শিগগিরই সামরিক জোট ন্যাটোতে যোগদানের আবেদন করবে বলে জানিয়েছে ফিনল্যান্ড। তবে ফিনল্যান্ডকে এ ধরনে পদক্ষেপ গ্রহণের ব্যাপারে কড়া হুঁশিয়ারি দিয়েছে রাশিয়া। ফিনল্যান্ড ন্যাটোতে যোগ দিলে সামরিক পদক্ষেপও নিতে পারে বলেও জানিয়েছে। বার্তা সংস্থা রয়টার্সের এক প্রতিবেদন থেকে এ তথ্য জানা গেছে।
এর আগে যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বাধীন সামরিক জোট ন্যাটোতে যোগ দেওয়াকে কেন্দ্র করে ইউক্রেনে হামলা চালায় রাশিয়া। দেশ দুইটির মধ্যে এখনো রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ চলছে। এরই মধ্যে ৬০ লাখ মানুষ ইউক্রেন ছেড়ে পালিয়েছে।
ইউরোপের দেশ সুইডেনের সঙ্গেই ন্যাটোতে যোগদানের আবেদন করতে পারে ফিনল্যান্ড। বিশেষ করে নিরাপত্তা বিশ্লেষকদের ধারণা, ইউক্রেন আক্রমণের পর, ন্যাটোর পূর্বমুখী সম্প্রসারণ রুখতে রাশিয়া তার আক্রমণের এলাকা বাড়াতে পারে। নিজেদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতেই নিজেদের দীর্ঘদিনের নিরপেক্ষ অবস্থান ত্যাগ করে ন্যাটোতে যোগদানের ব্যাপারে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিতে পারে দেশ দুটি। তবে মস্কো ফিনল্যান্ডের ঘোষণাকে রাশিয়ার নিরাপত্তার জন্য সরাসরি হুমকি বলে অভিহিত করেছে এবং নিজেদের নিরাপত্তা নিশ্চিতে যে কোনো ‘সামরিক ও প্রযুক্তিগত’ ব্যবস্থা গ্রহণসহ প্রতিশোধের হুমকি দিয়েছে।
পশ্চিমাদের সামরিক জোট ন্যাটোতে যোগ দিতে চায় ফিনল্যান্ড— এজন্য সব ধরনের সহযোগিতার ঘোষণা দিয়েছেন দেশটির প্রেসিডেন্ট ও প্রধানমন্ত্রী।
ন্যাটোতে যোগ দেওয়ার জন্য ফিনল্যান্ডের প্রেসিডেন্ট সাউলি নিনিস্তো ও প্রধানমন্ত্রী সান্না মারিন যে সহযোগিতার কথা বলেছেন তা প্রত্যাশিত ছিল। কারণ এর আগে দেশের নিরাপত্তার বিষয়ে সংসদে একটি প্রতিবেদন জমা দেয় তাদের সরকার। এতে ন্যাটোতে যোগ দেওয়ার দিক নির্দেশনা দেওয়া হয়।
এক যৌথ বিবৃতিতে নিনিস্তো ও মারিন জানান, ন্যাটোতে যোগ দিলে ফিনল্যান্ডের নিরাপত্তা জোরদার হবে। পাশাপাশি ফিনল্যান্ডের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থাও শক্তিশালী হবে। দেরি না করে ফিনল্যান্ডকে অবশ্যই জোটটিতে যোগ দিতে আবেদন করতে হবে। এ ব্যাপারে আগামী কয়েক দিনের মধ্যেই পদক্ষেপ নেওয়া হবে বলেও জানান তারা।
এরপরই রাশিয়ার পররাষ্ট্রমন্ত্রণালয় জানায়, ফিনিশ সরকার পররাষ্ট্রনীতিতে ব্যাপক পরিবর্তন আনতে যাচ্ছে। এ পদক্ষেপের জন্য হেলসিঙ্কিকে পরিণতি ভোগ করতে হবে ও সতর্ক থাকতে হবে। তাছাড়া ন্যাটোতে যোগ দিলে রাশিয়া ও ফিনল্যান্ডের মধ্যে দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক মারত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে বলেও জানানো হয়।
মন্ত্রণালয়টি আরও জানায়, নিরাপত্তার ওপর হুমকি মোকাবিলায় রাশিয়া যেকোনো ধরনের প্রতিশোধমূলক পদক্ষেপ গ্রহণ করবে, সেটা হতে পারে সামরিক কিংবা কৌশলগত।
এদিকে ফিনল্যান্ডের ৭৫ শতাংশ মানুষ ন্যাটোয় যোগ দিতে চান বলে ডিডাব্লিউকে জানিয়েছেন দেশের সাবেক প্রধানমন্ত্রী।
ফিনল্যান্ডের সাবেক প্রধানমন্ত্রী আলেকজান্ডার স্টাব সম্প্রতি ডিডাব্লিউকে একটি সাক্ষাৎকার দিয়েছেন। সেখানে তিনি জানিয়েছেন, ফিনল্যান্ডের মানুষ ন্যাটোয় যোগ দেওয়ার বিষয়ে কতটা উদগ্রীব। রাশিয়ার ভুল নীতির কারণেই এমনটা ঘটেছে বলে তিনি দাবি করেছেন।
বস্তুত, বৃহস্পতিবারই ফিনল্যান্ডের বর্তমান প্রধানমন্ত্রী এবং প্রেসিডেন্ট জানিয়েছেন, ফিনল্যান্ড দ্রুত ন্যাটোয় যোগ দিতে চায়, তারা আর ‘বিলম্ব’ করতে চায় না। ফিনল্যান্ডের পার্লামেন্টও এবিষয়ে তাদের সবুজ সংকেত দিয়েছে। আগামী সপ্তাহে এবিষয়ে আনুষ্ঠানিক প্রস্তাব পাশ হয়ে যাওয়ার কথা।
স্টাব দীর্ঘদিন ধরেই ফিনল্যান্ডের ন্যাটোয় যোগ দেওয়ার পক্ষে। ডিডাব্লিউকে তিনি জানিয়েছেন, ফিনল্যান্ডের জনগণ ন্যাটোয় যোগ দেওয়ার বিষয়ে এতটা প্রস্তুত ছিলেন না। তারা পশ্চিম এবং রাশিয়ার সঙ্গে ভারসাম্যের নীতি নিয়ে চলার পক্ষপাতী ছিলেন। সে কারণেই গোটা ঠান্ডা লড়াই পর্বে ফিনল্যান্ডে নিরপেক্ষ ভারসাম্যের নীতি নিয়ে চলেছিল। পরবর্তী সময়েও তারা সেই পথই অবলম্বন করতে চেয়েছিল। কিন্তু রাশিয়া ইউক্রেন আক্রমণ করার পরে সাধারণ মানুষের মানসিকতা বদলে যায়। যুদ্ধ শুরু হওয়ার পরে ৫০ শতাংশ মানুষ ন্যাটোয় যোগ দেওয়ার পক্ষে অভিমত দেন। এখন দেশের ৭৫ শতাংশ মানুষ ন্যাটোয় যোগ দিতে চান এবং চান ফিনল্যান্ড দ্রুত সেই পদক্ষেপ নিক।
ফিনল্যান্ড ন্যাটোয় যোগ দিলে তারা সেনা অভিযান চালাতে বাধ্য হবেন। বস্তুত, ইউক্রেনের ক্ষেত্রেও তারা একই কথা বলেছিল।
তবে ন্যাটোর মহাসচিব জেনস স্টলটেনবার্গ জানিয়েছেন যে, ফিনল্যান্ডকে ন্যাটো ‘উষ্ণতার সঙ্গে স্বাগত জানানো হবে’ এবং দেশটির যোগদান যাতে ‘দ্রুত ও মসৃণ’ হয় তার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন তিনি।
ফরাসি প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল মাখোঁ জানিয়েছেন, ন্যাটোতে যোগ দেওয়া বিষয়ে ফিনল্যান্ড যে সিদ্ধান্ত নিয়ে তার প্রতি পূর্ণ সমর্থন করেছেন।
এই নর্ডিক দেশ দুটি স্নায়ুযুদ্ধের সময়কার নিরপেক্ষতা পরিত্যাগ করে ন্যাটোতে যোগদানের সিদ্ধান্ত নিলে তা হবে বিগত কয়েক দশকের মধ্যে ইউরোপীয় অঞ্চলের নিরাপত্তা ব্যবস্থার পরিবর্তনের মধ্যে সবচেয়ে বড় পরিবর্তনগুলোর একটি হবে।
রাশিয়ার সঙ্গে প্রায় ১৩০০ কিলোমিটারের সীমান্ত আছে ফিনল্যান্ডের। ফলে ফিনল্যান্ড ন্যাটোয় যোগ দিলে রাশিয়া তা মোটেই সহজভাবে নেবে না। এবিষয়ে তারা ইতিমধ্যেই বেশকিছু হুমকি দিয়ে রেখেছে। ফিনল্যান্ড ন্যাটোয় যোগ দিলে বাল্টিক অঞ্চলে পরমাণু অস্ত্র মজুত করা হবে বলেও রাশিয়া হুমকি দিয়েছিল।
স্টাব বলেছেন, এটি একটি ভুয়া খবর। রাশিয়া আগেই কালিনিনগ্রাদে পরমাণু মিসাইল মজুত করে রেখেছে। ফলে নতুন করে তাদের হুমকির কোনো অর্থ নেই।
ফিনল্যান্ডের পাশাপাশি সুইডেনও ন্যাটোয় যোগ দিতে চাইছে। এখন দেখার ন্যাটো এবিষয়ে শেষপর্যন্ত কী সিদ্ধান্ত নেয়। পশ্চিমা দেশগুলি নর্ডিক এবং বাল্টিক সীমান্তে শক্তিবৃদ্ধি করতে চায় বলেই কূটনৈতিক বিশেষজ্ঞদের একাংশের বক্তব্য।
এর আগে ক্রেমলিন জানিয়েছিল, ফিনল্যান্ড ও সুইডেন মার্কিন নেতৃত্বাধীন সামরিক জোটে যোগদানের পরিকল্পনা করেছে। এটি এমন একটি প্রতিকূল পদক্ষেপ যা রাশিয়ার নিরাপত্তার জন্য হুমকি সৃষ্টি করছে। রাশিয়া এর প্রতিক্রিয়া জানাবে বলেও হুশিয়ারি দেওয়া হয়েছে ক্রেমলিনের তরফ থেকে।
বিশ্লেষকরা বলছেন, ফিনল্যান্ড ন্যাটোয় যোগ দিলে তারা সেনা অভিযান চালাতে বাধ্য হবেন। বস্তুত, ইউক্রেনের ক্ষেত্রেও তারা একই কথা বলেছিল। ফিনল্যান্ড সুইডেনের হাত ধরে ন্যাটোয় যোগ দিলে রাশিয়া বসে থাকবে না। হামলা চালাবে। পরিণতিতে তৈরী হবে আরেকটি ইউক্রেন।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/২১০৬
আপনার মতামত জানানঃ