আর্থিক অপরাধের তদন্তকারী কেন্দ্রীয় সংস্থা এনফোর্সমেন্ট ডিরেক্টরেট (ইডি) ভারতের সীমান্তরক্ষী বাহিনী বর্ডার সিকিউরিটি ফোর্সের (বিএসএফ) এক কর্মকর্তাকে গ্রেপ্তার করেছে। ওই ব্যক্তির নাম সতীশ কুমার। গরু পাচারের সঙ্গে যুক্ত এমন অভিযুক্ত ব্যক্তিদের কাছ থেকে আইনবহির্ভূতভাবে টাকা নেওয়ার অভিযোগে তাকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।
বিএসএফের এই কর্মকর্তাকে শুক্রবার(২১ এপ্রিল) রাতে দিল্লি ডেকে পাঠিয়ে দীর্ঘ জিজ্ঞাসাবাদের পর গ্রেপ্তার করে ইডি। তার বিরুদ্ধে গরু পাচারকারীদের কাছ থেকে ১২ কোটি টাকা ঘুষ নেয়ার অভিযোগ রয়েছে।
জানা গেছে, গরু পাচারকাণ্ডে এর আগে ২০২০ সালে সিবিআই বা ভারতের কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সংস্থা-সিবিআই সতীশ কুমারকে গ্রেপ্তার করেছিল। তিনি জামিনে ছিলেন। কিন্তু বয়ানে অসংগতি থাকায় তদন্তের স্বার্থে তাকে আবারও গ্রেপ্তার করেছে ইডি।
পশ্চিমবঙ্গ থেকে বাংলাদেশে গরু পাচারের হোতাদের সঙ্গে যোগসাজশ এবং বেআইনিভাবে অর্থ উপার্জনের অভিযোগ রয়েছে এই বিএসএফ কমান্ডারের বিরুদ্ধে। কিছুদিন আগেই সতীশ কুমারের স্ত্রীর কয়েক কোটি টাকা বাজেয়াপ্ত করেছে ইডি।
২০১৫-এর ১৯ ডিসেম্বর থেকে ২০১৭ সালের এপ্রিল পর্যন্ত ভারত-বাংলাদেশ সীমান্তে কর্তব্যরত ছিলেন বিএসএফ কমান্ডার সতীশ কুমার।
তাকে শনিবার দিল্লির রাউস অ্যাভিনিউ কোর্টে তোলা হচ্ছে। সূত্রের খবর, তাকে আরও জিজ্ঞাসাবাদের জন্য হেফাজতে চাইবে ইডি।
এর আগে ইডি জানিয়েছে, মনোজ সানা নামের এক ব্যক্তি প্রায় ১৩ কোটি ভারতীয় মুদ্রা সতীশ কুমারের স্ত্রী তানিয়া সান্যাল এবং শ্বশুর বাদলকৃষ্ণ সান্যালের ব্যাংক অ্যাকাউন্টে অতীতে জমা করেন। এই টাকা পরবর্তী সময়ে সম্পত্তি এবং মিউচুয়াল ফান্ড কিনতে ব্যয় করা হয়। ভারত থেকে বাংলাদেশে গরু পাচারকারীদের যে চক্র রয়েছে, সতীশ কুমার তার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন বলে অভিযোগ করেছে ইডি।
সতীশ কুমারের স্ত্রী ও পুত্রের নামে থাকা সম্পত্তি আপাতত বাজেয়াপ্ত করা হয়েছে। এই সম্পত্তির পরিমাণ প্রায় তিন কোটি টাকা, যার মধ্যে স্থায়ী সম্পত্তি ও মিউচুয়াল ফান্ড রয়েছে।
বিএসএফের ৩৬ নম্বর ব্যাটালিয়নের সাবেক কমান্ড্যান্ট সতীশ কুমার এবং আরও ছয়জনের বিরুদ্ধে এক বছর আগে চার্জশিট দিয়েছিল কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সংস্থা সেন্ট্রাল ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (সিবিআই)। সেই চার্জশিটে বলা হয়েছিল, পশ্চিমবঙ্গের মুর্শিদাবাদ এবং মালদা জেলায় দায়িত্বে থাকার সময় সতীশ কুমার একটি চক্রের সঙ্গে জড়িয়ে পড়েন, যারা গরু পাচারের সঙ্গে যুক্ত ছিল। এই ছয়জনের মধ্যে সক্রিয় ছিলেন মহম্মদ এনামুল হক নামের এক ব্যক্তি। চার্জশিটে সতীশ কুমারের পরিবারের সদস্যদের নামও ছিল। এই মামলার জেরে সিবিআই তাকে ২০২০ সালের নভেম্বর মাসে গ্রেপ্তার করে, কিন্তু তিনি ডিসেম্বরে জামিন পেয়ে যান। সিবিআইয়ের সেই মামলার জেরেই এখন সতীশ কুমারকে পুনরায় গ্রেপ্তার করা হলো।
পশ্চিমবঙ্গ থেকে বাংলাদেশে গরু পাচারের হোতাদের সঙ্গে যোগসাজশ এবং বেআইনিভাবে অর্থ উপার্জনের অভিযোগ রয়েছে এই বিএসএফ কমান্ডারের বিরুদ্ধে। কিছুদিন আগেই সতীশ কুমারের স্ত্রীর কয়েক কোটি টাকা বাজেয়াপ্ত করেছে ইডি।
এনামুল হকের সঙ্গে মনোজ সানা কাজ করতেন। গরু পাচারের সঙ্গে যুক্ত থাকার অভিযোগে এনামুলকে ১৮ ফেব্রুয়ারি দিল্লিতে গ্রেপ্তার করে ইডি। তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করে সতীশ কুমারকে গ্রেপ্তার করা হয়েছিল বলে ইডি জানিয়েছে।
এনামুল হককে জেরা করে এখন পর্যন্ত প্রায় ১৮০ কোটি টাকা উদ্ধার করা হয়েছে। এনামুল হকের বিরুদ্ধে বেআইনি কয়লা ব্যবসা চালানোর অভিযোগও রয়েছে। কয়লা মামলায় এনামুল হককে ২০১৮ সালেও গ্রেপ্তার করা হয়েছিল, তবে তিনি জামিন পেয়ে যান।
কয়লা মামলার প্রসঙ্গে ইডি আগেই জানিয়েছিল, বিনয় এবং বিবেক মিশ্র নামের দুই ভাই ২০১৬ সালের অক্টোবর থেকে ২০১৭ সালের মার্চ মাস পর্যন্ত এনামুল হকের কাছ থেকে ছয় কোটি টাকার কিছু বেশি অর্থ পেয়েছিলেন। এই অর্থ পশ্চিমবঙ্গ থেকে বাংলাদেশে গরু পাচারের জন্য এনামুল হক মিশ্র ভাইদের (বিনয় ও বিবেক) দিয়েছিলেন বলে অভিযোগ।
বিনয় মিশ্র যুব তৃণমূল কংগ্রেসের অন্যতম সাধারণ সম্পাদক ছিলেন। তিনি তৃণমূল কংগ্রেসের এমপি ও জাতীয় সাধারণ সম্পাদক অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়ের ঘনিষ্ঠ বলে পশ্চিমবঙ্গের প্রচারমাধ্যমে জানানো হয়েছিল।
বিনয় মিশ্র বর্তমানে তৃণমূলের সঙ্গে নেই। কিন্তু তার কয়লা পাচারের মামলা সিবিআইয়ের হাতে রয়েছে। এই মামলা ক্রমেই বড় আকার ধারণ করছে। ভবিষ্যতে এই মামলা অভিষেকের চিন্তার কারণ হতে পারে বলে রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকেরা মনে করছেন।
পশ্চিমবঙ্গ বিধানসভায় বিরোধীদলীয় নেতা শুভেন্দু অধিকারী এক বছর ধরে বারবারই অভিযোগ করেছেন, অভিষেকের সঙ্গে গরু, কয়লা এবং বালু চোরাচালান চক্রের যোগ রয়েছে। তবে এখন পর্যন্ত অভিষেকের বিরুদ্ধে কিছুই আদালতে প্রমাণিত হয়নি। এনামুল হক বর্তমানে ইডির হেফাজতে রয়েছেন।
বিষয়গুলো নিয়ে নানান মামলা চলাকালে সতীশ কুমারের গ্রেপ্তার পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতিতে নতুন মাত্রা যোগ করবে বলে মনে করা হচ্ছে। ইডি সূত্র জানাচ্ছে, বিএসএফ ও কাস্টমস এবং স্থানীয় পুলিশের কর্মকর্তাদের একটা বড় অংশ কয়লা কেলেঙ্কারি এবং গরু চোরাচালানের সঙ্গে যুক্ত। আশা করা হচ্ছে, সতীশ কুমার ও এনামুল হককে জেরা করে দ্রুত এই সরকারি কর্মচারীদের গ্রেপ্তার করবে তদন্তকারী সংস্থা।
বাংলাদেশে গরুর মাংসের চাহিদা আছে, দাম বেশি অথচ চাহিদার তুলনায় গরুর সংখ্যা কম। বাংলাদেশ ভারত সীমান্ত সুরক্ষিত নয়। কারন হল ৪০০০ কিলোমিটার দীর্ঘ সীমান্ত নিশ্ছিদ্র করা সম্ভব নয়। এর উপর আছে সীমান্তরক্ষীদের উপরি আয়, ফলে ভারত এবং বাংলাদেশের ব্যাবসায়ীদের জন্য গরু চোরাচালান এক লোভনীয় ব্যাবসা। কোটি কোটি টাকার গরু ভারত থেকে বাংলাদেশে চোরাচালানের মাধ্যমে আসে, যা বাংলাদেশের গরুর মাংসের ৫০% এর ও বেশী চাহিদা পূরন করে থাকে । ঈদের সময় এই চোরাচালান আরো বেশী পরিমাণে হয়।
বিশ্লেষকরা বলছেন, গরু চোরাচালান সীমান্ত হত্যার প্রধান কারন হিসেবে বিবেচিত হয়ে থাকে। গরু চোরাচালান বন্ধের সহজ উপায় হল এই ব্যবসাকে বৈধতা দেওয়া। এতে করে সীমান্ত হত্যা কমে যাবে, উল্লেখযোগ্য পরিমান অর্থ সরকারী কোষাগারে জমা হবে এবং ব্যবসায়ীরাও লাভবান হবে। বাংলাদেশ সব সময়ই ভারত থেকে বৈধভাবে গরু আমদানী করতে আগ্রহী। কিন্তু ভারত সরকার গরু রফতানী করতে আগ্রহী নয় যদিও ভারতীয় সীমান্ত রক্ষীরা একে বৈধতা দেওয়ার পক্ষে।
বাংলাদেশ-ভারত যদিও বন্ধুরাষ্ট্র, তবুও এ দুই দেশের সীমান্তে রাষ্ট্রীয় হত্যা হয় গোটা বিশ্বের মধ্যে সবচেয়ে বেশি। তবে এই গুলির ঘটনা একতরফা। বাংলাদেশের সীমান্তরক্ষী বাহিনীর পক্ষ থেকে ভারতীয় কোনো নাগরিক গুলিবিদ্ধ না হলেও ভারতের পক্ষ থেকে নিয়ম করেই গুলি চালিয়ে বাংলাদেশি নাগরিকদের হত্যা করা হচ্ছে।
সীমান্তে নিরস্ত্র বাংলাদেশি নাগরিকদের বেআইনিভাবে হত্যায় বাংলাদেশের উদ্বেগের বিষয়টি নয়াদিল্লিতে খুবই কম গুরুত্ব পেয়েছে। এখনও পর্যন্ত কোনো বাংলাদেশিকে হত্যার অভিযোগে অভিযুক্ত বিএসএফ সদস্যের বিবরণ বাংলাদেশকে দেয়নি ভারত। ভারত সরকারের কোনো সুনির্দিষ্ট অনুমোদন না থাকলে অন্যান্য নিরাপত্তা বাহিনীর পাশাপাশি বিএসএফকেও ফৌজদারি কার্যবিধির বাইরে রাখা হয়। বিএসএফ সদস্যদের এমন জবাবদিহিতার বাইরে থাকাই সীমান্ত হত্যার ঘটনাগুলোকে বাড়িয়ে দিচ্ছে।
বিশ্লেষকরা বলেন, ভালো প্রতিবেশী দেশ সীমান্তে চলাচলকারীদের সঙ্গে জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক আইন অনুযায়ী আচরণ করে। ভারত সরকারের এটা নিশ্চিত করা উচিত যে তার সীমান্ত রক্ষী বাহিনী মানুষের মৌলিক অধিকারের প্রতি সম্মান করছে এবং আইনের শাসন অনুসরণ করছে। বিএসএফ এবং অন্যান্য আইন প্রয়োগকারী বাহিনীর কর্মকর্তাদের আগ্নেয়াস্ত্র ব্যবহারে জাতিসংঘের সাধারণ নীতিমালা মেনে চলার জন্য প্রকাশ্যে আদেশ দেওয়া উচিত। বিএসএফের নিজস্ব বিচার ব্যবস্থা এখনও পর্যন্ত তার সদস্যদের বিচার করতে পারেনি। ভারত সরকার বেসামরিক কর্তৃপক্ষকে নির্যাতনের মামলাগুলো তদন্তের অনুমতি দেওয়ার বিষয়টি বিবেচনা করতে পারে।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/২০৫৮
আপনার মতামত জানানঃ