হাজার হাজার কোটি টাকা আত্মসাৎ ও পাচারের মামলার আসামি প্রশান্ত কুমার হালদারকে (যিনি পি.কে. হালদার নামে পরিচিত) ভারতে আটক করা হয়েছে।
বাংলাদেশের দুর্নীতি দমন কমিশন বা দুদক পি কে হালদার এবং তার সহযোগীদের বিরুদ্ধে মোট ৩৪টি মামলা করেছিলো। এসব মামলায় তাদের বিরুদ্ধে কয়েক হাজার কোটি টাকা আত্মসাৎ ও পাচারের অভিযোগ আনা হয়।
ভারতের অর্থ সংক্রান্ত কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা বাহিনী এনফোর্সমেন্ট ডিরেকটরেটের কর্মকর্তারা বিবিসি বাংলার কাছে এখবর নিশ্চিত করেছেন। তারা জানান, পি কে হালদারসহ মোট ৬ জনকে আটক করা হয়েছে। এছাড়া কোলকাতা থেকে একটি কূটনৈতিক সূত্রও আটকের খবর নিশ্চিত করে।
ঢাকার একটি ব্যাংক ও অপর একটি আর্থিক প্রতিষ্ঠানের সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক পি কে হালদারের বিরুদ্ধে প্রায় সাড়ে ছয় হাজার কোটি টাকা অস্বাভাবিক লেনদেনের অভিযোগ ওঠার পর দীর্ঘদিন ধরেই তিনি পলাতক ছিলেন।
চার কেলেঙ্কারির সংক্ষিপ্ত ইতিহাস
পিরোজপুরের নিম্নমধ্যবিত্ত পরিবারের মেধাবী এই ছেলেটি একসময় দেশের চারটি আর্থিক প্রতিষ্ঠানকে পথে বসিয়ে দেন। জন্ম দেন দেশের আর্থিক খাতের সবচেয়ে বড় কেলেঙ্কারির।
সবার কাছে ‘ম্যানেজ মাস্টার’ হিসেবে পরিচিত পি কে হালদার মাত্র ১০ বছরের ব্যাংকিং অভিজ্ঞতা নিয়েই ২০০৯ সালে রিলায়েন্স ফাইন্যান্সের এমডি হয়ে যান। এরপর ২০১৫ সালের জুলাইয়ে এনআরবি গ্লোবাল ব্যাংকের এমডি পদে যোগ দেন।
২০০৯ সাল থেকে ২০১৯ সালের মধ্যে মাত্র ১০ বছরেই ইন্টারন্যাশনাল লিজিং অ্যান্ড ফাইন্যান্সিয়াল সার্ভিসেস, পিপলস লিজিং অ্যান্ড ফাইন্যান্সিয়াল সার্ভিসেস, এফএএস ফাইন্যান্স অ্যান্ড ইনভেস্টমেন্ট লিমিটেড ও বাংলাদেশ ইন্ডাস্ট্রিয়াল ফাইন্যান্স কোম্পানি (বিআইএফসি) থেকে ১১ হাজার কোটি টাকা হাতিয়ে নেন নানা কৌশলে। চারটি প্রতিষ্ঠান দখলে নিলেও কোনো প্রতিষ্ঠানেই পি কে হালদারের নিজের নামে শেয়ার নেই।
এই সময়ে হালদার তার বিশ্বস্ত লোকজন, বন্ধু-বান্ধবকে কৌশলে ওইসব প্রতিষ্ঠানের শীর্ষ পর্যায়ে বসিয়েছেন। বিশ্বস্ত লোকদেরকে প্রতিষ্ঠানগুলোতে নিয়োগ দিয়ে নিজের জালিয়াতির কাজে লাগিয়েছেন। এছাড়া, নিয়ন্ত্রক সংস্থাগুলোর কিছু কর্মকর্তা যারা এসব তদারকিতে ছিলেন তাদেরও তিনি নানাভাবে ম্যানেজ করেছেন।
প্রশান্ত কুমার হালদার প্রতিষ্ঠান দখল ও অর্থ আত্মসাৎ করেছেন নিয়ন্ত্রক সংস্থার চোখের সামনে। এমনকি অনেক ক্ষেত্রে সমর্থনও পেয়েছেন।
সব শেয়ার অন্যদের নামে হলেও ঘুরেফিরে আসল মালিক পি কে হালদারই। নিজেকে আড়ালে রাখতে এমন কৌশল নেন তিনি। নিজের নামের সঙ্গে মিল রেখে পি কে হালদার গড়ে তুলেন একাধিক প্রতিষ্ঠান, যার বেশির ভাগই কাগুজে।
কাগজে-কলমে এসব প্রতিষ্ঠানের মালিকানায় ছিলেন পি কে হালদারের মা লীলাবতী হালদার, ভাই প্রিতিশ কুমার হালদার, প্রিতিশ কুমারের স্ত্রী সুস্মিতা সাহা, খালাতো ভাই অমিতাভ অধিকারী, অভিজিৎ অধিকারীসহ বিভিন্ন আত্মীয়স্বজন। সাবেক সহকর্মী উজ্জ্বল কুমার নন্দীও ছিলেন কয়েকটি প্রতিষ্ঠানের মালিকানায়।
১০ বছরে ১১ হাজার কোটি টাকা আত্মসাৎ
মূলত শেয়ারবাজার থেকে শেয়ার কিনে চারটি প্রতিষ্ঠানের নিয়ন্ত্রণ নেন পি কে হালদার। এভাবে নিয়ন্ত্রণ নেওয়া চারটি প্রতিষ্ঠানের মধ্যে পিপলস লিজিং ও বিএফআইসির ক্ষেত্রে বাংলাদেশ ব্যাংকের একধরনের সহায়তা ছিল।
এই দুই প্রতিষ্ঠানের আগের পরিচালনা পর্ষদের একাধিক সদস্য আইন ভেঙে নামে-বেনামে ঋণ নেওয়ায় তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয় বাংলাদেশ ব্যাংক। আর এই সুযোগে এসব কোম্পানির শেয়ার কিনে প্রতিষ্ঠান দুটির নিয়ন্ত্রণ নেন পি কে হালদার।
ইন্টারন্যাশনাল লিজিং একসময় ভালো চলছিল। ২০১৫ সালে প্রতিষ্ঠানটির নিয়ন্ত্রণ নেওয়ার পরই প্রতিষ্ঠানটি ভেঙে পড়ে। প্রায় ৩০টি প্রতিষ্ঠানের নামে বের করে নেওয়া হয় ২ হাজার ২৯ কোটি টাকা। এই টাকা ব্যয় হয় অন্য প্রতিষ্ঠানগুলোতে শেয়ার কেনার মাধ্যমে নিয়ন্ত্রণে নেওয়ার জন্য ।
একই বছর পিপলস লিজিংয়ের নিয়ন্ত্রণ নেয় হালদারের প্রতিষ্ঠান আনান কেমিক্যাল। এফএএস ক্যাপিটাল ম্যানেজমেন্ট ও রিলায়েন্স ব্রোকারেজের মাধ্যমে এই শেয়ার কেনা হয়।
বিভিন্ন মাধ্যমে টাকা আত্মসাতের পর পিকে হালদার পাচার করেছেন কানাডা ও ভারতে। সেখানে আগেই নিজের ও ভাইয়ের নামে কোম্পানি খুলেছিলেন তিনি।
২০১৮ সালে ভাই প্রিতিশ হালদোর ও নিজের নামে ভারতে হাল ট্রিপ টেকনোলজি নামে কোম্পানি খোলেন হালদার। কলকাতার মহাজাতি সদনে তাদের কার্যালয়।
কানাডায় পিঅ্যান্ডএল হাল হোল্ডিং ইনক নামে কোম্পানি খোলা হয় ২০১৪ সালে, যার পরিচালক পি কে হালদার, প্রিতিশ কুমার হালদার ও তার স্ত্রী সুস্মিতা সাহা।
কানাডা সরকারের ওয়েবসাইটে দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, কানাডার টরন্টোর ডিনক্রেস্ট সড়কের ১৬ নম্বর বাসাটি তাদের।
দীর্ঘদিন ধরে সবার নাগের ডগায় বহাল তবিয়তে থাকলেও পি কে হালদারের নাম সামনে আসে ক্যাসিনোবিরোধী সাম্প্রতিক শুদ্ধি অভিযানের সময়। এ সময় দুদক যে ৪৩ জনের বিরুদ্ধে অনুসন্ধান শুরু করে, তাদের মধ্যে পি কে হালদার একজন।
তার বিরুদ্ধে অনুসন্ধানে নেমে তাকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য হাজির হতে নির্দেশ দিলেও দুদকের নিষেধাজ্ঞার মধ্যেই দেশ থেকে পালিয়ে যান হালদার। দীর্ঘ তিন বছর পর ভারতে গ্রেপ্তার হন শনিবার (১৪ মে)।
অর্থ উদ্ধারের সম্ভাবনা কতটা?
এদিকে পিকে হালদার ভারতে গ্রেফতার হওয়ায় কিছুটা হলেও আশাবাদী কর্তৃপক্ষ। তার কাছ থেকে টাকা এবং সম্পদ উদ্ধার করতে পারলে গ্রাহকের টাকা ফেরত দেওয়া সম্ভব হবে জানান সংশ্লিষ্টরা।
পিপলস লিজিংয়ে দায়িত্বরত এক কর্মকর্তা জানান, পিকে হালদারের কাছ থেকে সম্পদ বা টাকা উদ্ধার করতে পারলেই আমরা গ্রাহকদের ফেরত দিতে পারব। অন্যথায় সম্ভব নয়।
তিনি বলেন, লুট হওয়া অর্থে পিকে হালদার দেশে যে সম্পদ গড়েছেন সেসব বিক্রি করলে হয়তো আমরা ৩শ থেকে ৫০০ কোটি টাকা পাব। কিন্তু সেটি দীর্ঘসূত্রী একটি ব্যাপার।
ওই কর্মকর্তা বলেন, লুট হওয়া প্রতিষ্ঠানগুলোতে এখন একটি স্থিতাবস্থা বিরাজ করছে। অর্থের বিনিময়েই গতি আনতে হবে। অর্থনীতিবিদরা বলছেন, পিকে হালদারের একার পক্ষে এতগুলো প্রতিষ্ঠান লুটপাট করা সম্ভব ছিল না। তাকে যারা সহযোগিতা করেছেন তাদেরও বিচারের আওতায় আনতে হবে। তাদের বিচারের আওতায় আনা না গেলে ভবিষ্যতে তারা হয়তো অন্য আরও অনেক পিকে তৈরি করবেন।
যেসব প্রতিষ্ঠান নজরদারির দায়িত্বে আছে তাদের ভূমিকা প্রশ্নবিদ্ধ উল্লেখ করে একজন অর্থনীতিবিদ বলেন, আইনের কোনো ফাঁক আছে কিনা সেটিও খতিয়ে দেখার সময় এসেছে।
এদিকে, এনআরবি গ্লোবাল ব্যাংকের সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক প্রশান্ত কুমার হালদারের (পিকে হালদার) সম্পদ বাজেয়াপ্ত করে জনগণের অর্থ ফেরত দেওয়া হবে বলে জানিয়েছেন অ্যাটর্নি জেনারেল এএম আমিন উদ্দিন। রবিবার (১৫ মে) দুপুরে নিজ কার্যালয়ে সাংবাদিকদের তিনি এ কথা বলেন।
এক প্রশ্নের জবাবে অ্যাটর্নি জেনারেল এএম আমিন উদ্দিন বলেন, “জালিয়াতির কারণে ভারতের আইনে তার (পিকে হালদার) বিচার হবে। তিনি মিথ্যা নাগরিকত্ব সনদ গ্রহণ করেছেন। জালিয়াতির মাধ্যমে তিনি সেখানে অবস্থান করছিলেন। কিন্তু আমাদের এখানে অর্থপাচারের মামলাটা বিচারাধীন রয়ে গেছে। সেই মামলায় বিচার প্রক্রিয়া শেষ করতে তাকে আনার জন্য ব্যবস্থা নেওয়া হবে। আশা করি, দ্রুততম সময়ে তাকে নিয়ে আসা সম্ভব হবে। সরকারি ছুটি শেষে আগামীকাল এ বিষয় নিয়ে আলাপ-আলোচনা হবে।”
তিনি বলেন, “দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) এবং বাংলাদেশ ফিন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিটের (বিএফআইইউ) দেওয়া তথ্যের ভিত্তিতে তাকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে এবং তার সম্পদ জব্দ করা হয়েছে। সে ক্ষেত্রে বাংলাদেশের যে সংস্থাগুলো আছে তারা তৎপর। তাদের তৎপরতার কারণে পি কে হালদারকে গ্রেপ্তার করা সম্ভব হয়েছে। অচিরেই তাকে বাংলাদেশে এনে বিচারের সম্মুখীন করা হবে। শুধু জেল না, তার অবৈধভাবে অর্জিত সম্পদ বাজেয়াপ্ত করে জনগণের টাকা জনগণকে ভাগ করে দেওয়া হবে।”
এ সময় অ্যাটর্নি জেনারেল বলেন, “অর্থপাচারের মামলায় এই প্রথম বাইরে থেকে কোনও বাংলাদেশিকে ধরা হলো। আরও যারা পালিয়ে গেছে, তাদের সবাইকে ধরা হবে।”
এসডব্লিউ/এসএস/১৩৪০
আপনার মতামত জানানঃ