যুক্তরাষ্ট্রে অতিরিক্ত মাদক সেবনের ফলে গত এক বছরের কিছু বেশি সময়ে মৃত্যু হয়েছে এক লাখের বেশি মানুষের। করোনাভাইরাস মহামারি পরিস্থিতির মধ্যে মাদকদ্রব্যের ওভারডোজে এত বিপুল প্রাণহানি দেশটিতে এটাই প্রথম।
প্রয়োজনের অতিরিক্ত ওষুধ সেবনের কারণে যুক্তরাষ্ট্রে প্রাণ হারিয়েছেন এক লাখ সাত হাজারের বেশি মানুষ। মাত্রাতিরিক্ত ওষুধ সেবন করে গত বছর অর্থাৎ ২০২১ সালে বিপুল সংখ্যক এসব মানুষ প্রাণ হারান।
যুক্তরাষ্ট্রের রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা বিষয়ক প্রধান সরকারি সংস্থা সেন্টার ফর ডিজিজ কন্ট্রোল অ্যান্ড প্রিভেনশন (সিডিসি) স্থানীয় সময় বুধবার (১১ মে) এই তথ্য সামনে আনে।
মূলত বিপুল এই প্রানহানিকে যুক্তরাষ্ট্রের ক্রমবর্ধমান মাত্রাতিরিক্ত ওষুধ সেবনের মহামারিতে আরেকটি দুঃখজনক রেকর্ড হিসেবে দেখা হচ্ছে। বৃহস্পতিবার (১২ মে) এক প্রতিবেদনে এই তথ্য জানিয়েছে কাতারভিত্তিক সংবাদমাধ্যম আলজাজিরা।
গত ২০ বছরেরও বেশি সময় ধরে যুক্তরাষ্ট্রে মাত্রাতিরিক্ত ওষুধ সেবনে মৃত্যুর সংখ্যা সবচেয়ে বেশি বেড়েছে। মূলত এই ধরনের প্রাণহানি বৃদ্ধির সূচনা হয়েছিল ১৯৯০-এর দশকে আফিম সংক্রান্ত একটি ব্যথানাশক ওষুধের মাত্রাতিরিক্ত সেবনের মাধ্যমে। এরই ধারবাহিকতায় হেরোইন এবং অতি সম্প্রতি অবৈধ ফেন্টানাইলের সেবনের কারণে প্রাণহানি বেড়েছে অনেক বেশি।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০২১ সালে যুক্তরাষ্ট্রে প্রাণহানির এই সংখ্যাটি আগের বছরের তুলনায় অর্থাৎ ২০২০ সাল থেকে ১৫ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে। মূলত মারা যাওয়া ব্যক্তিদের ডেথ সার্টিফিকেট পর্যালোচনা করে আনুমানিক একটি প্রতিবেদনে তৈরি করে থাকে সিডিসি।
ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অন ড্রাগ অ্যাবিউজের ডিরেক্টর ড. নোরা ভলকো মাত্রাতিরিক্ত ওষুধ সেবনে প্রাণহানির সর্বশেষ এই পরিসংখ্যানকে ‘সত্যিই বিস্ময়কর’ বলে আখ্যায়িত করেছেন।
ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অন ড্রাগ অ্যাবিউজের ডিরেক্টর ড. নোরা ভলকো মাত্রাতিরিক্ত ওষুধ সেবনে প্রাণহানির সর্বশেষ এই পরিসংখ্যানকে ‘সত্যিই বিস্ময়কর’ বলে আখ্যায়িত করেছেন।
এদিকে সিডিসির এই পরিসংখ্যান প্রকাশের পর সরব হয়েছে হোয়াইট হাউসও। মার্কিন প্রেসিডেন্টের এই বাসভবন ও কার্যালয় থেকে দেওয়া এক বিবৃতিতে মাত্রাতিরিক্ত ওষুধ সেবনে মৃত্যুর ক্রমবর্ধমান সংখ্যাকে ‘অগ্রহণযোগ্য’ বলে আখ্যায়িত করা হয়েছে। এছাড়া সম্প্রতি ঘোষিত নিজেদের জাতীয় মাদক নিয়ন্ত্রণ কৌশলের বিষয়টিও সামনে আনা হয়েছে বিবৃতিতে।
একইসঙ্গে এই ধরনের প্রাণহানি প্রতিরোধে আরও বেশি মানুষকে যথাযথ চিকিৎসার অধীনে আনা, মাদক পাচারকে ব্যাহত করা এবং ওভারডোজ-রিভার্সিং ওষুধ নালোক্সোনের সহজলভ্যতা আরও প্রসারিত করার আহ্বানও জানিয়েছে হোয়াইট হাউস।
আলজাজিরা বলছে, গত ২০ বছরেরও বেশি সময় ধরে যুক্তরাষ্ট্রে মাত্রাতিরিক্ত ওষুধ সেবনে মৃত্যুর সংখ্যা সবচেয়ে বেশি বেড়েছে। মূলত এই ধরনের প্রাণহানি বৃদ্ধির সূচনা হয়েছিল ১৯৯০-এর দশকে আফিম সংক্রান্ত একটি ব্যথানাশক ওষুধের মাত্রাতিরিক্ত সেবনের মাধ্যমে। এরই ধারবাহিকতায় হেরোইন এবং অতি সম্প্রতি অবৈধ ফেন্টানাইলের সেবনের কারণে প্রাণহানি বেড়েছে অনেক বেশি।
ফেন্টানাইল এবং অন্যান্য সিনথেটিক জাতীয় ওষুধের মাত্রাতিরিক্ত সেবনের কারণে গত বছর প্রাণহানির সংখ্যা ছাড়িয়েছে ৭১ হাজার। যা আগের বছরের তুলনায় ২৩ শতাংশ বেশি। এছাড়াও কোকেন সম্পর্কিত মৃত্যু ২৩ শতাংশ এবং মেথ ও অন্যান্য উদ্দীপক সম্পর্কিত মৃত্যুর সংখ্যা ৩৪ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে।
অতিরিক্ত মাত্রায় ওষুধ সেবনের কারণে হওয়া মৃত্যুর পেছনে প্রায়ই একাধিক ওষুধকে দায়ী করা হয়। কর্মকর্তারা বলছেন, অন্যান্য ওষুধ ক্রমবর্ধমানভাবে ছেটে ফেলে কিছু মানুষ একাধিক ওষুধ এবং সস্তা ফেন্টানাইল গ্রহণ করে। আর এটি প্রায়শই হয় ক্রেতাদের অজান্তেই।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, চলমান করোনাভাইরাস মহামারি জটিল এই সমস্যাটিকে আরও বাড়িয়ে তুলেছে কারণ লকডাউন ও অন্যান্য বিধিনিষেধ মাদকাসক্ত ব্যক্তিদের আরও বিচ্ছিন্ন করেছে এবং তাদের জন্য চিকিৎসা পাওয়াও কঠিন করে তুলেছে।
অবশ্য অতিরিক্ত মাত্রায় ওষুধ সেবনের কারণে মৃত্যুর প্রবণতা ভৌগলিকভাবে একেক স্থানে একেক রকম। আলজাজিরা বলছে, ২০২১ সালে আলাস্কায় এই ধরনের প্রাণহানি ৭৫ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে, যা যুক্তরাষ্ট্রের যেকোনো অঙ্গরাজ্যের মধ্যে সবচেয়ে বেশি।
অন্যদিকে হাওয়াইতে অতিরিক্ত মাত্রায় ওষুধ সেবনের কারণে মৃত্যু কমেছে ২ শতাংশ।
মৃত্যুর কারণ হিসেবে যুক্তরাষ্ট্রে সংখ্যার দিক থেকে আগ্নেয়াস্ত্র সহিংসতা, গাড়ি দুর্ঘটনা ও ফ্লুকে ছাড়িয়ে গেছে মাদকের ওভারডোজ।
এ নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের রোগতত্ত্ব বিভাগের অধ্যাপক ক্যাথরিন কিস বিবিসিকে বলেন, কয়েক বছর ধরে মাত্রাতিরিক্ত মাদক গ্রহণের প্রবণতা বাড়ছে। এর মধ্যেই নতুন করে ‘আগুনে ঘি ঢেলেছে’ করোনা মহামারি।
তিনি জানান, সিডিসির তথ্য বলছে, বেশির ভাগ মানুষ একাকী মাদক সেবন করেন। এটি মাত্রাধিক ডোজ গ্রহণের পেছনে একটি কারণ। এ ছাড়া মাদকের অতিরিক্ত ডোজ গ্রহণ ঠেকাতে, ক্ষতি কমাতে এবং চিকিৎসার ক্ষেত্রে মানুষের সেবা নেওয়ার সুযোগ কমেছে বলে মনে করেন তিনি।
এদিকে করোনাভাইরাসের মহামারি শেষ হলেও মাত্রাধিক মাদক গ্রহণের প্রবণতা বাড়তে থাকবে বলে মনে করছেন সেরাকিউস বিশ্ববিদ্যালয়ের লার্নার সেন্টার ফর পাবলিক হেলথ প্রমোশনের পরিচালক শ্যানন মোনাট। তিনি বলেন, ‘আমাদের এ সংকট ভিন্ন ভিন্ন উপায়ে সামাল দিতে হবে।’
তিনি বলেন, ড্রাগ ওভারডোজে মৃত্যু ‘একটি আমেরিকান ট্র্যাজেডি, এবং এটি প্রতিরোধযোগ্য’।
তার উল্লেখিত সম্ভাব্য কিছু সমাধানের মধ্যে রয়েছে, ফেন্টানাইল পরীক্ষার স্ট্রিপ তৈরি। তিনি আরও বলেন, ‘আমাদের স্বীকার করতে হবে যে গত ২০ থেকে ৩০ বছরে মাদকের ব্যবহার বাড়তে থাকা সামাজিক ও অর্থনৈতিক সমস্যার একটি উপসর্গ। আমাদের ড্রাগ ওভারডোজ সংকট মোকাবেলার সমাধানগুলো তখনই কার্যকর হবে যদি আমরা দীর্ঘমেয়াদী সামাজিক এবং অর্থনৈতিক সমস্যাগুলো মোকাবেলা করতে পারি’।
যুক্তরাষ্ট্রের ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অন ড্রাগ ওভারডোজের পরিচালক ড. নোরা ভলকো বলেন, ‘অনেক বিপজ্জনক মাদক এখন অনেক কম দামে পাওয়া যাচ্ছে। ফলে যারা আগে থেকেই ওভারডোজে অভ্যস্ত, তাদের অনেকেই এখন আরও বেশি মাদক সেবন করছেন।’
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৫০১
আপনার মতামত জানানঃ