দুর্নীতি দমন কমিশনকে (দুদক) একেবারে ধুয়ে দিয়েছে টিআইবি। সাংবিধানিক একটি প্রতিষ্ঠানের এমন কঠোর ও তীব্র সমালোচনা নজিরবিহীন। দুদকের সমালোচনা করতে গিয়ে টিআইবি তাদের বিরুদ্ধে ‘ক্ষমতার বি-টিমের ভূমিকা পালনের’ অভিযোগ এনেছে। সংস্থাটি আরো বলছে, দুর্নীতি সর্বব্যাপী রূপ ধারণ করলেও দুদক ব্যস্ত চুনোপুঁটিদের টানাটানিতে। দুদক মহাপরিচালকের মেয়াদপূর্তিকে সুযোগ হিসেবে কাজে লাগিয়ে এখানে সৎ ও যোগ্য ব্যক্তিকে নিয়োগ দিয়ে সংস্থাটি পুনর্গঠনের আহ্বানও জানিয়েছে টিআইবি। আজ ৯ ডিসেম্বর ২০২০ আন্তর্জাতিক দুর্নীতি বিরোধী দিবস উপলক্ষে গণমাধ্যমে পাঠানো এক বিবৃতিতে টিআইবি এসব কথা বলেছে।
রাজনৈতিক, ব্যবসায়িক অন্য যে কোনোভাবে ক্ষমতাবানরা বিচারহীনতা উপভোগ করছে। দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) এক্ষেত্রে কার্যত ক্ষমতার বি-টিমের ভূমিকা পালন করছে।
টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান ওই বিবৃতিতে বলেছেন, “রাজনৈতিক, ব্যবসায়িক অন্য যে কোনোভাবে ক্ষমতাবানরা বিচারহীনতা উপভোগ করছে। দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) এক্ষেত্রে কার্যত ক্ষমতার বি-টিমের ভূমিকা পালন করছে। দুর্নীতি দমন ও এর কার্যকর প্রতিরোধে দুদককে কাগুজে বাঘের পরিচয় থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। প্রতিষ্ঠানটির প্রধানের মেয়াদপূর্তি আসন্ন এবং দুদককে কার্যকর সংস্থা হিসেবে প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে এটাকে একটা সুযোগ হিসেবে নিতে হবে। আইনানুগ প্রক্রিয়া অনুসরণ ও স্বচ্ছতা নিশ্চিত করে দলীয় রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত হয়ে সৎ, যোগ্য, নিরপেক্ষ, নেতৃত্ব গুণাবলীসম্পন্ন দৃঢ়চেতা ও পেশাদার নেতৃত্বের নিয়োগ নিশ্চিত করা সরকারের দায়িত্ব। আমরা আশা করি, সরকার আমাদের হতাশ করবে না।”
‘কোভিড-১৯ সংকটের মাঝে যেসব অভাবিত ঘটনা সামনে এসেছে, তাতে দুর্নীতি যে দেশে সর্বব্যাপী একটা রূপ নিয়েছে এটাই এখন অপ্রিয় সত্য’ এমন মন্তব্য করে টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, “এই পরিস্থিতিতে হতাশা প্রকাশ করা ছাড়া আর কি করণীয় আছে সেটাই প্রশ্ন হয়ে দাঁড়িয়েছে। সরকারের সর্বোচ্চ পর্যায় থেকে দুর্নীতির বিরুদ্ধে ‘শূন্য সহনশীলতার’ ঘোষণা থাকলেও এখনকার বাস্তবতায় তা কী অর্থ বহন করে তা কেউই নিশ্চিত করে বলতে পারেন না।”
টিআইবির নির্বাহী পরিচালক আরো বলেন, “আমরা দেখতে পাচ্ছি এই ঘোষণার বাস্তবায়ন আটকে যাচ্ছে শুধু চুনোপুঁটিদের টানাটানিতে। অথচ এই পর্যায়েই দুর্নীতির যে ভয়াবহতার কথা আমরা জেনেছি, তাতে এই প্রক্রিয়ার মূল কারিগর- যারা পেছনে থেকে কলকাঠি নাড়ছে, তাদের অনিয়ম-দুর্নীতির ব্যাপ্তি ও আর্থিক মূূল্য কী হতে পারে, সেটা চিন্তা করলেও আতঙ্কিত হতে হয়। একজন ছাত্রনেতার হাজার কোটি টাকা পাচার করার খবর দিয়েছে গণমাধ্যম মাত্র কদিন আগে। আরও ওপরের দিকের দুর্নীতিবাজ নেতাদের অবস্থা তো আমাদের কল্পনারও বাইরে। অথচ তাদের কারও বিষয়ে কোনও তদন্ত বা কার্যকর আইনি ব্যবস্থার খবর তো আমরা কখনও দেখিনি!”
বিবৃতিতে বলা হয়, সুশাসিত গণতান্ত্রিক বাংলাদেশ গড়তে দেশে আইনের শাসন ও জবাবদিহিমূলক সরকার প্রতিষ্ঠার বিকল্প নেই। তাই সব গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠান বিশেষ করে আইন প্রয়োগকারী সংস্থা, প্রশাসন, বিচার প্রক্রিয়া, নির্বাচন কমিশন ও মানবাধিকার কমিশনের নিরপেক্ষতা, বস্তুনিষ্ঠতা, দক্ষতা ও পেশাদারিত্ব নিশ্চিতের পাশাপাশি, গণমাধ্যম ও দেশবাসীর স্বাধীন মতপ্রকাশের সাংবিধানিক অধিকার অক্ষুণ্ন রাখার দাবি জানানো হয়।
শুধু দুদক নয়, টিআইবির নির্বাহী পরিচালক নিশানা করেছেন আরো অনেক সরকারি প্রতিষ্ঠানকেও। ইফতেখারুজ্জামান বলেন, “দুদকের পাশাপাশি বাংলাদেশ ব্যাংক এবং ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্ট ইউনিট, আইন প্রয়োগকারী সংস্থা, জাতীয় রাজস্ববোর্ড এবং বিশেষ করে অ্যাটর্নি জেনারেলের অফিসকেও তাদের নিরপেক্ষতা, দক্ষতা ও কার্যকরতার দৃশ্যমান উদাহরণ সৃষ্টি করতে হবে। অন্যথায় গগনচুম্বী অর্থ পাচারসহ সর্বব্যাপী দুর্নীতির রাশ টানা অসম্ভব। সম্প্রতি পররাষ্ট্রমন্ত্রী কানাডার বেগমপাড়ায় অর্থপাচার সংক্রান্ত যে তথ্য প্রকাশ করেছেন তা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। যদিও বিভিন্ন গণমাধ্যম জানাচ্ছে এই তথ্য খণ্ডিত এবং কেবলমাত্র একটি পেশাজীবী গোষ্ঠীর কথাই জানানো হয়েছে।”
তিনি যোগ করেন, “আমরা আশা করব সরকার আনুষ্ঠানিকভাবে কানাডা সরকারের কাছে সুনির্দিষ্টভাবে অর্থ পাচারের সঙ্গে জড়িতদের ব্যাপারে তথ্য চাইবে। একইভাবে মালেয়শিয়া, যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, সিঙ্গাপুর, সুইজারল্যান্ডসহ অন্যান্য দেশে বাংলাদেশ থেকে যে অর্থ পাচার হয়, তা ফিরিয়ে আনার ব্যাপারে আন্তর্জাতিক ও জাতীয়ভাবে স্বীকৃত যে পদ্ধতি আছে, তা সরকার অনুসরণ করার মাধ্যমে পাচারকৃত অর্থ ফিরিয়ে আনাসহ যারা এর সঙ্গে জড়িত তাদেরও দৃষ্টান্তমূলক বিচারের আওতায় আনবে। সিঙ্গাপুর থেকে পাচারকৃত অর্থ ফেরত আনা সম্ভব হয়েছে। কাজেই একটি ক্ষেত্রে এটি ঘটে থাকলে অন্যক্ষেত্রে কেন হবে না।”
গণমাধ্যম ও দেশবাসী সরকারের প্রতিদ্বন্দ্বী নয়, বরং সহযোদ্ধা। অথচ ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের মতো কালাকানুনসহ অন্য আরও সব আইনের যথেচ্ছা অপব্যবহার দুর্নীতির বিরুদ্ধে কার্যকর সামাজিক প্রতিরোধ গড়ে তোলার ক্ষেত্রে মারাত্মক প্রতিবন্ধক হয়ে উঠেছে
মতপ্রকাশের স্বাধীনতার দাবিতেও সোচ্চার হয়েছে টিআইবি। দুর্নীতি নিয়ন্ত্রণে স্বাধীন মতামত ও সংবিধান স্বীকৃত বাক স্বাধীনতা চর্চা অপরিহার্য উল্লেখ করে টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান জামান বলেন, “এক্ষেত্রে গণমাধ্যম ও দেশবাসী সরকারের প্রতিদ্বন্দ্বী নয়, বরং সহযোদ্ধা। অথচ ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের মতো কালাকানুনসহ অন্য আরও সব আইনের যথেচ্ছা অপব্যবহার দুর্নীতির বিরুদ্ধে কার্যকর সামাজিক প্রতিরোধ গড়ে তোলার ক্ষেত্রে মারাত্মক প্রতিবন্ধক হয়ে উঠেছে। দেশে মৌখিকভাবে স্বাধীন সাংবাদিকতা, মতপ্রকাশের স্বাধীনতা এবং মুক্ত গণমাধ্যমের প্রচার থাকলেও বাস্তবে প্রাতিষ্ঠানিক ও অপ্রাতিষ্ঠানিক উভয় পদ্ধতিতেই গণমাধ্যম নিয়ন্ত্রণের সর্বাত্মক চেষ্টা চলছে। তাই অবিলম্বে মুক্ত সাংবাদিকতা ও সাধারণের মতপ্রকাশের সুযোগ নিশ্চিত করতে হবে।”
উল্লেখ্য, জাতিসংঘের উদ্যোগে ২০০৩ সালের ৩১ অক্টোবর ‘আন্তর্জাতিক দুর্নীতিবিরোধী সনদ’ United Nations Convention Against Corruption (UNCAC) অনুমোদিত হয়। একই বছর ৯ থেকে ১১ ডিসেম্বর মেক্সিকোর মেরিডায় উচ্চ রাজনৈতিক পর্যায়ের স্বাক্ষরের উদ্দেশ্যে অনুষ্ঠিত সম্মেলনে সনদটি উম্মুক্ত করা হয়। স্বাক্ষর প্রদানের গুরুত্বকে স্মরণীয় রাখতে প্রতিবছর ৯ ডিসেম্বর জাতিসংঘ ঘোষিত আন্তর্জাতিক দুর্নীতিবিরোধী দিবস হিসেবে পালন করা হয়।
টিআইবি ২০০৪ সাল থেকে আন্তর্জাতিক দুর্নীতিবিরোধী দিবস উদযাপন করছে এবং ২০১৩ সাল থেকে দিবসটি সরকারিভাবে পালন ও স্বীকৃতির দাবি জানিয়ে আসছিল। যার ধারাবাহিকতায় বাংলাদেশ ২০১৭ সাল থেকে সরকারিভাবে আন্তর্জাতিক দুর্নীতিবিরোধী দিবস উদযাপন করছে। ‘কোভিড-১৯ মোকাবিলায় চাই দুর্নীতির প্রতি শূন্য সহনশীলতা: দুর্নীতি থামাও, জীবন বাঁচাও’ এই প্রতিপাদ্যে নানা আয়োজনের মধ্য দিয়ে এ বছরও দিবসটি উদযাপন করছে টিআইবি।
এসডাব্লিউ/এমএন/আরা/১২৫০
আপনার মতামত জানানঃ