ইউক্রেনে রাশিয়ার সামরিক অভিযান শুরুর পর পশ্চিমা দেশগুলোয় তীব্র হয়েছে ‘রুশোফোবিয়া’। ব্যাপক রুশবিদ্বেষের খবর প্রকাশিত হচ্ছে পশ্চিমা সংবাদমাধ্যমেই। সাধারণ মানুষ রাশিয়ার নীতির বিরোধিতার উপায় হিসেবে রুশ প্রতিষ্ঠান ভাঙচুর, পণ্য বয়কটের মতো ঘটনা ঘটাচ্ছেন। রাশিয়ার নাগরিকদের প্রতিও দেখানো হচ্ছে তীব্র ঘৃণা ও বিদ্বেষমূলক মনোভাব।
যেভাবে প্রকট হচ্ছে রুশোফোবিয়া
এমএসএনবিসিতে সম্প্রতি প্রকাশিত এক নিবন্ধে লাগামহীন রুশোফোবিয়া নিয়ে উদ্বেগ জানানো হয়েছে। এতে বলা হয়, ‘রাশিয়ান সরকার এবং রুশ জনগণের মধ্যে পার্থক্য করতে না পারার ঘটনা আমাদের অন্ধকার পথে নিয়ে যেতে পারে।’
সাম্প্রতিক রুশোফোবিয়ার উল্লেখ করে নিবন্ধে বলা হয়, রুশ মালিকানার রেস্তোরাঁ ভাঙচুর করা হচ্ছে, সেগুলো সম্পর্কে বাজে রিভিউ দেয়া হচ্ছে। রুশ সংগীতশিল্পী এবং প্রয়াত রুশ সুরকারদের গানের কনসার্ট বাতিল করা হচ্ছে।
রাতের খাবারের তালিকা থেকে কানাডিয়ান সুস্বাদু পাউটিন নামের খাবার সরিয়ে দেয়া হয়েছে, কারণ ফরাসি ভাষায় এ নামটির সঙ্গে রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের নামের বেশ মিল রয়েছে। চলচ্চিত্র উৎসব থেকে বাদ দেয়া হচ্ছে রাশিয়ান সিনেমা। যুক্তরাষ্ট্রের কিছু শহরে রাশিয়ান ভদকা ড্রেনে ফেলে দিয়ে তার ছবি তুলে প্রচার করছেন সরকারি কর্মকর্তারা।
যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা এবং ইউরোপের অনেক নাগরিক বিতর্ক এড়ানোর কৌশল হিসেবেও রাশিয়াসংশ্লিষ্ট পণ্য বয়কট করছেন। যেমন রাশিয়ার খাবার খেলে ‘মস্কোপন্থি’ হিসেবে পরিচিত হবেন, এমন আশঙ্কায় সেগুলো এড়িয়ে যাচ্ছেন।
এমএসএনবিসির নিবন্ধে বলা হয়, বড় একটি অংশের ক্ষেত্রে এসব আচরণ রাশিয়ার বৈদেশিক নীতির প্রতিবাদের চেয়ে উন্মাদনার পর্যায়ে পৌঁছেছে। এটি সামগ্রিকভাবে একটি অমানবিক বৈশ্বিক দৃষ্টিভঙ্গির জন্ম দিচ্ছে।
সাধারণ মানুষের মধ্যে রুশসংশ্লিষ্টতা বর্জনের প্রবণতার সঙ্গে রাষ্ট্রীয় পর্যায়ের সুসংগঠিত বয়কটের খুব বেশি সংযোগ নেই। পুতিন সরকারকে চাপে ফেলতে পশ্চিমা দেশগুলো নজিরবিহীন কঠোর নিষেধাজ্ঞা দিলেও রাশিয়া সেটি অনেকটাই সামলে নিয়েছে। এর আগে ইরান ও উত্তর কোরিয়া এ ধরনের কিছু নিষেধাজ্ঞায় কাবু হলেও মস্কোর অনমনীয় অবস্থানে কোনো পরিবর্তন দেখা যাচ্ছে না। আর এমন অবস্থায় প্রকট হয়ে উঠছে রুশোফোবিয়া।
রুশফোবিয়ার ইতিহাস
নাইন-ইলেভেন হামলার পর যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা দেশে মুসলিমবিদ্বেষ বা ইসলামফোবিয়া ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়ে। এতে মুসলিমদের নাগরিক অধিকার ব্যাপকভাবে খর্ব হওয়ার অভিযোগ রয়েছে। ইউক্রেন যুদ্ধ শুরুর পর পশ্চিমা দেশগুলোয় রুশদের প্রতি বিদ্বেষ ও ঘৃণাও একইভাবে ছড়িয়ে পড়েছে।
কলিন্স ডিকশনারিতে ‘রুশোফোবিয়া’র অর্থ হিসেবে বলা হয়েছে, রাশিয়া বা বিশেষত সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়ন ও এর রাজনৈতিক ব্যবস্থা ইত্যাদির প্রতি তীব্র এবং প্রায় ক্ষেত্রেই অযৌক্তিক ঘৃণা।
উনিশ শতকে জারের শাসনামলে রাশিয়া পশ্চিমা শক্তিকে চ্যালেঞ্জ জানিয়ে পূর্ব ইউরোপ এবং মধ্য এশিয়ায় শক্তি বিস্তার ঘটানোর সময় দেশটির প্রতি বিদ্বেষমূলক শব্দ হিসেবে ‘রুশোফোবিয়া’র উদ্ভব হয়।
পরবর্তী সময়ে হিটলারের সময়কার জার্মানিতে রুশোফোবিয়ার ব্যাপক বিস্তার ঘটে। নাৎসি শাসিত জার্মানিতে রুশ ও অন্যান্য স্লাভ জাতিগোষ্ঠীর সদস্যদের ‘নিকৃষ্ট’ এবং ‘উপমানব’ মনে করা হতো। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়ে এই বিদ্বেষ থেকে লক্ষাধিক রুশ বেসামরিক নাগরিককে হত্যা করা হয়।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরও ইউরোপ ও আমেরিকায় রুশোফোবিয়া ব্যাপকভাবে বহাল থাকে, তবে ১৯৯১ সালে সোভিয়েত ইউনিয়ন পতনের পর কমে আসে এর মাত্রা। সম্প্রতি ইউক্রেন যুদ্ধ শুরুর পর ইউরোপ-আমেরিকায় রুশোফোবিয়া আবার মাথাচাড়া দিয়েছে।
এই আচারণ ভুল যে কারণে
এমএসএনবিসির নিবন্ধে বলা হয়েছে, ‘আমরা যেটি দেখছি তা হলো, এসব বয়কটের উদ্দেশ্য হলো, সাময়িক প্রচেষ্টার মাধ্যমে একটি দেশ হিসেবে রাশিয়াকে আরও বড় পরিসরে কলঙ্কিত করা।
এ ধরনের কর্মকাণ্ডের আরও জঙ্গি রূপ হলো, রাশিয়ান রেস্তোরাঁর জানালা ভাঙা। অথবা এমন বার্তা দেয়া যে, রাশিয়ান রেস্তোরাঁর মালিকেরা দেশে ফিরে যান। এগুলো মোটেই রুশ সরকারের ওপর অর্থপূর্ণ চাপ প্রয়োগের উপায় নয়, এগুলো স্রেফ জেনোফোবিক (বিদেশিবিদ্বেষ) উৎপীড়ন।
‘রুশ সরকার এবং রাশিয়ার জনগণের মধ্যে পার্থক্য না করার প্রচেষ্টা ন্যায্য বা নৈতিক নয়। কারণ রাশিয়ার মতো একটি কর্তৃত্ববাদী দেশে নীতিগত বিষয়ে জনগণের সরাসরি মতামত দেয়ার কোনো সুযোগ নেই এবং সেখানে নাগরিক সমাজ ব্যাপকভাবে নজরদারি ও দমন-পীড়নের মধ্যে থাকে।
ইউক্রেনে অভিযান শুরুর নির্দেশ পুতিন দিয়েছেন, রাশিয়ার জনগণ নয়। উল্টো তাদের অনেকেই ব্যক্তিগত ঝুঁকি নিয়ে এর প্রতিবাদ করেছেন এবং পুতিনের আগ্রাসী আচরণে বিশ্বের বাকিদের মতো তারাও অবাক হয়েছেন।’
নিবন্ধে বলা হয়, পশ্চিমে রুশোফোবিয়ার শিকার ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের মধ্যে অনেকেই আছে, যারা রুশ সরকারের সমালোচক। শো বাতিল করা রুশ পিয়ানোবাদক আলেকজান্ডার মালোফিভ যুদ্ধ শুরু হওয়ার পরেই লিখেছিলেন, ‘বাস্তবতা হলো রাশিয়ার এই ভয়ংকর ও রক্তাক্ত সিদ্ধান্ত আমরা প্রতিহত করতে পারিনি ভেবে প্রতিটি রাশিয়ান কয়েক দশক ধরে নিজেদের অপরাধী ভাববেন।’
নিউ ইয়র্ক টাইমসের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, নিউ ইয়র্কের বেশির ভাগ রাশিয়ান রেস্তোরাঁ মালিক যুদ্ধবিরোধী। এর পরও তাদের পুতিন সমর্থক ধরে নিয়ে সমালোচনার মুখে ফেলা হচ্ছে। যেসব রুশ পরিচালকের চলচ্চিত্র একটি উৎসব থেকে বাদ দেয়া হয়েছে, তারা রাষ্ট্রীয় হুমকির ঝুঁকি নিয়েও প্রকাশ্যে যুদ্ধের বিরোধিতা করেছেন। একটি সংগীত আয়োজন থেকে রুশ সুরকার চাইকোভস্কিকে বাদ দেয়া হয়েছে। চাইকোভস্কি অবশ্য পুতিনের সমালোচক ছিলেন না, কারণ তিনি এক শতাব্দী আগে মারা গেছেন।
শুধু রাশিয়ার নাগরিকরাই যে রুশোফোবিয়ার শিকার, তাও কিন্তু নয়। লোকজনের জানা-বোঝার অভাবে ইউক্রেন ও ওই অঞ্চলের অন্য দেশের নাগরিকও পশ্চিমে বিদ্বেষের মুখোমুখি হচ্ছেন। রাশিয়ান ভদকা দাবি করে এমন ভদকাও ফেলে দেয়া হচ্ছে, যার মালিকানা আসলে ইউক্রেনের। কেবল রুশ চেহারার সঙ্গে মিল থাকার কারণেই বিদ্বেষের শিকার হচ্ছেন অনেকে।
যুক্তরাষ্ট্রে উন্মাদনার মাত্রা নিয়ে শঙ্কা প্রকাশ করে এমএসএনবিসির নিবন্ধে বলা হয়, ‘এই প্রবণতা একটি সমগ্র জাতিকে অমানবিক করে তুলছে। এটি একটি কঠোর নীতির প্রভাব সম্পর্কে আমাদের অন্ধ করে তুলতে পারে। একইভাবে সীমাহীন কঠোর নিষেধাজ্ঞা শেষ পর্যন্ত রাশিয়ার রাজনৈতিক শ্রেণির ওপর সীমিত প্রভাব রেখে সাধারণ রুশদের ব্যাপক ভোগান্তির মুখোমুখি করতে পারে। আরও উদ্বেগজনক বিষয় হলো, রাশিয়ার ভিন্নমতের মানুষকে উপেক্ষা এবং তাদের সঙ্গে সাংস্কৃতিক যোগাযোগের পথ বন্ধ করায় আমরা আরও অমানবিক রুশ জাতি গড়ার পথ সুগম করছি।’
নিষেধাজ্ঞা বা ঘৃণার প্রবণতা থেকে বেরিয়ে এসে কার্যকর কৌশল নেয়ার পরামর্শ দেয়া হয়েছে নিবন্ধে। এতে বলা হয়, ইউক্রেনীয়দের সঙ্গে একাত্মতা এবং রাশিয়ার সাম্রাজ্যবাদী যুদ্ধের বিরোধিতা করার নানা উপায় রয়েছে। যেমন ইউক্রেনে সাহায্য পাঠানো, দেশটির শরণার্থীদের আশ্রয়দান এবং যুদ্ধের বিরুদ্ধে অবস্থান নেয়া রুশ ভিন্নমতাবলম্বীদের সমর্থন করার উপায় খুঁজে বের করা।
নিবন্ধে বলা হয়, পশ্চিমে অবস্থান করা রাশিয়ানদের মধ্যে যারা যুদ্ধের বিরোধিতা করছেন তারা গুরুত্বপূর্ণ মিত্র। তাদের ঘৃণার মুখোমুখি করার প্রবণতা বন্ধ করে পশ্চিমের উচিত আলিঙ্গনের পথ বেছে নেয়া।
এসডব্লিউ/এসএস/১৩০০
আপনার মতামত জানানঃ