গণপরিবহনের স্বল্পতা, ট্রাফিক ব্যবস্থাপনায় দুর্বলতা, যানজটের ভোগান্তি এড়িয়ে দ্রুত গন্তব্যে পৌঁছানোর সুবিধা থাকায় জনপ্রিয় হয়ে উঠছে মোটরসাইকেল। সারাদেশের সড়কগুলোয় প্রতিদিনই বাড়ছে মোটরসাইকেলের সংখ্যা। একইসাথে বাড়ছে দুর্ঘটনা ও নিহতের সংখ্যা। এবারের ঈদযাত্রায় গত ১০ দিনে সারা দেশে ৯৭ জন মোটরসাইকেল আরোহী নিহত হয়েছেন। আর এ নিহতদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য সংখ্যকই ছিল কিশোর মোটরসাইকেল আরোহী।
রোড সেফটি ফাউন্ডেশনের তথ্য অনুযায়ী, ঈদের সময়ে সড়ক দুর্ঘটনায় যারা প্রাণ হারিয়েছেন তাদের মধ্যে ৯৭ জনই ছিলেন মোটরসাইকেল আরোহী। যাদের মধ্যে অর্ধেকের বেশি ছিল অপ্রাপ্তবয়স্ক। বিশ্লেষকরা ফিটনেসবিহীন যানবাহন, অদক্ষ চালক ও সড়ক ব্যবস্থাপনার সংকটকে সড়ক দুর্ঘটনার প্রধান কারণ হিসেবে দেখছেন। তারা বলছেন, নিরাপদ সড়ক আইন কাগজে থাকলেও বাস্তবে তার প্রয়োগ না থাকায় সড়কে মৃত্যুর মিছিল চলছে।
রোড সেফটি ফাউন্ডেশনের তথ্য অনুযায়ী, গত ২৫শে এপ্রিল থেকে ৫ই মে পর্যন্ত সারা দেশে ১৭৮টি সড়ক দুর্ঘটনা ঘটেছে। এতে নিহত হয়েছেন মোট ২৪৯ জন। এরমধ্যে মোটরসাইকেল আরোহী ছিলেন ৯৭ জন। যা মোট দুর্ঘটনার ৩৮ দশমিক ৫৯ শতাংশ। মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় ৫৭ শতাংশ ছিল অপ্রাপ্তবয়স্ক। সংস্থাটির অপর একটি পরিসংখ্যান বলছে, গত ১লা মে থেকে ৫ই মে পর্যন্ত ১১২টি সড়ক দুর্ঘটনা ঘটেছে। এতে ১৩৯ জন নিহত হয়েছেন। একই সময় ৫৬ জন মোটরসাইকেল আরোহী নিহত হয়েছেন যা মোট মৃত্যুর ৪০ দশমিক ২৮ শতাংশ।
এ বিষয়ে রোড সেফটি ফাউন্ডেশনের নির্বাহী পরিচালক সাইদুর রহমান সংবাদমাধ্যমকে বলেন, ‘এবারের ঈদযাত্রায় সড়কে মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় নিহতের সংখ্যা আমাদের ভাবিয়ে তুলেছে। দুই চাকার এ বাহনের ব্যবহার কমানো না গেলে আগামীতে আমাদের জন্য বড় বিপদ অপেক্ষা করছে।’
তিনি আরও বলেন, ‘আমাদের সড়ক ব্যবস্থার বেহাল অবস্থার কারণে অনেকে মৃত্যু ঝুঁকি নিয়েও বাইকের দিকে ঝুঁকছেন। আমাদের তথ্য অনুযায়ী গত কয়েক দিনে বাইক যাত্রী যারা মৃত্যুবরণ করেছেন তাদের মধ্যে অনেকের মাথায় হেলমেট ছিল না। যাদের মাথায় হেলমেট থাকে তারা অন্তত নিরাপদ থাকতে পরে। আর যারা বাইক যাত্রায় শুধু ক্যাপের ব্যবহার করেন তাদের অ্যাক্সিডেন্টের পরের অবস্থা ভয়াবহ হয়। এ বিষয়ে বাইকার ও যাত্রীদের হেলমেট ব্যবহারে সচেতনতা বাড়াতে হবে।’
এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘কোম্পানিরা তাদের লাভের জন্য মোটরসাইকেলের লোভনীয় বিজ্ঞাপন দিয়ে থাকে। যার ফলে দেশের তরুণদের মধ্যে বাইক রাইডের বেশ উদ্দীপনা জেগে উঠে। এসব আকর্ষণীয় বিজ্ঞাপনের বদলে আমাদের সচেতনতামূলক প্রচারণা চলাতে হবে আমাদের। এর জন্য পরিবার ও রাষ্ট্রকে দায়িত্ব নিতে হবে।’
নিরাপদ সড়ক আইন কাগজে থাকলেও বাস্তবে তার প্রয়োগ না থাকায় সড়কে মৃত্যুর মিছিল চলছে।
তিনি আরও বলেন, ‘প্রতিটি পাড়া-মহল্লায় নেতাদের বাইকাররা অনেক বেপরোয়া। এসব বাইকারদের কারণে পথচারীরা এক প্রকার অতিষ্ঠ। তাদের কোনোভাবেই থামানো যাচ্ছে না। নেতাদের বাইক রাইডাররা যত্রতত্র ফুটপাত দিয়ে উচ্চগতিতে বাইক চালায়। আগামীর সড়ক দুর্ঘটনায় প্রাণ না হারিয়ে সুস্থ বাংলাদেশ পেতে তাদের থামানো এখন সময়ের দাবি।’
প্রতিকার হিসেবে রোড সেফটি ফাউন্ডেশনের নির্বাহী পরিচালক বলেন, ‘দেশের ট্রাফিক বিভাগের সচেতনতাই পারে সড়কে মৃত্যু-শূন্য বাংলাদেশ উপহার দিতে। আমাদের যে আইন রয়েছে তার যথাযথ প্রয়োগের হলে আগামীতে সড়কে আর কোনো প্রাণ হারাবে না।’
সড়কে অতিরিক্ত মোটরসাইকেল চলাচল ও দুর্ঘটনার বিষয়ে গণপরিবহন ব্যবস্থার নাজুক অবস্থাকে দায়ী করছেন বিশেষজ্ঞরা। তারা বলছেন, সড়কে যানজটের কারণে অনেকেই মোটরসাইকেলকে বিকল্প হিসেবে দেখছেন। দুই চাকার বাহনে চলাচলে স্বস্তিতে বাড়ি ফিরতে অনেকে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে দূর-দূরান্তে রওনা দিচ্ছেন। মোটরসাইকেল চালকদের ট্রাফিক নিয়মবহির্ভূত অতিরিক্ত গতির কারণে এবারে সড়ক দুর্ঘটনার পরিমাণ বেড়েছে। আবার অনেকে কোনোরকম মোটরসাইকেল চালানো শিখেই ড্রাইভিং লাইসেন্স ছাড়াই রাস্তায় যাত্রী বহন করতে নেমে পড়ছে। এতে করে চালক ও তার সঙ্গে যুক্ত হওয়া যাত্রীও বিপদে পড়ছেন।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, মোটরবাইক দুর্ঘটনা শীর্ষে থাকার প্রধান কারণ হেলমেট ব্যবহার না করার প্রবণতা, ট্রাফিক আইন লঙ্ঘন ও বেপরোয়া ড্রাইভিং৷ আর অদক্ষ এবং লাইসেন্সবিহীন চালক তো আছেই৷
সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, শুধু বাংলাদেশে নয়, সারাবিশ্বেই মোটরবাইক থ্রি ও ফোর হুইলারের চেয়ে ৫০ থেকে ১০০ ভাগ বেশি ঝুঁকিপূর্ণ৷ কারণ এটি দুই চাকার ওপর চলাচল করে৷ বাংলাদেশে বাস্তবে মোটরবাইকের দুর্ঘটনার হার অনেক বেশি৷ রিপোর্টে সব আসে না৷ রাইড শেয়ারিং-এর নামে গত কয়েক বছরে বাংলাদেশে যে বিপুল পরিমাণ মোটরবাইক নেমেছে তা ইতিমধ্যেই সংকট তৈরি করছে৷ এখন প্রচুর ফ্রিল্যান্স মোটরবাইকার আছে৷ ফলে নিরাপত্তা ও সড়ক ব্যবহারের দিক থেকে বড় সংকট তৈরি করবে যদি এখনই নিয়ন্ত্রণে আনা না যায়৷
তারা বলেন, ভিয়েতনাম, কম্বোডিয়া, ইন্দোনেশিয়া এরইমধ্যে এই সংকটে পড়েছে৷ তাদের সড়ক দুর্ঘটনার ৬০ ভাগ এখন মোটরবাইকের কারণে। ঢাকা শহরে মোট কত মোটরবাইক চলাচল করছে তার সঠিক সংখ্যা নির্ধারণ করা কঠিন৷ কারণ যেখান থেকেই মোটরবাইক নিবন্ধন করা হোক না কেন তা সারাদেশেই চলতে পারে৷ আইন বা জরিমানা করে সড়ক দুর্ঘটনা পুরোপুরি রোধ সম্ভব নয়। বরং আইন ও নিয়ম-কানুন যাতে মানুষ মেনে চলে সে বিষয়ে সচেতনতা তৈরি করতে হবে।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৮৩২
আপনার মতামত জানানঃ