মামুন আব্দুল্লাহ : পৃথিবীটা গোল, আজ যেখান থেকে আপনি হাঁটতে শুরু করলেন একদিন সেখানেই ফিরে আসবেন। এটা কি কাকতাল নাকি অবশ্যম্ভাবী? ফেসবুকে চলতে ফিরতেই একজনকে বলতে শুনেছিলাম, আমরা যারা রাজশাহীতে থাকি তারা সবাই সবার মিউচুয়াল। এখানে অপরিচিত কেউ নাই। কোন না কোন ভাবে আমরা তাদের চিনি। তো সেই কোন না কোন ভাবে এই মাধ্যমের বরাত দিয়ে আমিও বলতে পারি, আমিও বারেককে চিনি।
মহানগরীর পাড়াগুলোতে কিছু যুবক থাকে যারা নিজের ঘরের খেয়ে পাড়ার বিভিন্ন ছোটখাটো মাস্তানি করে, ফয়ফরমাশ খাটে। যেমন ধরা যাক, আপনার কন্যার বিবাহ। আত্মীয় স্বজন ছাড়াও পাড়ার পোলাপানদের মধ্য থেকে দুই-একজন বিনা নিমন্ত্রণে এসে বিয়ের প্রয়োজনীয় আচার আচরণ অনুষ্ঠানের তদারকি করা, অথবা পাড়ায় কোন বুজুর্গ ব্যক্তি তার কুলখানিতে নিজে থেকেই জিলাপীর ব্যাগটা হাতে নিয়ে গেটের কাছে দাঁড়িয়ে মিলাদে জিলাপীর তোবারক বিতরণ করা। রাজশাহীর কাজীহাটা নিবাসী বারেকের এটাই ছিল কাজ। লেখাপড়া বেশিদূর করেনি। পাড়ার মোড়ের দোকানে বসে রাস্তা দিয়ে কে এলো, কে গেলো এসবই নজরে রাখত। মাঝে মধ্যে কাউকে ধরে ডলা দেওয়ার অপরাধ ওয়ার্ড কাউন্সিলের চেম্বারে বিচার বসত তাকে নিয়ে।
আমরা তাকে চিনি একেবারে ছোট থেকে। যেহেতু একই এলাকায় থাকতাম, তিনি বড় ছিলেন সেহেতু তাকে বারেক ভাই বলে ডাকতাম। আমরা মানে এলাকার স্থানীয় উঠতি কিশোরের দল। এ ধরণের যুবকেরা এলাকায় পোলাপানের কাছে ভালোই জনপ্রিয় হতো। খেলার মাঠের ঝামেলা মিমাংসা, বাইরের কোন ছেলে এসে এলাকার মেয়েদের সাথে লাইন মারছে কিনা সেসব তদারকি করত সে।
ছবিতে দেখলাম বারেক টুপি পরেছে৷ পত্রিকায় পড়লাম সে খুব বড় নামাজী। নামাজের জন্য সাংবাদিকের সাথে ফোনে কথা বলেছে৷ এই সাংবাদিক কোথা থেকে বারেকের ফোন নাম্বার পেলো তা আন্দাজ করা সহজ৷ সাংবাদিক আসলে তার পরিচিত। আর আমার জানা মতে বারেক কখনো মসজিদে যেত না। কাজীহাটায় সেসময় একটাই জমে মসজিদ ছিল। তাকে শুক্রবারেও কখনো মসজিদে দেখি নাই। যখনই দেখতাম, এসপি সাহেবের বাসার সামনে মোড়ের দোকানে বসে আছে তার দুইটা সাঙ্গপাঙ্গকে নিয়ে। সাঙ্গপাঙ্গদের একজনের নাম মাসুদ৷ এখন আর কাজীহাটায় থাকে না। অপরজনকে বহুদিন দেখি নাই। কখন থেকে দেখি নাই যথাসময়ে সেটা উল্লেখ করব।
বারেককে শেষ যেবার দেখেছিলাম তার মাথা গড়ের মাঠ, কাজেই মাথার উপর টুপি কোন ধর্মীয় টুপি এটা ভাবার কারণ কোন কারণ নাই। মাথার টাক লুকানোর জন্যও এই ব্যবস্থা হতে পারে। যুবক বয়সে বারেক ক্রিকেট খেলার চেষ্টা করেছিল। যেখানে সিগারেট খাওয়ার জন্য মেয়েটিকে হ্যারাজমেন্ট করেছিল সে, অনেকে জায়গায় দেখলাম জায়গাটার নাম সার্কিট হাউজ রোড লিখেছে। সেটা আসলে সিএন্ডবি মোড় থেকে সামনে গিয়ে আনসার ভিডিপি মাঠের রাস্তা। ফলে ওটাকে আমরা আনসার ভিডিপি ফিল্ড রোড বলেই চিনতাম। সিএন্ডবি মোড়ের উপরে এখন যেখানে নানকিং বাজার, সেটা আগে মনিবাজার ছিল। বিখ্যাত হকি খেলোয়াড় মনি এর নামে নামকরণ। দুর্বৃত্তদের হাতে অল্প বয়সে সে প্রাণ হারায়। সেখানেই বৈকালী ক্লাব। এই ক্লাব থেকেই বারেক চেষ্টা করেছিল ক্রিকেট খেলার। খেলাটা তার হয়ে ওঠেনি, কিন্তু পাশের এলাকা চণ্ডিপুরের সাথে পোলাপানের সাথে দ্বন্দ্বে জড়িয়ে পড়ে। রাইভালরি আগে থেকেই ছিল, কিন্তু বারেকের সঙ্গে সেটা একেবারে গ্যাং ওয়র পর্যন্ত গড়িয়ে যায়।
ছোট খাটো মাস্তানি করার সাথে সাথে সে মদ, গাঁজা, ফেন্সিডিল সবই খেত। তাই এর মুখে ধর্ম কর্ম অদ্ভুত শোনায়। যে এলাকায় মেয়েটিকে সিগারেট খেতে দেখা গেছে, সেটা পাবলিক প্লেস। বাসাবাড়িও খুব একটা নাই। ফলে ঐ মেয়েকে দেখে তার পাড়ার মেয়েরা নষ্ট হয়ে যাবে এটা তার অপরাধের জাস্টিফাই হতে পারে, এছাড়া অন্য কিছু না। অর্থাৎ তার দরকার ছিল মেয়েটিকে যেকোনো মূল্যে থামানো সে সেটা করেছে, হাবিজাবি যুক্তি দিয়ে এখন সেই কাজের বৈধতা আদায়ের চেষ্টা করছে। এ ধরণের মাতব্বরি বারেক নতুন করছে না। এরকম ঘোড়া ডিঙিয়ে ঘাস খাওয়ার মতন মাতব্বরি সে আগেও করেছে।
আনসার ভিডিপি মাঠ, সিএন্ডবি মোড়ের আশেপাশে ২০০০-০৪ এর সময়ে জমেলা নামের একজন ভাসমান পতিতা ঘুরে বেড়াত। পরবর্তীতে এইচআইভি এইডসের সচেতনতা বিষয়ক ক্যাম্পেইন করত। আমাদের বীরপুঙ্গব জমেলার নিয়মিত খদ্দের ছিল।
রেডিও সেন্টার মাঠে এখন যে রেসিডেন্টশিয়াল স্কুল হয়েছে সেই স্কুলের এক ছাত্রকে খুনের জন্য কাজীহাটার পাঁচ ছয়জন কিশোর যুবকের নামে মামলা হয়েছিল। কয়েকজন ধরা পড়ে, বাকীরা পালিয়ে যায়। যারা পালিয়ে যায় তাদের মাঝে বারেকের দুই সাঙ্গপাঙ্গর একজন ছিল, মামলায় সে ছিল অন্যতম আসামী। অপর ছেলেটা যার নাম মাসুদ। তারা তখন কাজীহাটার জায়গা-জমি বিক্রি করে অন্য এলাকায় চলে যায়। মাসুদ আসামী ছিল না। এরপর বারেকও কয়েক বছরের জন্য গায়েব হয়ে যায়। গায়েব হওয়ার আগ পর্যন্ত সে বিএনপিই করত। তার বাপ-চাচা সবাই বিএনপির সক্রিয় কর্মী ছিল। তার বিএনপির ব্যাকগ্রাউন্ড খুব স্ট্রং। রাজশাহীর সাবেক মেয়র মিনুর সঙ্গে ওদের পারিবারিক ভাবে ভালো খাতির ছিল। যখন বারেক এলাকা ছাড়া হয় তখন তত্ত্বাবধায়ক সরকার ছিল ক্ষমতায়। কয়েক বছর পর ফিরে এসে আওয়ামীলীগের রাজনীতি শুরু করে, গা বাঁচাতেই। বিএনপির হয়ে এত লাঠিপেটা, থানার চক্কর খেয়ে, রাজনৈতিকভাবে হেনস্তা হয়ে কেউ নৈতিকভাবে আওয়ামীলীগের রাজনীতিতে যোগ দিতে পারে এটা বুঝতে পারলে ঐ লোকের নীতিগত অবস্থান কীরকম হতে পারে সে ব্যাপারে একটা স্পষ্ট ধারণা পাওয়া যায়। আজ রাজশাহীবাসীর নৈতিকতার দায়িত্ব কাঁধে তুলে নিয়েছে এই সমস্ত স্থানীয় মাস্তানেরা, যাদের নিজেরই কোন নৈতিক মানদণ্ড নাই।
এসডব্লিউ/নসদ/০৮১৫
আপনার মতামত জানানঃ