউজের খবরে বলা হয়েছে, এই সিংকহোলের আছে নিজস্ব একটি বন। গত ৬ই মে সেই বনে অভিযান চালান চেন লিকশিন নামের এক অভিযাত্রী। এই বিশাল গর্তটি ভেতরে ৩০৬ মিটার লম্বা এবং ১৫০ মিটার প্রস্থের। এর ভেতরে আরও তিনটি গুহা খুঁজে পেয়েছেন চেনের দল। এরমধ্যে আছে অনেক প্রাচীন গাছ যা ৪০ মিটার লম্বা!
চেন এই অভিযান সম্পর্কে বলেন, এই সিংকহোলের মধ্যে যেসব গুহা আছে তার বিষয়ে কেউ জানতো না। কখনো এ নিয়ে রিপোর্ট হয়নি কিংবা গবেষণা হয়নি। এরমধ্যে অচেনা প্রজাতির সন্ধান পেলেও আমি অবাক হব না।
চীনের লেই কাউন্টিতে প্রায়ই নতুন সিংকহোলের সন্ধান পাওয়া যায়
নতুন এই আবিষ্কারের ফলে কাউন্টিতিতে সিংকহোলের সংখ্যা দাঁড়ালো ৩০-এ। চীন, মেক্সিকো এবং পাপুয়া নিউ গিনিতে সবথেকে বেশি সিংকহোল রয়েছে।
এই সিংকহোলের মধ্যে যেসব গুহা আছে তার বিষয়ে কেউ জানতো না। কখনো এ নিয়ে রিপোর্ট হয়নি কিংবা গবেষণা হয়নি। এরমধ্যে অচেনা প্রজাতির সন্ধান পেলেও আমি অবাক হব না।
সিংকহোল মূলত প্রাকৃতিকভাবে সৃষ্টি হওয়া এক ধরনের গর্ত। সিংকহোলকে এক প্রকার দানবীয় গর্তও বলা হয়। সিংকহোল হলো— কোনো একটি স্থানের ভূমি হঠাৎ করে কিংবা ধাপে ধাপে বসে যাওয়া।
যুক্তরাষ্ট্রের ভূতাত্ত্বিক জরিপ সংস্থা ইউএসজিএসের তথ্যমতে, সিংকহোল হলো প্রকৃতিতে হঠাৎ করে সৃষ্টি হওয়া এক ধরনের বিশালাকার গর্ত। ২০১০ সালে গুয়েতেমালা সিটিতে সিংকহোল দেখা যাওয়ার পর এটি আলোচনায় আসে।
ক্ষেত্রবিশেষে সিংকহোলের ব্যাস ও গভীরতা ১-৬০০ মিটার পর্যন্ত হতে পারে। প্রকৃতিতে এমন দানবীয় গর্ত তৈরির ঘটনা নতুন কিছু নয়। বিভিন্ন সময়ে সিংকহোল নামক প্রাকৃতিক দুর্যোগ বিভিন্ন দেশে দেখা দিয়েছে। সিংকহোল আজ থেকে প্রায় শত বছর আগেও ছিল; কিন্তু তখন এটি এতটা ভয়াবহ আকারে ছিল না। সম্প্রতি ঝড়-বৃষ্টি, ভূমিধসের মতো বিভিন্ন দেশে সিংকহোলের পরিমাণ বাড়ছে। সিংকহোল যে কোনো জায়গায় হতে পারে। সেটি সাগরের তলদেশে যেমন হতে পারে; তেমনি রাস্তা, খেলার মাঠ, ফসলি জমি কিংবা জনবসতিপূর্ণ এলাকায়ও হতে পারে।
সিংকহোলের আকার ও গভীরতা একেক জায়গায় একেক রকম হয়ে থাকে। বিশ্বে সবচেয়ে বেশি সিংকহোল তৈরি হয় যুক্তরাষ্ট্রের ফ্লোরিডা অঙ্গরাজ্যে। এর পরপরই রয়েছে তুরস্কের কনিয়া। প্রকৃতিতে সিংকহোল বেড়ে যাওয়ার পেছনে অনেক কারণ রয়েছে। এর মধ্যে বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধি, ভূগর্ভস্থ জল উত্তোলন, তীব্র খরা, মাটির ক্ষয়, জলের স্তর নিচে নেমে যাওয়া, মিথেন গ্যাসের প্রভাব ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য।
যুক্তরাষ্ট্রের ভূতাত্ত্বিক জরিপ সংস্থা ইউএসজিএস বলছে, সিংকহোল প্রকৃতিতে হঠাৎ সৃষ্টি হওয়া বিশালাকার গর্ত। সাধারণত, বৃষ্টি হলে মাটির উপরিতলের পানি মাটির অভ্যন্তরে প্রবেশ করে। এরপর সেখানে একটি স্তরে পানি জমা থাকে। সেই পানি যখন সেচ কাজ বা অন্যকোনো কারণে উত্তোলন করা হয় তখন উপরিভাগে ভূমিধস হয়ে বড় ধরনের গর্ত সৃষ্টি হয়।
সিংকহোল প্রকৃতিতে খুব সাধারণ ঘটনা। একে ভূতত্ত্ববিদরা বলেন, ‘কারস্ট ট্রেইন’।
ইউএসজিএস বলছে, শুধু পানি উত্তোলনের জন্য নয়, যেসব এলাকায় মাটির অভ্যন্তরে কঠিন শিলা রয়েছে সেখানে মাটির উপরিভাগের পানি নিচে প্রবেশ করে। সেখানে থাকে লবণ, চুনাপাথর, কপার ও জিপসামের মতো খনিজের স্তর।
এসব স্তরের খনিজ তোলা হলেও মাটির অভ্যন্তরে ফাঁপা জায়গা তৈরি হতে থাকে। এরপর নির্দিষ্ট সেই এলাকায় মাটি নিচে ধসে গিয়ে তৈরি হয় সিংকহোল।
সিংকহোল একেবারে নাটকীয়ভাবে তৈরি হয়। অনেকেই ভূমিধসকেই সিংকহোল মনে করেন। কিন্তু দুটি সম্পূর্ণ আলাদা।
বিজ্ঞানীরা বলছেন, কয়েক দশক এমনকি শতাব্দী লাগে একটি সিংকহোল তৈরি হতে। ইউএসজিএস বলছে, ভূগর্ভস্থ পানি অথবা খনিজ উত্তোলন করা হলে মাটির অভ্যন্তরে ফাঁপা জায়গা তৈরি হয়। নিচের স্তরের মাটি যখন ভূমির উপরের চাপ নিতে পারে না তখনই ধসে পড়ে আর তৈরি হয় বিশালাকার গর্ত।
প্রকৃতিতে হঠাৎ সিংকহোল তৈরির ঘটনা বেড়ে যাওয়ার কারণ সম্পর্কে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বৈশ্বিক উষ্ণতার কারণে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে প্রকৃতির স্বাভাবিক প্রক্রিয়া। আশঙ্কাজনক হারে তাপমাত্রা বৃদ্ধিতে বেড়েছে খরা। কমেছে পানির স্তর। মাটি ক্ষয়, মিথেন গ্যাসের প্রভাব, অধিক হারে ভূগর্ভস্থ পানি ও খনিজ পদার্থ উত্তোলনও দায়ী। অপরিকল্পিত ভূগর্ভস্থ সুয়ারেজ লাইন বা মাটির নিচে নির্মাণ কাজকেই মনে করা হচ্ছে শহরে সিংকহোল বৃদ্ধির কারণ।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৭০৭
আপনার মতামত জানানঃ