আসলেই কি ভিনগ্রহবাসী বা এলিয়েনদের দেখা মিলবে? দীর্ঘদিন ধরেই মানুষের মনে এই প্রশ্ন উঠেছে। অনেকেই এলিয়েনদের খুঁজে পাওয়া কিংবা তাদের সঙ্গে যোগাযোগের বিষয়টি নিছকই বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনির বিষয় বলেই মনে করেন। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রের মহাকাশ গবেষণা সংস্থা নাসা বলছে ভিন্ন কথা।
মহাকাশ, মহাজাগতিক ব্যাপার-স্যাপার নিয়ে কৌতূহলের অন্ত নেই, জানার চেষ্টারও শেষ নেই মানুষের। নানা সময়ে নানা কিছু তাই সামনে আসে আমাদের।
পৃথিবীর বাইরে কি কোনও জীবন রয়েছে? বিজ্ঞানীরা ভিনগ্রহে জীবনের অনুসন্ধান করেই চলেছেন নিরন্তর। সৌরজগতের চৌহদ্দির বাইরে অন্য সভ্যতার খোঁজ করতে উঠে পড়ে লেগেছে নাসা। কিন্তু বিজ্ঞানীদের আশঙ্কা, নাসার এই অতি কৌতূহল পৃথিবীর জন্য বিপদ ডেকে আনতে পারে। সূত্র: স্পেসডটকম।
ভিনগ্রহীদের সন্ধানে বহির্বিশ্বে সাংকেতিক আমন্ত্রণবার্তা পাঠানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে নাসা। খুব শীঘ্রই সেই বার্তা পৌঁছে যাবে ছায়াপথের বিশেষ বিশেষ অংশে। ভিনগ্রহী বিষয়ক গবেষকদের একাংশের দৃঢ় ধারণা, নাসা-র এই সাহসী পদক্ষেপ পৃথিবীকে বড় ঝুঁকির দিকে ঠেলে দিতেও পারে।
বহির্বিশ্ব অর্থাৎ সৌরজগতের বাইরের ছায়াপথে যে আরও নক্ষত্রমণ্ডল রয়েছে এবং সেই সব অন্য নক্ষত্রের অন্য কোনও গ্রহে যে মানুষের মতো বুদ্ধিমান প্রাণী থাকতে পারে, তা দীর্ঘদিন ধরেই বলে আসছেন নাসার বিজ্ঞানীরা। সন্দেহ নিরসনে এ বার তারা ঠিক করেছেন, বহির্বিশ্বে পৃথিবীর তরফে একটি সাংকেতিক বার্তা পাঠানো হবে। যাতে পৃথিবীর ঠিকানার পাশাপাশি জানানো থাকবে পৃথিবীতে বসবাসকারী মানুষ সম্পর্কে গুরুত্বপূর্ণ তথ্যও। থাকবে মহিলা এবং পুরুষের ছবি, সৌরজগতের বিশদ বিবরণ, পৃথিবীতে কী ভাবে আসতে হবে তার খুঁটিনাটি, এমনকি পৃথিবীর সঙ্গে যোগাযোগ করার অনুরোধ-সহ একটি সাংকেতিক আমন্ত্রণলিপিও।
মহাকাশ বিজ্ঞানীরা বলছেন, এর আগেও এই ধরনের বার্তা পাঠানো হয়েছিল মহাকাশে। ১৯৭৪ সালে রেডিও টেলিস্কোপের সাহায্যে পুয়ের্তো রিকো থেকে পাঠানো হয়েছিল আরেসিবো বার্তা। তাতেও পৃথিবীর সম্পর্কে কিছুটা একই ধরনের তথ্য দেওয়া ছিল। নাসার সাম্প্রতিক সাংকেতিক আমন্ত্রণপত্রটিকে আরেসিবোরই উন্নততর সংস্করণ বলা চলে। কিন্তু বিজ্ঞানীদের একাংশের ধারণা, এই আমন্ত্রণে ঝুঁকি আছে।
ভিনগ্রহীদের সন্ধানে বহির্বিশ্বে সাংকেতিক আমন্ত্রণবার্তা পাঠানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে নাসা। খুব শীঘ্রই সেই বার্তা পৌঁছে যাবে ছায়াপথের বিশেষ বিশেষ অংশে।
অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের ফিউচার অব হিউম্যানিটি ইনস্টিটিউট-এর এক গবেষক অ্যান্ডার্স স্যান্ডবার্গের ধারণা, ভিনগ্রহীদের বিষয়টিকে অনেকেই গুরুত্ব দিতে চান না। কিন্তু বিষয়টি নেহাৎ ফেলনা নয়, নাসা যে তথ্য বহির্বিশ্বে পাঠাচ্ছে তা বেশ গুরুত্বপূর্ণ। এর প্রভাব সুদূরপ্রসারী। কারণ প্রথমত, ওই আমন্ত্রণবার্তা যদি সত্যিই ভিনগ্রহীদের হাতে পৌঁছয়, তবে তারা ওই বার্তা পেয়ে চুপ করে বসে থাকবে এমন নয়। দ্বিতীয়ত, অক্সফোর্ডেরই আরেক গবেষকর টবি অর্ডের ধারণা, কোন ধরনের ভিনগ্রহীরা ওই বার্তা পাচ্ছে, তার উপরেও অনেক কিছু নির্ভর করছে। নাসা বহির্বিশ্বে সভ্যতার খোঁজ করছে ঠিকই। কিন্তু সেই সভ্যতা ততটা ‘সভ্য’ না-ও তো হতে পারে!
নাসার ওই সাংকেতিক বার্তায় মানুষের শারীরিক গঠন সংক্রান্ত তথ্যও দেওয়া রয়েছে, বিজ্ঞানীদের একাংশের প্রশ্ন, নাসা কীভাবে নিশ্চিত হচ্ছে যে ওই বার্তা পেয়ে ভিনগ্রহীরা পৃথিবীতে কোনও খারাপ উদ্দেশ্য নিয়ে এসে পৌঁছবে না!
স্যান্ডবার্গ বা অর্ডের মতো গবেষকদের আশঙ্কার জবাব এখনও দেয়নি নাসা। তবে জানা গিয়েছে, নাসা ওই সংকেত আমন্ত্রণ নিজেরা বহির্বিশ্বে পাঠাচ্ছে না। ওই বার্তা চীনের ৫০০ মিটার অ্যাপারচার স্ফেরিকাল রেডিও টেলিস্কোপ এবং উত্তর ক্যালিফোর্নিয়ার এসইটিআই ইনস্টিটিউটের অ্যালেন টেলিস্কোপ অ্যারে থেকে পাঠানো হবে ছায়াপথের বিশেষ অংশে। তবে ফল যা-ই হোক, মহাকাশবিজ্ঞানীদের অধিকাংশই একটি বিষয়ে একমত— ভিনগ্রহীদের আমন্ত্রণ পাঠানোর এই পদক্ষেপ নিঃসন্দেহে মহাকাশ বিজ্ঞান চর্চার এক গুরুত্বপূর্ণ মাইলফলক।
এলিয়েন শব্দটার আক্ষরিক অর্থ ‘ভিনদেশি’ বা ‘বিদেশি’ হলেও আমরা কিন্তু এলিয়েন বলতে বুঝি অন্য গ্রহের প্রাণী।
পৃথিবী ছাড়াও অন্য আরও অনেক গ্রহে প্রাণী আছে এবং তারা মানুষের চেয়েও উন্নত—এ রকম কথায় বিশ্বাস করে এমন মানুষের সংখ্যা অনেক। ২০১৭ সালের ডিসেম্বরে নিউইয়র্ক পোস্ট পত্রিকা পৃথিবীর ২৪টি দেশের ২৬ হাজার মানুষের মতামতের ভিত্তিতে একটি প্রতিবেদনে দাবি করে যে পৃথিবীর অর্ধেক মানুষ বিশ্বাস করে এলিয়েন আছে এবং তারা মানুষের চেয়ে উন্নত। মাত্র ২৬ হাজার মানুষ ৭০০ কোটি মানুষের হয়ে মত দিতে পারে না, সেটা আমরা জানি। কিন্তু জরিপগুলো এ রকমই হয়। নিজেদের চারপাশের মানুষের মতামত নিলেও বেশির ভাগ মানুষ বিশ্বাস করে যে অন্য গ্রহে প্রাণের অস্তিত্ব আছে।
যুক্তরাষ্ট্রসহ পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের অনেক মানুষ মাঝেমধ্যে দাবি করে যে তাদের সঙ্গে এলিয়েনের দেখা হয়েছে, কিংবা এলিয়েনরা এসে তাদের কোথাও ধরে নিয়ে গেছে, কিংবা অবিশ্বাস্য অনেক ঘটনা ঘটিয়েছে। অনেক গুপ্তহত্যাকাণ্ডকেও এলিয়েনের কাজ বলে চালানোর চেষ্টা করা হয়েছে। অনেকেই ইউএফও বা unidentified flying object বা উড়ন্ত চাকতি দেখেছেন বলে দাবি করেন। এলিয়েনের সঙ্গে মানুষের সাক্ষাৎ ঘটার ব্যাপারটা যে পুরোপুরি বানানো, সেটা মানতে রাজি নন অনেকে। এই অনেকের মধ্যে অনেক বিখ্যাত ব্যক্তিও আছেন। হার্ভার্ড মেডিকেল স্কুলের সাইকিয়াট্রির প্রফেসর জন ম্যাক বিশ্বাস করতেন, এলিয়েনরা আছে এবং তারা মানুষের সঙ্গে দুর্ব্যবহারও করে। এ নিয়ে অ্যাবডাকশান: হিউম্যান এনকাউন্টার উইথ এলিয়েনস নামে একটা ঢাউস বইও লিখেছিলেন তিনি। বইটাতে যেসব ঘটনা উল্লেখ করেছেন, সেগুলো সবই মানুষের সঙ্গে এলিয়েনের সংযোগ, সংঘাত ইত্যাদি নিয়ে এবং তিনি বিশ্বাস করেন যে এগুলো সত্য ঘটনা।
কিন্তু বিশ্বাস আর প্রমাণ এক জিনিস নয়। প্রমাণ করা না গেলে সেটা আর যা–ই হোক, বিজ্ঞান নয়। কোটি কোটি মানুষ বিশ্বাস করলেও কিংবা জন ম্যাকের মতো পুলিৎজার পুরস্কারপ্রাপ্ত বিজ্ঞানী–লেখক বললেও প্রমাণ না পেলে এলিয়েনকে সত্য বলে স্বীকৃতি দেওয়া বিজ্ঞানের পক্ষে সম্ভব নয়। বিজ্ঞানীরা এখনো কোনো ইউএফওর প্রমাণ পাননি, খুঁজে পাননি এলিয়েনের অস্তিত্ব।
কিন্তু এত বড় মহাবিশ্বের এত এত নক্ষত্রের কোটি কোটি গ্রহ-উপগ্রহের মধ্যে আমাদের পৃথিবী ছাড়া আর কোথাও কি প্রাণের উদ্ভব ঘটেনি? মহাবিশ্বে পৃথিবী কি আসলেই একা? এই প্রশ্নের উত্তর পাওয়ার জন্য বিজ্ঞানীরা এলিয়েনের অস্তিত্ব খুঁজে বের করার চেষ্টা করছেন অনেক অনেক বছর থেকে, যখন থেকে মহাবিশ্বের স্বরূপ বুঝতে পেরেছেন, তখন থেকে।
কেউ কেউ ইতিমধ্যেই বলতে শুরু করেছেন, এলিয়েনরা মানুষের চেয়ে এত বেশি চালাক যে মানুষের সাধ্য নেই তাদের খুঁজে বের করে। আবার কেউ কেউ আরও এক কাঠি বাড়িয়ে বলে ফেলেন, এলিয়েনরা এই পৃথিবীতেই আছে মানুষের বেশে, হয়তো আপনার আশপাশেই ঘুরছে, আপনি চিনতে পারছেন না। কিন্তু আপনি যদি বিজ্ঞান চিন্তা করেন, তাহলে আপনি প্রমাণ ছাড়া কোনো কিছুই বিশ্বাস করবেন না। কারণ, যা প্রমাণ করা যায় না, তা বিজ্ঞান নয়।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৭৪৮
আপনার মতামত জানানঃ