‘একজন সাজাপ্রাপ্ত আসামি বিদেশ যেতে পারেন না। বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া সাজাপ্রাপ্ত আসামি হওয়ার কারণেই বিদেশে যেতে পারেননি। হাজি সেলিমেরও বিদেশে যাওয়ার সুযোগ নেই। তার তো আত্মসমর্পণ করার কথা।’
– দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) আইনজীবী খুরশীদ আলম।
উচ্চ আদালতের রায়ে দুর্নীতির মামলায় দণ্ড বহাল থাকার পরও ঢাকা ৭ আসনের সাংসদ ও ঢাকা মহানগর আওয়ামী লীগের নেতা হাজি মোহাম্মদ সেলিম বিদেশে চলে গেছেন।
সূত্র মতে, দুর্নীতির মামলায় ১০ বছরের দণ্ড নিয়ে দেশ ছেড়েছেন আওয়ামী লীগের সাংসদ হাজি সেলিম। গত শনিবার বিকেলে কঠোর গোপনীয়তার মধ্য দিয়ে তিনি হজরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর দিয়ে থাইল্যান্ডের ব্যাংকক যান।
যেভাবে বিদেশ গেলেন হাজি সেলিম
হাজি সেলিমের ঘনিষ্ঠ একটি সূত্র আজ সোমবার এসব তথ্য নিশ্চিত করেছে। হাজি সেলিমের ঘনিষ্ঠ ওই সূত্র বলছে, শনিবার তিনটি গাড়ির একটি বহর নিয়ে আজিমপুর কবরস্থানে যান হাজি সেলিম। সেখানে কবর জিয়ারত করে বিমানবন্দরে যান।
তবে এ সময় তার সঙ্গে পরিবারের কেউ ছিলেন না। গাড়ির চালকেরাও আগে থেকে জানতেন না তারা কোথায় যাচ্ছেন। হাজি সেলিম সব সময় যে গাড়ি ব্যবহার করেন, ওই দিন সে গাড়িতে যাননি। চালকও ছিলেন আরেকজন।
সূত্রটি আরও জানায়, হাজি সেলিমের সফরসঙ্গী হিসেবে ঘনিষ্ঠ কেউ যাননি। তিনি (হাজি সেলিম) যাওয়ার আগে বা পরে ঘনিষ্ঠ কেউ ব্যাংকক গিয়ে থাকতে পারেন। চিকিৎসার কথা বলে তিনি ব্যাংকক গিয়েছেন।
এ বিষয়ে বক্তব্যের জন্য হাজি সেলিমের বড় ছেলে সোলাইমান সেলিমের মুঠোফোনে যোগাযোগের চেষ্টা করে তাকে পাওয়া যায়নি। ফোন করা হলে সেটি অন্য একজন রিসিভ করেন এবং তিনি কিছু জানেন না বলে দাবি করেন।
তবে সোলাইমান সেলিম গতকাল রোববার একটি টেলিভিশন চ্যানেলের প্রশ্নের জবাবে বলেছেন, তার বাবা এখন দেশে নেই। এ বিষয়ে জানতে হাজি সেলিমের ব্যক্তিগত সহকারী মহিউদ্দিন বেলালের সঙ্গে মুঠোফোনে যোগাযোগের চেষ্টা করেও পাওয়া যায়নি।
১০ বছর সাজা বহাল
জ্ঞাত আয়বহির্ভূত সম্পদ অর্জনের দায়ে হাজি সেলিমের ১০ বছর সাজা বহাল রেখে হাইকোর্টের দেওয়া পূর্ণাঙ্গ রায় গত ১০ ফেব্রুয়ারি প্রকাশিত হয়। রায়ের অনুলিপি পাওয়ার ৩০ দিনের মধ্যে হাজি সেলিমকে ঢাকার বিশেষ জজ আদালত-৭-এ আত্মসমর্পণ করতে নির্দেশ দেন হাইকোর্ট। এই সময়সীমার মধ্যেই আওয়ামী লীগের এই সাংসদ দেশ ছেড়েছেন।
প্রসঙ্গত, গত বছরের ৯ মার্চ অবৈধ সম্পদ অর্জনের অভিযোগে হাজি মোহাম্মদ সেলিমকে বিচারিক আদালতের দেওয়া ১০ বছর কারাদণ্ডাদেশ বহাল রাখেন হাইকোর্ট বিভাগ। তবে তিন বছরের দণ্ড থেকে খালাস পান তিনি। রায় ঘোষণার ৩০ দিনের মধ্যে তাঁকে বিচারিক আদালতে আত্মসমর্পণ করতে বলা হয়। ২০০৭ সালের ২৪ অক্টোবর হাজি সেলিমের বিরুদ্ধে লালবাগ থানায় অবৈধভাবে সম্পদ অর্জনের অভিযোগে মামলা করে দুদক। এ মামলায় ২০০৮ সালের ২৭ এপ্রিল তাঁকে দুই ধারায় ১৩ বছরের কারাদণ্ড দেন বিচারিক আদালত।
২০০৭ সালে দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) করা মামলায় দুটি ধারায় বিচারিক আদালতে ১০ বছর ও তিন বছরের কারাদণ্ড হয়েছিল হাজি সেলিমের। এর মধ্যে একটি ধারায় বিচারিক আদালতের দেওয়া ১০ বছরের কারাদণ্ড বহাল রেখে আরেকটি ধারায় তিন বছরের সাজা থেকে খালাস দেওয়া হয়েছিল তাঁকে।
রায়ে বিচারিক আদালতের দেওয়া ১০ লাখ টাকা অর্থদণ্ডও বহাল রেখেছেন হাইকোর্ট। এ টাকা পরিশোধ না করলে তাঁকে আরও এক বছর কারাভোগ করার কথা বলা হয়েছে রায়ে। তা ছাড়া এ মামলা-সংক্রান্ত জ্ঞাত আয়বহির্ভূত সম্পদ রাষ্ট্রের অনুকূলে বাজেয়াপ্ত করতেও নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
হাজি সেলিম পারলেও পারেনি খালেদা জিয়া
অন্যদিকে হাজি সেলিমের আইনজীবী সাঈদ আহমেদ বলেছেন, উচ্চ আদালত তাঁকে এক মাসের মধ্যে আত্মসমর্পণের নির্দেশ দিয়েছেন। এই সময়ের আগে তাঁর বিদেশে যাওয়ার ক্ষেত্রে আইনগত কোনো বাধা নেই।
এখানে প্রশ্ন উঠেছে, দণ্ডিত আসামি বিদেশে যেতে পারেন কি না। উচ্চ আদালত যেহেতু তাঁর দণ্ড বহাল রেখে নিম্ন আদালতে আত্মসমর্পণ করতে বলেছেন, সেহেতু তিনি দণ্ডিত। নতুন করে আদালত কোনো নির্দেশ না দেওয়া কিংবা রাষ্ট্রপতি তার দণ্ড মওকুফ না করা পর্যন্ত তিনি দণ্ডিত।
এদিকে, হাজি সেলিম যদি বিদেশে গিয়ে ফেরত না আসেন? এই প্রশ্ন তুলেছেন বিচারপতি শামসুদ্দীন চৌধুরীও।
এ অবস্থায় হাজি সেলিমকে দেশত্যাগে সহায়তাকারীরা অপরাধ করেছেন বলে মনে করছেন আপিল বিভাগের অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি এ এইচ এম শামসুদ্দিন চৌধুরী (মানিক)।
তিনি গতকাল একুশে টেলিভিশনকে বলেছেন, ‘এই ক্ষেত্রে তার (হাজি সেলিম) সাজা হয়েছে বিচারিক আদালতে। আপিল প্রক্রিয়াও শেষ হয়েছে। সর্বোচ্চ আদালতেও তার সাজা বহাল রয়েছে। সর্বোচ্চ আদালত তাকে নিম্ন আদালতে আত্মসমর্পণ করার আদেশ দিয়েছেন। সে অবস্থায় সেই ব্যক্তি কোনোভাবেই দেশত্যাগ করতে পারেন না।
হাজি সেলিমের আইনজীবী বলেছেন, বিদেশে চিকিৎসকের সঙ্গে তার আগেই অ্যাপয়েন্টমেন্ট করা ছিল। এখন বিদেশে কোনো চিকিৎসক যদি এই বলে সনদ দেন যে হাজি সেলিমের বিমানযাত্রা তার জন্য অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ, তখন কী হবে?
এছাড়া, উচ্চ আদালতে দণ্ড বহাল থাকা এবং নিম্ন আদালতে আত্মসমর্পণের নির্দেশ সত্ত্বেও যদি হাজি সেলিম বিদেশে যেতে পারেন, তাহলে সেই নিয়ম বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার ক্ষেত্রে অনুসৃত হলো না কেন?
বিএনপির নেতারা যতবার চিকিৎসার জন্য খালেদা জিয়াকে বাইরে পাঠানোর দাবি জানিয়েছেন, ততবার আওয়ামী লীগের নেতারা, মন্ত্রীরা বলেছেন, দণ্ডিত আসামির দেশের বাইরে যাওয়ার সুযোগ নেই।
তাহলে হাজি সেলিমের জন্য সেই সুযোগ কীভাবে হলো? হাজি সেলিমের আইনজীবীর ভাষ্যমতে, তিনি শারীরিক অসুস্থতার কারণেই বিদেশে গিয়েছেন। আওয়ামী লীগের একজন সাংসদ যে সুবিধা পেতে পারেন, সাবেক প্রধানমন্ত্রী ও বিরোধী দলের নেত্রী সেই সুবিধা পেতে পারেন না?
এখানে খালেদার জন্য এক আইন আর হাজি সেলিমের জন্য অন্য আইন দেখা যাচ্ছে। যদিও নির্বাহী আদেশে সরকার খালেদা জিয়াকে জেলের বাইরে রেখেছে।
এছাড়াও ১৪ বছর আগে বিচারিক আদালতে হাজি সেলিম দণ্ডিত হলেও এখন পর্যন্ত জেল খাটতে হয়নি। আর খালেদা জিয়ার মামলার রায় হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তাকে জেলে যেতে হয়েছে। বিএনপির নেত্রী খালেদা জিয়া ও আওয়ামী লীগ সাংসদ হাজি সেলিম, দুজনের বিরুদ্ধেই দুর্নীতির মামলা হলেও এর গুণগত পার্থক্য আছে।
খালেদা জিয়ার মামলা দুটি হলো জিয়া অরফানেজ ও চ্যারিটেবল তহবিলের অর্থ হস্তান্তর-সংক্রান্ত। সেখানে অর্থ আত্মসাতের কোনো অভিযোগ নেই। কিন্তু হাজি সেলিমের মামলাটি হলো অবৈধ সম্পদ অর্জনের অভিযোগে। নিম্ন আদালত তাকে ১৩ বছর কারাদণ্ড দিলেও উচ্চ আদালত কমিয়ে ১০ বছর করেছেন। অন্যদিকে খালেদার মামলায় নিম্ন আদালতের দণ্ড উচ্চ আদালতে বেড়ে গেছে।
আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর হাজি সেলিমকে কখনো জেলে যেতে হয়নি। নিম্ন আদালতে দণ্ডিত হওয়ার পর উচ্চ আদালতে রিট করে তিনি জামিন পেয়ে গেছেন। এমনকি হাইকোর্টের রায় বাতিল করেও আপিল বিভাগ পুনরায় শুনানি করার নির্দেশ দিয়েছিলেন। দ্বিতীয় দফা রায়েও হাজি সেলিম দণ্ডিত হয়েছেন।
উচ্চ আদালত দ্বারা দণ্ডিত সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া এবং সরকার দলীয় সাংসদ হাজি সেলিমের প্রতি সরকারের এই ভিন্ন আচরণ একযাত্রায় ভিন্ন ফল নয় কি?
এসডব্লিউ/এসএস/১৮১৭
আপনার মতামত জানানঃ